সূচনা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ভারতীয়রা নিজেদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কে ব্রিটিশ বা ইউরােপীয়দের মতাে সচেতন ছিল না। চিকিৎসা ছিল খুবই নিম্নমানের এবং এই চিকিৎসার কোনাে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। ফলে রােগীর মৃত্যুর হারও ছিল যথেষ্ট বেশি। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এদেশে পশ্চিমি ধাঁচের স্বাস্থ্য এর ধারণার প্রসার ঘটতে থাকে।
[1] আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি: ভারতে প্রচলিত পিছিয়ে-পড়া চিকিৎসা পদ্ধতির স্থলে ব্রিটিশরা এদেশে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আসে। তারা এদেশে অ্যালােপ্যাথি ও হােমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির প্রসার ঘটায়। বিজ্ঞানভিত্তিক এই চিকিৎসার প্রসারের ফলে ভারতে চিকিৎসা ব্যবস্থা বহুলাংশে পাল্টে যায় এবং রােগীর মৃত্যুর হার আগের তুলনায় বহুলাংশে হ্রাস পায়। গুটি বসন্তের মতাে রােগ প্রতিরােধের জন্য ইংরেজরা টীকাকরণের ব্যবস্থা করে। আধুনিক এই চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ভারতীয়রা ক্রমে সচেতন হয়ে ওঠে।
[2] জনস্বাস্থ্য: এদেশে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রয়ােজনের দিকে নজর রেখে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে জনস্বাস্থ্য ও সংক্রামক ব্যাধি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে। কলকাতা-সহ বিভিন্ন স্থানের যৌনকর্মীদেরও নিয়মিত স্বাস্থ্য-পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। পুণ্যস্নানের কেন্দ্রগুলিতে সেই জল যাতে পুণ্যার্থীরা পান না করে তার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দূষিত ও জীবাণুর মূল ঘাঁটি বহু পুকুর ও কুয়াে বুজিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
[3] জনগণের জমায়েতের ক্ষেত্র: বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র, পূজা-পার্বণ, মেলা, কীর্তন বা যাত্রাগানের আসর, পুণ্যস্নান প্রভৃতি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রচুর মানুষ একত্রিত হয়। এসব স্থানে বিভিন্ন ছোঁয়াচে রােগের সংক্রমণ, কলেরা, মহামারির প্রাদুর্ভাব প্রভৃতির যথেষ্ট আশঙ্কা থাকত। ব্রিটিশরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে জড়াে হওয়া এসব জনবহুল স্থানগুলিতে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার পরিকল্পনা করে। তারা জনবহুল এসব স্থানে বিশুদ্ধ পানীয় জল, শৌচালয়, মেডিকেল বিভাগ, পুলিশ প্রভৃতি নিয়ােগ করে রােগ সংক্রমণ, মহামারি ইত্যাদি প্রতিরােধের উদ্যোগ নিত।
উপসংহার: ‘স্বাস্থ্য’ সম্পর্কে ভারতে পশ্চিমি ধারণার প্রসার ঘটলেও তা কখনও অবাধ ছিল না। এদেশে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিক প্রসার ঘটলেও আধুনিক পশ্চিমি ‘স্বাস্থ্য’-এর ধারণা এদেশে প্রসার লাভ করতে শুরু করে ঊনবিংশ শতক থেকে। আর্থিক কারণে সরকারের স্বাস্থ্যনীতি মূলত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। দূরদূরান্তের গ্রামাঞ্চলে এই সুবিধা পৌছােয়নি। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয়রা ‘স্বাস্থ্য’ সম্পর্কে পশ্চিমি ধারণার প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
Leave a comment