১৭৮৭ সালে মার্কিন সংবিধানে সর্বপ্রথম যে প্রস্তাবনা বা মুখবন্ধ যুক্ত করা হয়, তা পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশের সংবিধানের রচয়িতাদের প্রভাবিত করেছিল। জাপান, আয়ারল্যান্ড, মায়ানমার, ভারত প্রভৃতি দেশ এই পদক্ষেপ অনুসরণ করে। সংবিধান হল দেশের মৌলিক আইন। প্রতিটি আইনের সঙ্গে একটি প্রস্তাবনা যুক্ত থাকে এবং সেখানে আইনের উদ্দেশ্য ও নীতিগুলির একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধানের প্রস্তাবনাতেও তাই করা হয়েছে।

প্রস্তাবনা যেহেতু সংবিধানের কার্যকরী অংশের অন্তর্ভুক্ত নয়, সেহেতু এর আইনগত কোনাে মূল্য নেই—এ কথা অনস্বীকার্য সংবিধানের মূল অংশের সঙ্গে প্রস্তাবনার কোনাে বিরোধ বাধলে, সংবিধানের মূল অংশই বলবৎ থাকে।

সংবিধানের কার্যকরী অংশের অন্তর্ভুক্ত না হলেও প্রস্তাবনার গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন দিক থেকে এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।

ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনার গুরুত্ব

[1] সংবিধানের দুর্বোধ্যতা দূরীকরণ: সংবিধানের কার্যকরী অংশে কোনাে বাক্যের বা শব্দের অর্থ অস্পষ্ট থাকলে তা বােঝার জন্য প্রস্তাবনার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। বেরুবাড়ি মামলার রায়ে সুপ্রিমকোর্ট এই অভিমত প্রকাশ করে যে, কোনাে আইনের অর্থ সম্পর্কে সংশয় দেখা দিলে প্রস্তাবনার সাহায্যে তা দূর করা যেতে পারে। সংবিধানের দুর্বোধ্যতা দূর করার বিষয়ে প্রস্তাবনার বিশেষ গুরুত্বের কথা সুপ্রিমকোর্টের বিভিন্ন মামলার রায়দানকালে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল পাঞ্জাব রাজ্য বনাম আজয়ের সিং (১৯৫৩), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বনাম আনােয়ার আলি সরকার (১৯৫২), কচুনি বনাম কেরল রাজ্য (১৯৬০) প্রভৃতি মামলা।

[2] সংবিধান রচয়িতাদের উদ্দেশ্যের প্রতিফলন: সংবিধানের প্রস্তাবনা আমাদের সংবিধান রচয়িতাদের উদ্দেশ্য বুঝতে সাহায্য করে। সংবিধানের কোনাে একটি অংশ অস্পষ্ট থাকায় তার অর্থ বুঝতে না পারা গেলে প্রস্তাবনার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংবিধান রচয়িতাদের উদ্দেশ্য কী ছিল তা প্রস্তাবনা থেকে জানা যেতে পারে।

[3] সংবিধানের উদ্দেশ্য ও নীতির প্রতিফলন: যেসব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবধারা সংবিধান-রচয়িতাদের অনুপ্রাণিত করেছিল, সেগুলি প্রস্তাবনার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। প্রস্তাবনাকে ভারতীয় সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তি বলে অভিহিত করা হয়। প্রস্তাবনার মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাধারণতন্ত্র, গণসার্বভৌমিকতা প্রভৃতি ভাবাদর্শের পাশাপাশি আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার, চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববােধ প্রতিষ্ঠার সংকল্পের কথা ঘােষিত হয়েছে।

[4] জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাৎপর্য: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রস্তাবনার গুরুত্ব কম নয়। জাতীয় ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রস্তাবনায় সংবিধানের যেসব প্রাথমিক উপাদান বা মৌলিক বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, পার্লামেন্ট সেগুলিকে সংশােধন করতে পারে না (গােলকনাথ মামলার রায়)। সংবিধানের প্রাথমিক উপাদান বা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল কাঠামাে। এর মধ্যে রয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রভৃতি। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রস্তাবনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রস্তাবনায় ভ্রাতৃত্ববােধ সম্প্রসারণের যে আদর্শের কথা বলা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম স্তম্ভ বলে অনেকে মনে করেন। বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ নীতির মাধ্যমে এই আদর্শ অনুসরণ করা হচ্ছে।

[5] নৈতিক গুরুত্ব: সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনগত দিক থেকে না হলেও প্রস্তাবনার নৈতিক গুরুত্বকে কানােভাবেই অস্বীকার করা যায় না। প্রস্তাবনায় ঘােষিত নীতি ও মহান আদর্শগুলিকে উপেক্ষা করে বাস্তবে কোনাে সরকারের পক্ষে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়৷

ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনার তাৎপর্য

[1] পণ্ডিত ঠাকুরদাস ভার্গব ও হিদায়েতুল্লার মতামত: পণ্ডিত ঠাকুরদাস ভার্গব প্রস্তাবনাকে ‘সংবিধানের প্রাণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর ভাষায়, প্রস্তাবনা হল সংবিধানের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান অংশ। এটি সংবিধানের আত্মস্বরূপ এবং সংবিধানের চাবিকাঠি। এটি এমন একটি উপযুক্ত মাপকাঠি যার সাহায্যে কেউ সংবিধানের মূল্য নির্ণয় করতে পারে। ভারতের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হিদায়েতুল্লা মন্তব্য করেছিলেন যে, সরকার কোন্ নীতি অনুসরণ করে তার কার্যাবলি সম্পাদন করবে তা প্রস্তাবনায় বলে দেওয়া আছে। প্রস্তাবনা হল সংবিধানের সহযােগী।

[2] সুপ্রিমকোর্টের বিভিন্ন মামলার রায়: ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা বিভিন্ন মামলার রায়দানকালে যেভাবে প্রস্তাবনার গুরুত্বকে তুলে ধরেছেন তা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বেরুবাড়ি মামলায় (১৯৬৯) সুপ্রিমকোর্ট তার রায়দান করতে গিয়ে প্রস্তাবনাকে সংবিধান-রচয়িতাদের মনের চাবিকাঠি বলে বর্ণনা করেছিল। কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য সরকার (১৯৭৩) মামলায় বিচারপতি সেলাত ও বিচারপতি গ্রোভার প্রস্তাবনাকে সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলে অভিহিত করে একে সংবিধান রচয়িতাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশ বলে বর্ণনা করেন।

গােলকনাথ মামলার রায়দানকালে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি সুব্বারাও বলেন, সংবিধানের আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষাকে সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছে প্রস্তাবনা। নৈতিক দিক থেকে এর প্রভাব অপরিসীম ও রাষ্ট্রপরিচালকদের কাছে এটি একটি অন্যতম পথ-নির্দেশিকা (The spirit or the ideology behind the Constitution is sufficiently crystal ised in the Preamble.)

[3] সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের মতামত: ড. ধীরেন্দ্রনাথ সেনের অভিমত হল প্রস্তাবনা নিষ্ঠাপূর্ণ সংকল্প ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সংকল্প এবং কার্যকরী আইন কখনও এক হতে পারে না। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘােষিত নীতি ও আদর্শগুলি এখনও পুরােপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এস সি কাশ্যপ-এর অভিমত হল প্রস্তাবনাকে সংবিধানের অঙ্গ বলে বিবেচনা করা হলেও, তা কিন্তু ক্ষমতার উৎস হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না। প্রস্তাবনা কোনাে ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরােপ করতে পারে না।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, সংবিধানের প্রস্তাবনার একটি স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। এর তাৎপর্যকে কোনােভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। অবশ্য একথাও সত্যি যে, প্রস্তাবনার মহান আদর্শ ও সংকল্পপুলি স্বাধীনতার ছয় দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও পুরােপুরি বাস্তবায়িত করা যায়নি। প্রস্তাবনার আদর্শ বহুলাংশে ঘোষিত আদর্শ হিসেবে রয়ে গেছে।