ভূমিকা: প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বের সব দেশেই শাসন পরিচালনায় সংসদীয় প্রশ্নোত্তর পর্ব সংসদীয় নজরদারির অন্যতম উপায় বলে বিবেচিত হয়। এই পর্বে সরকার জনস্বার্থে এবং দেশের স্বার্থে পার্লামেন্টের সামনে সবরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হয়। ফলে জনগণ এই পর্বের মাধ্যমে সংসদের সকল ক্ষেত্র সম্পর্কে জানতে পারে। সংসদের সদস্যরা জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ের তথ্যসমূহ সরকারের মন্ত্রীদের কাছ থেকে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অবগত হন এবং জনগণকে অবহিত করেন। এই সম্পর্কে মন্ত্রীগণ সমস্ত তথ্যের বিবরণ জানাতে বাধ্য থাকেন। এই কারণেই একজন সাংসদের প্রাথমিক দায়িত্ব হল জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের সমস্ত কার্যাবলি সম্পর্কে অবগত থাকা।
ভারতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বের সংজ্ঞা
সংসদের উভয়কক্ষে অর্থাৎ উচ্চ কক্ষরূপে পরিচিত রাজ্যসভা এবং নিম্নকক্ষরূপে পরিচিত লােকসভায় প্রত্যেক দিনের অধিবেশন বসার প্রথম এক ঘণ্টা সময় প্রশ্ন উত্থাপন ও উত্তর প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকে। একেই প্রশ্নোত্তর পর্ব বলা হয়।
এই পর্বে ভারত সরকার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়গুলি উত্থাপন করা হয়। যে-কোনাে পরিস্থিতিতে এবং জনগণের অভিযােগ এবং বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে এই প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারকে অবগত করা হয় এবং সরকারের হস্তক্ষেপও প্রার্থনা করা হয়। এর পাশাপাশি লক্ষ করা যায় যে, বিভিন্ন মন্ত্রীদের নিজ নিজ দপ্তরের বিষয়ে যে দুর্বলতা বা দোষ-ত্রুটি রয়েছে সে সম্পর্কেও বিভিন্ন সদস্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে জর্জরিত করে তােলেন।
সংসদের সর্বাধিক আকর্ষণীয় অংশ হল এই প্রশ্নোত্তর পর্ব। এই পর্বে জনগণ থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যম এবং সংসদের সদস্যদের মধ্যে এক প্রবল উৎসাহ লক্ষ করা যায়। বিরােধীদলের সদস্যরা বিভিন্ন বুদ্ধিসম্পন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করে কিন্তু সরকার পক্ষের সদস্যরাও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেইসকল প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তর দিয়ে প্রশ্ন উত্তর পর্ব আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তােলেন।
ভারতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বের উদ্দেশ্য
প্রশ্নোত্তর পর্বের মূলত তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে, যথা- (1) তথ্যসংগ্রহ করা, (2) জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে বাস্তব অবস্থার প্রকাশ ঘটানাে, (3) সরকার কর্তৃক ঘােষিত অথবা সংসদ কর্তৃক অনুমােদিত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক নীতিসমূহের সঠিক প্রয়ােগ হচ্ছে কি না সে সম্পর্কে সংসদকে তথা জনগণকে জানানাে।
ভারতীয় সংসদে প্রশ্নের শ্রেণিবিভাগ
পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে সাধারণত মন্ত্রীদের উদ্দেশেই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। এইসকল প্রশ্নকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়一
(1) তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন: সংসদ-কক্ষেই এইসকল প্রশ্নের উত্তর মৌখিকভাবে দিতে হয়। সদস্যরা এইসকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই প্রশ্ন সম্পর্কিত অতিরিক্ত প্রশ্নের অবতারণা করতে পারেন। এই ধরনের প্রশ্নের ক্ষেত্রে তারকা চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
(2) তারকাবিহীন প্রশ্ন: এইসকল প্রশ্নের উত্তর লিখিত আকারে সংশ্লিষ্ট সদস্যকে জানাতে হয়, এখানে মৌখিকভাবে উত্তর দেওয়া যায় না। এইসকল প্রশ্নের সঙ্গে অতিরিক্ত প্রশ্ন যুক্ত করা যায় না।
(3) স্বল্প-বিজ্ঞাপিত প্রশ্ন: জনস্বার্থ সম্পর্কিত জরুরি বিষয়ে স্বল্প- বিজ্ঞাপিত প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। এই ধরনের প্রশ্ন দশ দিনের থেকে কম সময়ের মধ্যে উত্থাপন করা যায়।
সাংসদরা নিজের চাহিদা মতো যে-কোনো সময়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন না, তাদেরকে প্রশ্ন উত্থাপন করার আগে লােকসভা বা রাজ্যসভার সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে সেই প্রশ্ন সম্পর্কিত বিষয় জানিয়ে নােটিশ দিতে হয়।
ভারতীয় সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন পদ্ধতি
কোনাে নির্দিষ্ট দিনে যে সদস্যদের প্রশ্ন তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন রূপে নথিভুক্ত হয়েছে স্পিকার অথবা ক্ষেত্রবিশেষে চেয়ারম্যান ওই সদস্যদেরকে প্রশ্ন উত্থাপন করার জন্য আহ্বান করেন। প্রথমে সংশ্লিষ্ট সদস্য নিজস্ব স্থানে উঠে দাঁড়িয়ে সংসদের কার্যসূচিতে উল্লিখিত তার প্রশ্নের ক্রমিক সংখ্যাটি পাঠ করেন। এক্ষেত্রে প্রশ্নের বিষয়বস্তু পাঠ করতে হয় না। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী শুধু সেই প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে কোনাে প্রশ্ন বা উত্তর সম্পর্কে তর্কবিতর্ক করা যায় না। তবে নির্দিষ্ট সদস্য সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে অনধিক ২টি অতিরিক্ত প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। এরপর স্পিকার প্রয়ােজন মনে করলে সরকার পক্ষ ও বিরােধী পক্ষ উভয়ের পক্ষ থেকে একজন করে সদস্যকে একটি করে অতিরিক্ত প্রশ্ন (সংশ্লিষ্ট বিষয়ে) উত্থাপন করার জন্য আহ্বান করতে পারেন। এর পাশাপাশি প্রশ্নোত্তর পর্বের এই অল্প সময়ের মধ্যেও বেশ কিছু তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন যাতে উত্থাপন করা যায় তাও স্পিকারকে নিশ্চিত করতে হয়। একটি তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের উত্তরের নির্দিষ্ট সময়সীমা ৮ মিনিট ধার্য করা হয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রশ্নোত্তর পর্বে আলােচনার জন্য সর্বাধিক ২০টি প্রশ্নকে নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু এই এক ঘণ্টার মধ্যে সকল প্রশ্ন উত্থাপন করা সম্ভব হয় না বলেই বাকি প্রশ্নগুলির উত্তর প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা লিখিত আকারে সংসদের টেবিলে গিয়ে জমা দেন। এর সঙ্গে তারকাবিহীন প্রশ্নের লিখিত উত্তরগুলিও প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে সংসদের টেবিলে মন্ত্রীগণ কর্তৃক রক্ষিত থাকে।
স্বল্প-বিজ্ঞাপিত প্রশ্নের উত্থাপন পদ্ধতি: জরুরি জনস্বার্থ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দশ দিনের কম সময়ের নােটিশে এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। তবে কেন এত কম সময়ের মধ্যে প্রশ্নটি উত্থাপন করা হচ্ছে তা সংক্ষেপে স্পিকারকে জানাতে হয়। স্পিকার যদি মনে করেন প্রশ্নটি জরুরি ভিত্তিতে উত্থাপন করা উচিত তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে এত কম সময়ের মধ্যে তিনি প্রশ্নটির উত্তর দিতে সক্ষম কি না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী রাজি হলে তার নির্দেশিত দিনে প্রশ্নটি উত্থাপনের জন্য নথিভুক্ত করা হয়, আর যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী অরাজি হন এবং স্পিকারের কাছে প্রশ্নটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় তাহলে স্পিকার কোনাে একটি নির্দিষ্ট দিনে নথিভুক্ত প্রশ্নের সূচিতে প্রথমেই প্রশ্নটিকে নথিভুক্তকরণের আদেশ দিতে পারেন। কোনাে নির্দিষ্ট দিনে প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে ওই দিনের জন্য নির্ধারিত স্বল্প-বিজ্ঞাপিত প্রশ্নের উত্থাপন করা হয়। মৌখিকভাবে মন্ত্রী কর্তৃক এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর পার্লামেন্টে প্রদত্ত হয়।
মন্ত্রী ব্যতীত অন্যান্য সদস্যদের প্রতি প্রশ্ন উত্থাপন: কোনাে বিল, সিদ্ধান্ত অথবা পার্লামেন্টের কার্যাবলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো বিষয়ে যুক্ত কোনাে সদস্যের (মন্ত্রী-ব্যতীত) প্রতি একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। এই ধরনের প্রশ্ন খুব কমক্ষেত্রে লােকসভায় উত্থাপন করা যায়। কিন্তু সংসদের যৌথ অধিবেশনে উত্থাপন করা যায় না। এই ধরনের প্রশ্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অতিরিক্ত প্রশ্ বা কোনাে স্বল্প-বিজ্ঞাপিত প্রশ্নও করা যায় না।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আলােচিত বিষয়ে পুনরালোচনা: প্রশ্নোত্তর পর্বে আলােচিত বিষয়গুলি সংসদে পুনরায় আলােচনার যােগ্য। দিনের শেষে পুনরায় প্রশ্ন গুলি আলােচনা করার জন্য ৩০ মিনিট সময় নির্ধারিত হয়। তবে সােমবার, বুধবার, শুক্রবার ছাড়া এই আলােচনা করা যায় না।
রাজ্যসভায় আলােচনার সময়সীমা: রাজ্যসভায় সাধারণত এই বিষয়গুলি আলােচনার জন্য রাজ্যসভার সভাপতি অর্থাৎ চেয়ারম্যান কর্তৃক নির্ধারিত দিনে বিকেল ৫ টা থেকে ৫.৩০ পর্যন্ত সময় নির্ধারিত হয়। তবে এই ধরনের আলােচনার বিষয়বস্তু যথাযথ জনস্বার্থের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া আবশ্যক।
যদি কোনাে সদস্য এই ধরনের আলোচনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন তাহলে তাকে কমপক্ষে ৩ দিন আগে নোটিশ দিতে হয় এবং সদস্যকে অবশ্যই নােটিশে আলােচনার নির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করতে হয়। এক্ষেত্রে এক দিনে একটির বেশি নােটিশ আলােচনার জন্য গ্রহণ করা হয় না। এক জন সদস্য সপ্তাহে এক দিন আলােচনার জন্য নােটিশ দিতে পারেন এবং কোনাে সদস্য একই অধিবেশনে দুটির বেশি নােটিশ আলােচনার জন্য জমা দিতে পারেন না।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, এই প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে একদিকে সরকার জনগণের সমস্যা, অভাব-অভিযােগ এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানতে পারে এবং অপরদিকে সরকারও তাদের নীতি, বিভিন্ন বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ এবং শাসন পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তােলে। প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য আদানপ্রদান করা প্রধান উদ্দেশ্য হলেও সরকারকে সঠিক পথে চালিত করার জন্য ভারতের সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বের গুরুত্বকে কখনােই অস্বীকার করা যায় না।
Leave a comment