(১) বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা:
সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিগুলির ৪৫নং ধারায় উল্লেখ আছে যে, সংবিধান প্রচলন হওয়ার দিন থেকে ১০ বছরের মধ্যে রাষ্ট্র ১৪ বছর বয়সের সকল ছেলেমেয়ের জন্য শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করবে। এখানে রাষ্ট্র বলতে বােঝায় (ধারা-১২) কেন্দ্রীয় সরকার ও আইনসভা, রাজ্য সরকার ও বিধানসভা ও ভারত সরকারের শাসনাধীন আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ। উল্লিখিত ধারায় যে অসঙ্গতি লক্ষ করা যায় তা হল বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক প্রাসঙ্গিক শিক্ষা বিষয়ে পরিবারের ভূমিকার কথা বলা হয়নি। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা ও অভিভাবকের সদর্থক ভূমিকার কথাও উল্লিখিত হওয়ার প্রয়ােজন ছিল।
(২) সংখ্যালঘুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার অধিকার:
মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে সংবিধানের ৩০(১) নং ধারায় বলা হয়েছে, সমস্ত ধর্মগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের নিজেদের ইচ্ছামতাে বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার অধিকার থাকবে এবং ৩০(২) নং ধারায় বলা। হয়েছে, ধর্ম ও ভাষার দিক থেকে সংখ্যালঘু— এই অজুহাতে রাষ্ট্র সাহায্যদানে কোনাে বৈষম্য করবে না।
মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে সংবিধানের ৩০নং ধারা শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার বিশেষত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্থাপন ও পরিচালনা বিষয়ে রক্ষাকবচ প্রদান করেছে ঠিকই কিন্তু জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়মূলক চরিত্র বজায় রাখা বা জাতীয় শিক্ষার গুণগত উৎকর্তা সাধনের পক্ষে তা পরিপন্থী। তবে সংবিধান রচনার সময়কালের কথা বিবেচনায় রাখলে এটা সহজেই অনুমেয় যে, সেসময়ে সকলকে শিক্ষার আঙিনায় আনার জন্য যতসংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপন করার প্রয়ােজন ছিল, তা তৎকালীন কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলির পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে সংবিধানের ৩০নং ধারাটি খুবই যুক্তিযুক্ত, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এ বিষয়ে ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
(৩) সমাজে দুর্বলতর শ্রেণির শিক্ষা:
ভারতীয় সংবিধানের ৪৬নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র ভারতের দুর্বলতর শ্রেণির বিশেষত তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি শ্রেণির শিক্ষা ও আর্থিক স্বার্থে যাবতীয় উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করবে ও তাদের সকলপ্রকার সামাজিক অবিচার ও শোষণ থেকে রক্ষা করবে।
অনগ্রসর শ্রেণির উন্নয়ন ও তাদেরকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য সংবিধানে এই নির্দেশিকা থাকলেও বাস্তবক্ষেত্রে তার যে যথাযথ প্রয়ােগ ঘটেনি, তা পরবর্তীকালে অনুন্নত শ্রেণির উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ বিশেষত কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬), National Education Policy (1986) ও UN Dhebar কমিশনের সুপারিশই তার প্রমাণ। এই প্রেক্ষাপটে এটা মনে হওয়াই সমীচীন যে, অনগ্রসর শ্রেণির উন্নয়নকল্পে সংবিধানের নির্দেশিকা আরও জোরালাে ও সময়নির্ভর হওয়া উচিত ছিল।
(৪) শিক্ষায়তনে আসন সংরক্ষণ:
রাষ্ট্র তপশিলি জাতি ও উপজাতি এবং সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে অনুন্নত শ্রেণির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে (১৫(৪) ধারা)। শিক্ষায়তনে ভরতির ক্ষেত্রে এইরকম বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে পারে [২৯(খ) ধারা]। সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকা সত্ত্বেও এবং তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ সত্ত্বেও এদের শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন সাফল্য আসেনি। তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের মধ্যেও শ্রেণিবৈষম্য আছে। যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তারাই সুযােগ সুবিধা পাচ্ছেন, কিন্তু প্রকৃত প্রয়ােজন যাদের, তাদের কাছে সাহায্য পৌছােয় না । প্রকৃত সমস্যা হল আর্থিক। অর্থাৎ আর্থিক পশ্চাৎপদতাই অনগ্রসর শ্রেণির শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার কারণ, আর সামাজিক অনঅগ্রসরতা আর্থিক পশ্চাৎপদতার থেকেই সৃষ্টি হয়। তবে এটা মনে রাখা প্রয়ােজন যে, শিক্ষায়তন-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থা অনন্তকাল চলতে পারে না। পিছিয়ে থাকা মানুষদের বিশেষ সুযােগ দিয়ে সমাজের মূলস্রোতে দ্রুত মিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ব্যাপারে সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে নির্দেশিকা আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়ােজন।
(৫) ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা:
সংবিধানের ২৮(১) নং ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি অনুদানে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হবে না। আবার সংবিধানের ২৮(৩) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র অনুমােদিত বা অর্থ সাহায্যে পরিচালিত কোনাে প্রতিষ্ঠান যদি ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা করে বা পূজার ব্যবস্থা করে, তাহলে সেখানে পাঠরত শিক্ষার্থীকে তার অথবা নাবালকের ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে বাধ্য করা যাবে না।
বর্তমানে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে সামাজিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য শারীরশিক্ষা (Physical Education), প্রাণায়াম ও যোগশিক্ষার (Yoga Education) অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। প্রাণায়াম ও যােগশিক্ষার অনেকাংশই হিন্দুশাস্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত। এরকম অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত ধনাত্মক ধারণাবিশিষ্ট অংশ, যা বিদ্যালয় শিক্ষার পক্ষে অপরিহার্যতার অন্তর্ভুক্তিকল্পে সংবিধানে স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা প্রয়ােজন।
(৬) নারীশিক্ষা:
সংবিধানের ১৫(ক) নং ধারায় বলা হয়েছে, সরকার কোনাে নাগরিককে লিঙ্গের ভিত্তিতে পার্থক্য করতে পারবে না। ১৬(ক) নং ধারায় বলা হয়েছে, সরকারের অধীনে সমস্ত অফিসে নিয়ােগ বা চাকুরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সকলেই সমান অধিকারী। নারীশিক্ষার উন্নতিকলে সংবিধানের নির্দেশিকা যেমন রয়েছে তেমনি বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিশন যেমন— কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬), NCWE (১৯৫৯), শ্রী ভক্তবৎসলম্ কমিটি, হংসরাজ মেহতা কমিটির সুপারিশও আছে। তবুও নারীশিক্ষার উন্নতি যতটা হওয়া উচিত ছিল আজও তা হয়নি। এর জন্য প্রয়ােজন পারিবারিক সচেতনতা। এ ব্যাপারে সংবিধান-সংশােধনের মাধ্যমে নির্দেশিকা আরও কঠোর ও সময়নির্ভর হওয়া প্রয়ােজন।
(৭) প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষা:
সংবিধানের ৩৫১(ক) ধারা অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্য বা রাজ্যের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভাষাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সন্তানরা যাতে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করতে পারে সেজন্য উপযুক্ত সুযােগ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু ভাষাগত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন সর্বত্রই এই সুযােগ পান না। এ ব্যাপারে সংবিধানের নির্দেশিকা আরও কঠোরভাবে বলবৎ হওয়া প্রয়ােজন।
(৮) হিন্দি ভাষার শিক্ষা:
৩৫১নং ধারায় বলা হয়েছে, হিন্দি ভাষার উন্নতি ও প্রসার ভারত সরকারের দায়িত্ব। যেহেতু হিন্দি রাষ্ট্রীয় ভাষা, সুতরাং প্রতিটি অহিন্দিভাষী রাজ্যে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি শেখা একান্ত প্রয়ােজন। তাই এ ব্যাপারে সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা প্রয়ােজন। সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে এটা করা যেতেই পারে।
Leave a comment