সূচনা: ভারতের ইতিহাস রচয়িতা উপযােগবাদী দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য ছিলেন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রনীতিবিদ জেমস মিল (১৭৭৩-১৮৩৬ খ্রি.)।

[1] ভারতের ইতিহাস রচনা: স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা জেমস মিল লন্ডনে অবস্থানকালে উপযােগবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা জেরেমি বেন্থামের দর্শনের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হন। কখনও ভারতে না এসেও বিভিন্ন তথ্য, মহফেজখানার নথিপত্র প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে তিনি ভারতে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিষয়ে ‘দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর মতে, একজন যােগ্য ব্যক্তি সারাজীবন ভারতে বসবাস করে ভারত সম্পর্কে যে জ্ঞানার্জন করতে পারবে, ইংল্যান্ডের একটি ছােটো ঘরে মাত্র এক বছর চর্চা করে ভারত সম্পর্কে আরও বেশি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব।

[2] দৃষ্টিভঙ্গি: ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তিন খণ্ডে প্রকাশিত দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া গ্রন্থে জেমস মিল সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের ইতিহাস রচনা করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি ভারতের হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে পশ্চাৎপদ ও নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করে এর তীব্র সমালােচনা করেছেন। তিনি ভারতীয় সমস্যাকে তিনটি শাখায় বিভক্ত করেছেন, যথা一

  • [i] সরকারের রূপ, 

  • [ii] আইনের প্রকৃতি, 

  • [iii] কর-ব্যবস্থা।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই তিনটি বিভাগের সংস্কার করলে ভারতীয় সমাজের উন্নয়ন সম্ভব হবে।

[3] যুগ বিভাজন: ঐতিহাসিক জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করেছেন। যথা—

  • [i] হিন্দু যুগ, 

  • [ii] মুসলিম যুগ ও 

  • [iii] ব্রিটিশ যুগ। 

এই তিনটি যুগের সভ্যতাকে তিনি যথাক্রমে হিন্দু সভ্যতা, মুসলিম সভ্যতা ও ব্রিটিশ সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন।

[4] ভারতীয় সভ্যতার পশ্চাদগামিতা: জেমস মিলের কাছে প্রাচীন ভারত তথা প্রাচ্যের সকল সভ্যতাই পশ্চাৎপদ বলে মনে হয়েছিল। তার মতে, ভারতীয় সমাজ ছিল অত্যন্ত পিছিয়ে-পড়া, এমনকি ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক যুগের চেয়েও নিম্নমানের। জেমস মিল মনে করতেন যে, অষ্টাদশ শতকে ভারতীয়দের দুর্দশা আসলে তাদের অতীত দুর্দশারই স্বাভাবিক পরিণতি। এভাবে মিল ভারতীয়দের বর্তমান দুরাবস্থার জন্য অতীতকে দায়ী করে ব্রিটিশ শাসনকে দায়মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন।

[5] ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থন: জেমস মিলের মতে, ব্রিটিশরা উন্নত সভ্যতার অধিকারী বলে তাদের শাসনাধীনে ভারতীয় সভ্যতারও উন্নতি ঘটবে। মিল মনে করতেন যে, ভারতীয় সভ্যতা ব্রিটিশদের চেয়ে উন্নততর হলে ব্রিটিশ জাতির ওপর ভারতীয়দের শাসনও যুক্তিসংগত হত। জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সমসাময়িক সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিনিধিমূলক ছিল।

[6] ব্রিটিশ শাসনের প্রয়ােজনীয়তা: জেমস মিল মনে করতেন যে, ভারতে স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসনের প্রসার খুবই জরুরি। ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা দানের কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে ইউরােপীয় জ্ঞান, শিল্প, রীতিনীতি প্রভৃতি ভারতীয়দের মধ্যে ছড়ালে ‘অর্ধসভ্য ভারতীয়রা সভ্য হয়ে উঠবে। তারা যত সভ্য হবে ততই সুখী’ হয়ে উঠবে।

[7] জোনসের দৃষ্টিভঙ্গির বিরােধিতা: ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম জোনস মনে করতেন যে, ভারতের পৌরাণিক ও কল্পকাহিনি থেকে এদেশের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব। প্রাচ্যদেশীয় গ্রন্থগুলি অনুবাদের দ্বারা ইউরােপীয় সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হতে পারে। কিন্তু মিল জোন্সের দৃষ্টিভঙ্গির বিরােধিতা করে জোন্সের দৃষ্টিভঙ্গিকে রক্ষণশীল আখ্যা দেন।

জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা: নােবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-সহ বিভিন্ন আধুনিক কালের বিভিন্ন ভারতীয় ঐতিহাসিক ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালােচনা করেছেন। 

  • [i] ভ্রান্ত যুগ বিভাজন: ভারতীয় ইতিহাসের যুগ বিভাজনে মিলের দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত। কারণ, প্রাচীন যুগে ভারতে হিন্দু ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। তেমনি মধ্যযুগে ভারতে মুসলিমদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মধ্যেও দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন হিন্দু এবং হিন্দুদের বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজত্বের অস্তিত্বও ছিল। আধুনিক যুগে ভারতে ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশের বৃহত্তর জনগােষ্ঠী ছিল হিন্দু ও মুসলিম।

  • [ii] জাতিবিদ্বেষী মনােভাব: জাতিবিদ্বেষের সমর্থক জেমস মিল ব্রিটিশ সভ্যতাকে উন্নত হিসেবে বিচার করে ভারতীয় সভ্যতাকে ঘৃণার চোখে দেখে কুরুচির পরিচয় বহন করেছেন।

  • [iii] শাসক ও শাসিতের ব্যবধান: মিলের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে শাসক ও শাসিতের মধ্যে ব্যবধান ও বিভেদের বীজ রােপিত হয়েছে।