ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র হিন্দি সাহিত্যের ভগীরথ রূপে পরিগণিত। তার লেখনী স্পর্শেই হিন্দি সাহিত্যে নবজাগরণের যুগরূপে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ শেঠ আমিনচন্দের বংশজাত ভারতেন্দু হিন্দি সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবর্তক। বাল্যাবস্থা থেকেই তার বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ পরিলক্ষিত হয়। তার সৃজনশীল কবিপ্রতিভা এবং বহুমুখী রচনাশৈলী তার জনপ্রিয়তাকে বহুবিস্তৃত করেছিল ফলে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে, ভারতের সমকালীন সাহিত্যজগত সাংবাদিককুল তাকে ভারতেন্দু আখ্যায় ভূষিত করেন।

হিন্দি সাহিত্যক্ষেত্রে আধুনিককালের প্রবর্ত্তকরূপ (১৯০০) ভারতেন্দু হরিশচন্দ্রের মহত্ব কেবলমাত্র সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ নয়। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকেও তার মহত্ত্ব অপরিসীম। এর মূলত দুটি কারণ স্বীকার করা হয়। একটি কারণ হল ভারতেন্দুই প্রথম কবি যিনি রীতিকালীন নগ্ন শৃঙ্গারের জগত থেকে কাব্যকে উদ্ধার করে সুস্থ এবং স্বকীয় পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছিলেন। অন্য কারণ হল আপন দূরদৃষ্টিসহকারে পদ্যসাহিত্যকে যুগোপযোগী করে তুলেছিলেন এবং সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে যুগোপযোগী চিন্তাচেতনার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন।

কবিঘর হরিশচন্দ্র ইতিহাসখ্যাত শেঠ আমিণচন্দের বংশজাত, তার পিতা বাবু গোপালচন্দ্র। গিরিধরদাস সমকালীন যুগের এক প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। হরিশ্চন্দ্র বাল্যাবস্থা থেকেই সর্বতোমুখী রচনাশৈলীর নিদর্শন রাখেন। কবিত্বশক্তির প্রকাশের সাথে সাথে তিনি একজন সাংবাদিকতারূপেও আপন প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ‘কবিবচনসুধা এবং ‘হরিশচন্দ্র চন্দ্রিকা’ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত হত। এই পত্রিকা দুটি তৎকালে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

কাশীর স্বনামধন্য কবি নাট্যকার এবং প্রোথিতযশা পুরুষ বাবু গোপালচন্দ্রের (ছদ্মনাম ‘গিরিধরদাস’) পবিত্র গৃহে ১৮৫০ সালে ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের জন্ম হয়। সহজাত প্রতিভা ও সাহিত্যানুকুল পরিবেশের বাল্যাবস্থা থেকেই ভারতেন্দুর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল।

ভারতেন্দু ছিলেন প্রধানত কবি যদিও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তার পদচারণা ছিল স্বচ্ছন্দ। তার রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় সত্তর। এদের মধ্যে-‘প্রেম মালিকা’ ‘প্রেম সরোবর’ ‘গীত গোবিন্দানন্দ’ ‘বর্ষা বিনোদ’ ‘বিনয় প্রেমপচাশ’, প্রেম ফুলওয়ায়ী, বেণুগীতি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতেন্দু গ্রন্থাবলীর প্রথম খণ্ডে তার সমস্ত ছোটো বড়ো কাব্যরচনাসমূহ সংকলিত হয়েছে।

মূলত আধুনিক হিন্দি নাটক ও প্রবন্ধরচনা ভারতেন্দুর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। প্রাক ভারতেন্দু যুগে, রঙ্গমঞ্চ বা নাট্যধারার বিকাশ ঘটেনি তেমনভাবে। অত্যন্ত নিম্নমানের কয়েকটি ভ্রাম্যমান পার্সী থিয়েটারের দল থাকলেও যুগোপযোগী চিন্তাশৈলির এবং সামাজিক পটভূমিকার যথার্থ রূপায়ণের কোনও প্রকাশ তৎকালে দেখা যায়নি।

নিরাশার কালিমা থেকে পবিত্র ভারতীয় জীবন ও সাহিত্যকে উদ্ধার করে ভারতেন্দু সূর্য হিন্দি সাহিত্যের আকাশকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছিল।

সাহিত্যের অনেকগুলি শাখা থাকলেও নাটকই একমাত্র শাখা যার মাধ্যমে সামাজিক শিক্ষা, চিত্তবিনোদন এবং ভাববিনিময়ের সুযোগ সর্বাধিক বিদ্যমান। সুতরাং সাহিত্যের এই শাখার যথার্থ বিকাশ ব্যতিরেকে অন্যান্য শাখাগুলিও কিয়দংশে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সারসত্যটি ভারতেন্দু যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই দেশের অতীত ইতিহাসের নাট্যরূপায়ণে প্রয়াসী হন। ফলে পরাধীন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ঐক্য এবং নবজাগরণের সূচনাকল্পে বারতেন্দুজী তার লেখনী ধারণ করেছিলেন নাটক রচনার মাধ্যমে। তার অনুদিত এবং মৌলিক নাটকের সংখ্যা সতেরো। ওই নাটকসমূহের কায়ায় তৎকালীন রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে।

প্রাবন্ধিক ভারতেন্দু সাহিত্যাকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। সমকালীন সমাজে পুঁজিবাদের বিস্তার মানবের মুক্তিপথে বাধার অচলায়তন রূপে বিরাজ করছিল। রাজনীতি, শিল্প, পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস, ভ্রমণ, জীবনী, সমাজসংস্কার এবং ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধাবলী আমাদের চিন্তাশক্তিকে উদ্দীপ্ত করে। তাই হিন্দি সাহিত্যের আলোচনার পুরোধাপুরুষ হিসাবে আমরা ভারতেন্দুকে উল্লেখ করতে পারি।