বর্ণ ও জাতিব্যবস্থা:

ভারতীয় সমাজব্যবস্থার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বর্ণ ও জাতি সম্পর্কিত ধারণা এবং উভয়ের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক। বর্ণ ও জাতিব্যবস্থার আপাত মিল থাকলেও দুটি ধারণা সম্পূর্ণ অভিন্ন নয়। এদের মধ্যে সুক্ষ্ম প্রভেদ বর্তমান। বর্ণ চারটি; কিন্তু জাতি অসংখ্য। হাজার হাজার জাতি কোনো-না-কোনো বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন ভারতে বর্ণব্যবস্থাকে বিশেষ ‘একক’ বলে মনে করা হত। এক বর্ণের মধ্যে অনেক জাতির অবস্থান ঘটত। বর্ণবিভক্ত ভারতীয় সমাজে বিদেশিদের আগমন ও বসবাস এবং বিভিন্ন উপজাতির সমাবেশের ফলে জাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধর্মশাস্ত্রে এই সকল জাতিকে বর্ণসংকর বা বর্ণসংকীর্ণ আখ্যা দিয়ে আদি বর্ণবিভক্ত সমাজে সাঙ্গীকরণের ব্যবস্থা করা হয়। সপ্তম শতকে গোড়ার দিকে বর্ণ ও জাতির প্রভেদ ধীরে ধীরে কমে আসে। অধ্যাপক রামশরণ শর্মা বর্ণ ও জাতি ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ প্রসঙ্গে সুন্দরভাবে বলেছেন যে, “বর্ণ ও জাতি বাস্তবে এক ধরনের সামাজিক ভেদাভেদের দ্যোতক। সামাজিক সংঘাত এবং সম্পদ ও উৎপাদনের অসম বণ্টনের ফলেই সেই সামাজিক ভেদাভেদের সৃষ্টি হয়। তাই বস্তুগত জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণ ও জাতি ধারণারও বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা দেয়।”

আদি বৈদিক যুগের সমাজ ছিল ‘উপজাতীয়, অর্ধাযাযাবর এবং পশুচারী’। বৈদিক আর্যদের অন্তগোষ্ঠী দ্বন্দ্ব কিংবা আর্য-অনার্য সংঘর্ষে লুণ্ঠিত দ্রব্য উপজাতীয় সভায় বণ্টন করা হত। পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের সূচনা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ও পরবর্তীকালে লৌহজাত কৃষি সরঞ্জামের ব্যবহার শুরু হলে উদ্বৃত্ত উৎপাদন শুরু হয়। মানুষের বস্তুগত জীবনে গভীর পরিবর্তন সূচিত হয়। অধ্যাপক শর্মার মতে, কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থা বর্ণব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণভুক্তরা বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণভুক্তদের শ্রম ও উৎপাদনের ওপর কর্তৃত্ব চালাতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই ব্যবস্থা প্রবলাকারে চলতে থাকে।

আনুমানিক খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের পরবর্তীকালে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আবার পরিবর্তন আসে। এই সময় রাজা ব্রাহ্মণ ও উচ্চকর্মচারীদের ভূমিদানের মাধ্যমে বেতন দেওয়ার কাজ শুরু করেন। ফলে এক নতুন ভূস্বামী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। ভাড়াটে মজুর, দাস ও আদিবাসীরা নতুন ভূস্বামীদের জমিতে উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত হন। এঁরা মূলত শূদ্রশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হন। এই ব্যবস্থার ব্যাপকতা এদেশে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা করে। ভূস্বামী ও কৃষকের (স্বামীন্-কর্ষক) মধ্যে স্পষ্ট ভেদরেখা টানা হয়। গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা জমির ওপর ব্রাহ্মণদের ভৌমিক অধিকার (অগ্রহার) স্থাপিত হলে, শূদ্রের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের পরবর্তীকালে তাম্রশাসন জারি করে ভূমিদানের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এইভাবে জমি ও ক্ষমতা বণ্টনের ফলে নতুন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণিব্যবস্থা গড়ে উঠে, যা প্রচলিত চতুর্বর্ণব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র। সপ্তম শতকের পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে চতুর্বর্ণের উপযোগী বাসস্থানের বর্ণনা স্থান পেত। পরবর্তীকালের কোনো কোনো গ্রন্থে এই চতুর্বর্ণব্যবস্থা লঙ্ঘিত হয়েছে। গণপতি শাস্ত্রী সম্পাদিত ‘ময়মত’ পুঁথির অনুবাদে সম্রাট, দ্বিজ, নৃপতি, বৈশ্য, সেনাপ্রধান, শুদ্র, সামন্ত প্রমুখদের বাসগৃহের আকৃতি, যা সামাজিক মর্যাদার দ্যোতক, উল্লেখ করা হয়েছে। বরাহমিহির তাঁর ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে জন্মভিত্তিক চতুর্বর্ণব্যবস্থাকে রক্ষা করার প্রয়াস করেছেন। কিন্তু প্রায় সমকালীন অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণপ্রথার কঠোরতাকে অগ্রাহ্য করে সামন্তপ্রভু ও উপসামন্তদের সামাজিক স্তর নির্দিষ্ট করা হয়েছে। দ্বাদশ শতকে রচিত ভট্ট ভুবনানন্দের ‘অপরাজিত পৃচ্ছতে সামন্ত ও উপসামন্তদের আটটি স্তর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মহারাজ, মণ্ডলেশ্বর, মাগুলিক, মহাসামন্ত, সামন্ত, লঘুসামন্ত, চতুরশিক, রাজপুত্র প্রভৃতি ক্রম নিম্নস্তরে বিন্যস্ত এই সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তথাকথিত চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার গুরুত্ব স্বীকৃত হয়নি। তবে অধ্যাপক পি. কে. আচার্য সম্পাদিত এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘মানসার পুঁথি’র সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, কিছু কিছু সামস্তপদে সকল বর্ণের লোক নিযুক্ত হতে পারতেন। নতুন ভূমিব্যবস্থা, নবপ্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এই বর্ণপ্রথার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। ‘মানসার’ গ্রন্থে বর্ণের উৎকর্ষতা স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয়েছে। অধ্যাপক শৰ্মা আদি মধ্যযুগের সমাজব্যবস্থার সাথে বৈদিক যুগের বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি মধ্যস্বত্বভোগী ভূস্বামীদের বর্ণব্যবস্থা-বহির্ভূত সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার উল্লেখ করেছেন। ছত্রধারণ, অশ্বারোহণ, পালকিযাত্রা, তোরণ নির্মাণ ইত্যাদি সামাজিক মর্যাদার দ্যোতক উপাদানগুলি বিভিন্ন স্তরের ভূস্বামীরা নিজ অবস্থান অনুযায়ী ভোগ করতে পারতেন। এক্ষেত্রে প্রচলিত বর্ণ ব্যবস্থার কোনো গুরুত্ব ছিল না। প্রাপকের ভৌমিক অবস্থানই ছিল তার মর্যাদার মাপকাঠি।

আদি-মধ্যযুগের ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পেশা ও প্রশাসনিক ক্ষমতাভিত্তিক বহু উপাধির জন্ম হয়েছে, যাদের কোনো নির্দিষ্ট বর্ণ বা জাতি হিসেবে সংগঠিত করা যায় না। উত্তর ভারতের মহত্তর, পশ্চিম ভারতের পট্টকিল, দাক্ষিণাত্যে গাবুন্ডা প্রভৃতি কোনো একক জাতি নয়। মধ্যযুগের গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতাধারী এই সকল গোষ্ঠী যথেষ্ট ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন। এদের উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমানের মেহতা, মাহাথা, মালহোত্র, মেহরোত্রা কিংবা পটেল, পাতিল অথবা কর্ণাটকের গৌড়া, দেবগৌড়া প্রমুখকে অভিন্ন জাতি-বর্ণের অন্তর্ভুক্ত শ্রেণি হিসেবে দেখা যায় না। অধ্যাপক শর্মার মতে, গ্রামীণ বন্দোবস্তে এই সম্পদশালী শ্রেণিকে গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগে জাতিবর্ণনির্বিশেষে দেখা গেছে।

আদি-মধ্যযুগে ভূমিদান ব্যবস্থার ব্যাপকতার সূত্রে নতুন বৃত্তিজীবী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। ব্রাহ্মণ ও কর্মচারীদের ভূমিস্বত্বদানের সঙ্গে সঙ্গে জমির রাজস্ব নির্ধারণ, কৃষক নিয়োগ, ভূমিস্বত্বাধিকারীর নথি রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি কাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই কাজ সম্পাদনের জন্য করণিক এবং নথিরক্ষক নামক কর্মচারী নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়ে। এর থেকেই লিপিকর বা কায়হ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। সপ্তম থেকে দশম শতকে জমির স্বত্ব এবং সীমানা-সংক্রান্ত বিতর্ক ক্রমে বৃদ্ধি পায়। এই বিতর্কের সমাধানের জন্য নথিপত্রের সাক্ষ্য খুব জরুরি অনুভূত হয়। ফলে সমাজে কায়স্থ বা লিপিকরদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ক্রমে কায়স্থরা ভারতের সমাজব্যবস্থা ও জাতিপ্রথার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ক্রমে এই নথিকারশ্রেণি কায়স্থ ছাড়াও করণ, পুস্তপাল, চিত্রগুপ্ত, লেখক, অক্ষপটালিক, অক্ষপটলাধিকৃত ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত হন। বিহার ও উত্তরপ্রদেশে ‘অথোরী’ উপাধি প্রচলন আছে। ‘অক্ষর’ থেকে এই উপাধির সৃষ্টি অর্থাৎ অক্ষরজীবী লিপিকররা ‘অর্থৌরী’ উপাধি পেয়েছেন। আবার এই শ্রেণিই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার করণ উপাধি ভোগ করেন। এঁরা সবাই কায়স্থ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রচলিত বর্ণব্যবস্থায় এঁদের স্থান নির্ণয় কিছুটা কঠিন। প্রথমদিকে শিক্ষিত ব্রাহ্মণরাই কায়স্থ বা লিপিকর হিসেবে নিযুক্ত হতেন। ক্রমে বিভিন্ন বর্ণ থেকে লিপিকররা নিযুক্ত হতে থাকেন। কায়স্থ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মানুষেরা সামাজিক ক্ষেত্রে ক্রমশ একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করেন এবং এই নতুন সম্প্রদায়ের মধ্যেই সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়। স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে কায়স্থদের উৎপত্তি বা প্রচলিত বর্ণব্যবস্থায় তাদের স্থান সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। সম্প্রতি উচ্চ বিচারালয় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রাহ্মণ ও শূদ্র উভয় বর্ণের অস্তিত্ব আছে বলে রায় দিয়েছে।

প্রচলিত বর্ণব্যবস্থায় কায়স্থদের স্থান কোথায়—সে প্রসঙ্গে স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে কোনো উল্লেখ নেই। দ্বাদশ শতক বা পরবর্তীকালের কোনো কোনো রচনায় কায়স্থদের প্রজাপীড়ক ও অন্যায় কর্মের সমর্থক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’ এবং ‘যাজ্ঞবল্কস্মৃতি’ (১৪ শতক) গ্রন্থে কায়স্থদের নানাভাবে দোষারোপ ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে। অধ্যাপক রামশরণ শর্মার মতে, বৃত্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই ব্রাহ্মণদের গ্রন্থগুলিতে কায়স্থদের দোষারোপ করার প্রয়াস দেখা যায়। কারণ ইতিপূর্বে শিক্ষিতগোষ্ঠী হিসেবে ব্রাহ্মণরাই ভূমিদান-সংক্রান্ত নথি রক্ষণাবেক্ষণ করত। এখন কায়স্থদের উত্থান ব্রাহ্মণদের দীর্ঘ অধিকারে ব্যাঘাত ঘটায় এবং কায়স্থদের রক্ষা করা নথিপত্র বহুক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের বেআইনি ভূমি ভোগদখলের পথে বাধা সৃষ্টি করত। সে কারণে ব্রাহ্মণরা কায়স্থদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল এবং ব্রাহ্মণদের পুঁথিগুলিতে কায়স্থদের বর্ণগত অবস্থান সম্পর্কে নীরবতা দেখানো হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে এলাহাবাদ ও কোলকাতা হাইকোর্ট কায়স্থদের যথাক্রমে ব্রাহ্মণ ও শূদ্রবর্ণের অন্তর্ভুক্ত বলে মতপ্রকাশ করেছে।

আদি-মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বৈশ্যদের অবনমন এবং শূদ্রদের উত্থান। ফলে উভয় বর্ণ এক সমান্তরাল রেখায় অবস্থান করতে শুরু করে। আরবীয় পণ্ডিত আলবেরুণীর মতে, সেকালে বৈশ্য ও শূদ্রদের মধ্যে বিশেষ তফাত ছিল না। তারা একই এলাকায় মিলেমিশে বসবাস করত। স্কন্দপুরাণ এর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, কলিযুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের পতন ঘটেছিল। ড. শর্মার মতে, একাদশ শতক থেকে বৈশ্যরা প্রথাগত ও আইনত দিক থেকে শুদ্র হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, বাংলায় সেনবংশের রাজত্বকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের পতনের ফলে বাণিজ্যজীবীদের অবস্থা সঙ্গিন হয়েছিল। পরিণামে সুবর্ণবণিক, তৈলকার, স্বর্ণকার, কর্মকার, কৈবর্ত, সূত্রধর প্রমুখ সৎ শূদ্র পদ থেকে অবনমিত হয়েছিলেন।

অন্যদিকে একই সময়ে (সপ্তম-একাদশ শতক) শূদ্রদের সামাজিক অবস্থান ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল। এখন তারা কেবল কৃষিশ্রমিক বা দাসমাত্র ছিল না। শূদ্ররা এখন কৃষিজীবী শ্রেণি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। ‘স্কন্দপুরাণ’ গ্রন্থে শূদ্রদের অন্নদানকারী (অন্নদ) ও গৃহপতি বলা হয়েছে। হিউয়েন সাঙ-ও শুদ্রদের কৃষিজীবী বলে উল্লেখ করেছেন। এইভাবে আদি-মধ্যযুগে শুদ্র ও বৈশ্যদের মধ্যে তফাতটা প্রায় মুছে যায়। সমাজে সম্পদ সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ী, কারিগর ও শ্রমজীবী মানুষ একই বর্ণভুক্ত হিসেবে পরিগণিত হয়। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক শর্মা বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের সাথে অবশিষ্ট ভারতের, বিশেষত উত্তর ভারতের সামাজিক চরিত্রের প্রভেদ ও তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। সপ্তম শতক ও পরবর্তীকালে বাংলা ও দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদের অগ্রগতি ঘটেছিল। কিন্তু এই দুটি অঞ্চল কদাপি বিদেশি জাতি দ্বারা গুরুতর আকারে আক্রান্ত হয়নি। ফলে এই সকল অঞ্চলে স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীর নেতারাই ক্ষত্রিয়রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। এদের মধ্যে উপজাতীয় উপাদান ছিল প্রবল। শূদ্ররা ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। এহেন মেরুকরণ এবং মধ্যবর্তী গোষ্ঠীর অভাব এই সকল এলাকায় কৃষি সম্পর্কে জটিলতার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু অবশিষ্ট ভারতে রাজপুত জাতির উদ্ভব এবং ক্ষত্রিয় হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠা সামাজিক ক্ষেত্রে ভেদাভেদের সীমারেখা কিছুটা শিথিল করেছিল। তাই উত্তর ভারতে ক্ষত্রিয় ও বৈশাদের অধীনে অনেক জাতি সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু বাংলা ও দক্ষিণ ভারতে দুই মেরুতে অবস্থান করছিল ব্রাহ্মণ ও শূদ্ররা। এই অঞ্চলে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সুপ্রতিষ্ঠিত বর্ণসম্প্রদায় ছিল না। ব্রাহ্মণদের সংখ্যা শূদ্রদের তুলনায় ছিল কম। মূলত ভূমিকেন্দ্রিক একটি সম্প্রদায় হিসেবে ব্রাহ্মণরা বিবেচিত হত। কৃষক, কারিগর ও আদি-উপজাতীয় মানুষেরা শূদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’ ও বৃহৎধর্মপুরাণ’ সাহিত্যে সৎ-শূদ্র ও অসৎ-শূদ্র হিসেবে প্রায় পঞ্চাশটি জাতির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণসহ ছত্রিশটি প্রচলিত জাতির পাশাপাশি বাংলা ও দক্ষিণ ভারতে সৎ ও অসৎ-শূদ্র হিসেবে অসংখ্য জাতির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ উল্লিখিত সৎ শূদ্র জাতির অন্যতম ছিল—গোয়ালা, নাপিত, মোদক, তাম্বুলি, মালাকার, কংসকার, কর্মকার, শঙ্খকার ইত্যাদি। প্রাথমিকভাবে স্বর্ণকাররাও সৎশূদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পরে এঁদের ‘পতিত’ জাতিরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিশ্র-শূদ্র’ জাতি হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়—স্বর্ণকার, স্বর্ণবণিক, রাজমিস্ত্রি, চিত্রকরণ, সূত্রধর, তেলি, শিকারি, কুস্তিগির, সেট, চর্মকার, মাংসবিক্রেতা, কোল, চণ্ডাল, হাড়ি, ডোম, যুগি, কৈবর্ত, রজক, ধীবর, তস্কর ইত্যাদি। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ এদের ‘অসৎশূদ্র’ অভিধা দেওয়া হয়নি, তবে ‘পতিত’ বা ‘অধম’ বলে চিত্রায়িত করা হয়েছে। অধম বা পতিত বলতে সাধারণভাবে ‘অসৎ’ অভিধাটিকেই বোঝানো হয়েছে বলে অনুমান করা যায়।

‘বৃহৎধর্মপুরাণে’ শূদ্রদের সৎ-শূদ্র ও মিশ্রজাতি—এই দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। মিশ্রজাতিভুক্তদের পতিত বা অসৎ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের আবার উত্তম, মধ্যম ও অন্ত্যজ—এই ত্রিস্তর বিভাজন করা হয়েছে। তিনটি স্তরে বিন্যস্ত মিশ্রজাতিভুক্তদের সংখ্যা চল্লিশ। ‘ব্রহ্মবৈবর্ত’ এবং বৃহৎধর্ম’ পুরাণ দুটিতে অনেকগুলি জাতির মিল আছে। যাইহোক, আলবেরুণীর দেওয়া নতুন জাতিনামের সাথে পুরাণদ্বয়ের নামের সম্মিলিত সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি। জ্যোতিরিশ্বর কবিশেখর বিরচিত ‘বর্ণরত্নাকর’ গ্রন্থের মতে, এই সময় নীচু বা অস্পৃশ্য জাতির দ্রুত বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রামশরণ শর্মা বলেছেন যে, গুপ্ত-পরবর্তী যুগে বহু স্থানীয় উপজাতি ব্রাহ্মণ্যকরণ ব্যবস্থার মধ্যে গৃহীত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে কোনো কোনো জাতি কৃষিকাজে যুক্ত ছিল, কিন্তু আধুনিক কৃষিকর্ম অনুসরণ করে অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর বিষয়ে তাদের অনীহা ছিল। এই সকল জাতিকে ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থার বাইরে রাখার জন্য অস্পৃশ্য আখ্যা দেওয়া হত। দ্বিতীয়ত, কিছু উপজাতি ব্রাহ্মণ্যকরণের পথে বাধার সৃষ্টি করত। এদেরও একইভাবে গ্রাম-সমাজের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পালরাজাদের বিরুদ্ধে কৈবর্ত বিদ্রোহকে এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা যায়।

অধ্যাপক শৰ্মা আদি-মধ্যযুগকে ‘জাতিবিস্তার’ ও ‘খণ্ডবিচ্ছিন্নতার যুগ’ বলে উল্লেখ করেছেন। আলোচ্যকালে প্রচলিত চতুর্বর্ণব্যবস্থার মধ্যে বহু জাতি ও উপজাতির জন্ম হয়েছিল। বিভিন্ন তাম্রশাসন (ভূমিদানপত্র) ব্যাখ্যা করে ড. চিত্ররেখা গুপ্ত তাঁর The Brahmans of India…’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে ১৯৪টি গোত্রের উল্লেখ করেছেন। অগ্রহার দান পাওয়ার কারণে ব্রাহ্মণশ্রেণি দূরদূরান্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এক্ষেত্রে তারা পরিচিত হত তাদের গোত্র দ্বারা। গোত্রে পূর্বপুরুষদের নাম-গোত্রের পরিচয় হিসেবে ব্যবহৃত হত। ব্রাহ্মণদের পরিযানের (Migration) ফলে নতুন নতুন অঞ্চলে তাদের বাসস্থান গড়ে ওঠে। পরিবার, পূর্বপুরুষ এবং অঞ্চলের সমন্বয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন জাতিগত পরিচয় গড়ে ওঠে। গবেষিকা পুষ্প নিয়োগী তাঁর ‘Brahmanic Settlement’ শীর্ষক প্রবন্ধে রাঢ় বাংলায় ৫৬টি ব্রাহ্মণবর্ণভুক্ত উপজাতির উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে পরিচিতির মূল ভিত্তি হল তার আদি গ্রামের নাম। কায়স্থদের মধ্যেও বাসস্থানের ভিত্তিতে একাধিক উপজাতিতে বিভক্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। দেশভেদ অনুযায়ী ব্রাহ্মণ-সহ বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে জাতির সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টি ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও স্বীকার করা হয়েছে। এখানে শতাধিক জাতির অস্তিত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। আবার অষ্টম শতকে রচিত বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণ-এ বলা হয়েছে যে, বৈশ্য নারী ও নীচু জাতের পুরুষের সম্পর্কের সূত্রে হাজার হাজার মিশ্র জাতির উদ্ভব আদি-মধ্যযুগে ঘটেছিল।

রাজপুত জাতির সৃষ্টি জাতিবিস্তারের কাজকে ত্বরান্বিত করেছিল। চালুক্য, চান্দেল্ল প্রমুখ সূর্য ও চন্দ্রবংশ সম্ভৃত রাজপুত ক্ষত্রিয় ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিদেশি জাতিগুলির ভারতে অনুপ্রবেশ ও এদেশীয় সমাজের অঙ্গীভূত হওয়ার সূত্রে রাজপুতদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। হন, গুর্জর প্রভৃতি জাতির ভারতীয় বংশধররা রাজপুত নামাঙ্কিত হয়ে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার অঙ্গীভূত হলে জাতির সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। সোলাঙ্কি, চৌহান, তোমর, গাহড়বাল প্রমুখ রাজপুত জাতি ক্ষত্রিয় হিসেবেই ভারতীয় বর্ণব্যবস্থায় জাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করে।

বর্ণভেদ ও জাতিভেদ ব্যবস্থা প্রাচীন যুগের ভারতীয় সমাজে শোষণ-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে সক্রিয় ছিল বলে বার বার আলোচনা হয়েছে। এই অসহনীয় সামাজিক ব্যবস্থার ফলে সর্বাধিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছিল নিম্নশ্রেণির মানুষ। তাই বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধর্মমত প্রাচীনযুগে কিংবা ভক্তিবাদ মধ্যযুগে সমাজের এই বিশেষ অংশের সমর্থনে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অসংখ্য নতুন ধর্মসম্প্রদায় ভারতীয় সমাজে জাতিভেদ ব্যবস্থাকেই পুষ্ট করেছে। রামশরণ শর্মা লিখেছেন যে, “জন্মগত সুযোগ-সুবিধা এবং জাতিভেদ দূর করার জন্য যে ধর্মীয় সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছিল, তারাই আবার বর্ণব্যবস্থার শিকার হয়েছে।” একে তিনি ‘ইতিহাসের পরিহাস’ বলে উল্লেখ করেছেন। সপ্তম শতকের মধ্যেই বৌদ্ধরা আঠারোটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। কর্ণাটকে আদি-মধ্যযুগে জৈনদের মধ্যে সাতটি পৃথক সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা যায়। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামীদের মধ্যেও সম্প্রদায়গত জাতিভেদ দেখা যায়। গুরু-কেন্দ্রিক এক একটি ধর্মসম্প্রদায় নিজেদের গুরুর পরিচয়কে ভিত্তি করে পৃথক পৃথক জাতি হিসেবে পরিচিতি পায়, যেমন— কর্ণাটকে লিঙ্গায়েত ও বীর শৈব কিংবা উত্তর ভারতে রাধাস্বামীন সম্প্রদায় স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিচিত হয়েছে।