ভূমিকা : সকল রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিচার বিভাগ হল অন্যতম ক্ষমতার আধার। সাবেকি চিন্তাধারা অনুযায়ী বিচার বিভাগকে ন্যায়নীতি ও নিরপেক্ষতার প্রতীকরূপে চিহ্নিত করা হলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে বিচারবিভাগীয় কাঠামাের লক্ষ্য ও পদ্ধতি স্থির করা হয়। এই কারণেই বিচার বিভাগের পক্ষে রাজনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। ভারতের সংবিধানের প্রণেতাগণও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার সােপানরূপে আদালতের ভূমিকাকেই প্রাধান্য প্রদান করেছেন। বিচার ক্ষমতা ব্যতিরেকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই কারণেই লর্ড ব্রাইস যথার্থই বলেছিলেন যে, ন্যায়বিচারের দীপশিখাটি অন্ধকারে নিভে গেলে কী সেই অন্ধকার! ভারত যেহেতু পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ তাই লর্ড ব্রাইসের উপরােক্ত উক্তিটির কথা মাথায় রেখে এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করে গঠন করা হয়েছে।

উপরােক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অন্যান্য দেশের মতো ভারতের বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের আলোচনা প্রতি অনেকে গুরুত্ব আরােপ করেছেন। এই বিচারব্যবস্থার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আমাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেগুলি হল一

(1) অন্য দেশের অন্ধ অনুকরণ নয় : ভারতের বিচার বিভাগ অন্য কোনাে দেশের বিচার বিভাগকে অন্ধ অনুকরণ করে না। তবে ভারতের বিচারব্যবস্থাকে ব্রিটিশ ও মার্কিন বিচারব্যবস্থার মধ্যবর্তী পথ অবলম্বনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর কারণ হল, ভারতের বিচারব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে আদালতের যেমন প্রাধান্য স্থান পায়নি সেরকম গ্রেট ব্রিটেনের বিচার বিভাগের মতাে সংসদ বা পার্লামেন্টের প্রাধান্যকেও স্বীকার করা হয়নি।

(2) ভারতের বিচার ব্যবস্থা অখন্ড : ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দু-ধরনের বিচারব্যবস্থা লক্ষ করা গেলেও ভারতে কিন্তু এই দ্বৈত বিচারব্যবস্থাকে অনুসরণ করা হয়নি। ভারতের সমগ্র দেশের জন্য এক ও অখন্ড বিচারব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়েছে। এখানে নিম্নতম আদালত থেকে শুরু করে উচ্চতর আদালতগুলিকে ক্রমােচ্চ স্তরে বিন্যস্ত করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এই স্তর বিন্যাসের শীর্ষে রয়েছে, তারপর এই বিচারবিভাগীয় কাঠামাের অধীনে রয়েছে হাইকোর্ট সমূহের হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিভিন্ন স্তরের অধস্তন আদালতসমূহ এবং সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে ন্যায় পঞ্চায়েত।

(3) আইনের বৈধতা ও সাংবিধানিকতা বিচার : ভারতে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা করে থাকে। কোনো আইন সংবিধান লঙ্ঘন করলে অথবা সংবিধান-নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে প্রণীত না হলে সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট তাকে সংবিধান-বহির্ভূত বলে ঘােষণা করতে পারে। এর ফলে ওই আইনের বাস্তবে প্রয়ােগ করা সম্ভব হয় না।

(4) সারা দেশব্যাপী একই দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন : ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলো এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারের জন্য পৃথক পৃথক আইন নেই। একই প্রকার দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের সাহায্যে সারা দেশে বিচারকার্য সম্পাদিত হয়ে থাকে।

(5) সংবিধানের ব্যাখ্যাকারক হিসেবে আদালতের ভূমিকা : ভারতের বিচার বিভাগ সংবিধান ব্যাখ্যা করতে পারে। সংবিধানের কোনাে অংশের ব্যাখ্যা নিয়ে বিরােধ সৃষ্টি হলে সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যার মাধ্যমেই সেই বিরােধের নিষ্পত্তি ঘটে থাকে। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের অভিমতকে অনুসরণ করে আইনগত সাম্যের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত শ্রেণিবিভাজনের জন্য আইনসভা আইন প্রণয়ন করতে পারে। এই কারণে সুপ্রিমকোর্টকে সংবিধানের অভিভাবক ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যা কর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

(6) আইনগত ক্ষমতার প্রাধান্য : ভারতের সংবিধানের দুটি নীতির প্রাধান্যকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, যথা— আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়া (Equal Protection of Law) এবং আইনের দৃষ্টিতে সমতা (Equality before the Law) কিন্তু এই নীতির ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। যেমন সংবিধানের ৩৬১ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপাল যতদিন স্বপদে বহাল থাকেন ততদিন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনাে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যায় না। কার্যকালের মধ্যে তাদের গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোনাে আদালত নির্দেশ দিতে পারে না। এ ছাড়া তারা দুজনে যেসকল ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন এবং কর্তব্য সম্পাদন করেন তার জন্য আদালতের নিকট কৈফিয়ত দিতে হয় না।

(7) বিচারপতি নিয়ােগ ও স্থানান্তরের ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের প্রাধান্য : ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতাগণ বিচার বিভাগ আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচরপতিদের নিয়ােগের ক্ষেত্রে এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের বদলির ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন—১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে চার জন প্রবীণ বিচারপতির দাবি অগ্রাহ্য করে এ এন রায়-কে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

(8) জরুরি অবস্থা ও মৌলিক অধিকার : ভারতের বিচার বিভাগের হাতে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ৩২ এবং ২২৬ নং ধারা অনুসরণ করে সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্ট লেখ জারি করে মৌলিক অধিকার ভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, তবে জরুরি অবস্থা ঘোষিত থাকাকালীন সময় সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের এই ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে।

(9) বিশেষ আদালত গঠন : ভারতে দ্রুত বিচারব্যবস্থার স্বার্থে এবং একাধিক বিরােধ নিষ্পত্তির প্রয়োজনে কতকগুলি বিশেষ বিশেষ আদালত গঠন করা হয়েছে। যেমন – শিল্প আদালত, সামাজিক আদালত, প্রশাসনিক আদালত। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য লোক আদালত গঠন করা হয়েছে। এইরূপ আদালত পথ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবি এবং বিবাহ সম্পর্কিত বিরােধের দ্রুত মীমাংসা করে থাকে। এ ছাড়া কোনো ক্রেতা পরিসেবা কিনতে গিয়ে প্রতারিত হলে তার প্রতিবিধানের জন্যও ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের (১৯৮৬ খ্রি.) ব্যবস্থা রয়েছে। এককথায় কম খরচে গরিব, অসহায়, সম্বলহীন মানুষদের কথা মাথায় রেখে বিচারব্যবস্থায় এই বিশেষ ধরনের আদালতগুলি যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।

(10) ব্যয়বহুল : ভারতে বিচারব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ব্যয়বহুলতা। অর্থাৎ বিচারপ্রার্থীকে উকিল, কোর্ট-ফি বাবদ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় তা খুবই কষ্টসাধ্য। ফলে দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে বিচার বিভাগকে কালো পতাকা আড়াল করে ধনিক শ্রেণী স্বার্থ সুরক্ষিত হয়, সেই ব্যাপারে সকলেই কমবেশি ভুক্তভােগী।

(11) ভারতের বিচারব্যবস্থা দীর্ঘসূত্রিতার দোষে দুষ্ট : ভারতের বিচারব্যবস্থার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল বিচার মীমাংসায় বিলম্ব ঘটানাে। অর্থাৎ অধিকাংশ মামলা দীর্ঘকাল ধরে বিচার চলায় তা নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত অমীমাংসিত থেকে যায়, এর ফলে ন্যায়বিচারের আশা মরীচিকায় পরিণত হয়। এর অন্যতম কারণ হল, আদালতে বহু বিচারকের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকার ফলে বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার নথি লালফিতে বন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে।

(12) বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা : ভারতের বিচার ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা (Judicial Activism) অর্থাৎ শাসন বিভাগের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে একদিকে বিচার বিভাগ ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সবক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট প্রচলিত এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে জনস্বার্থে বিভিন্ন ঐতিহাসিক রায়দানের মাধ্যমে ভারতের বিচার বিভাগ তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

(13) ভ্রাম্যমান আদালত অনুপস্থিত : ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ডের মতাে কোনো ভ্রাম্যমান আদালত (সার্কিট কোর্ট) নেই। এখানে অভিযােগকারীকে বিচারকের কাছে অভিযােগ জানাতে হয়, এখানে বিচারকগণ অভিযােগ শুনতে যান না।

উপসংহার : ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা যথেষ্টশক্তিশালী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ – যা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও মূল্যবােধের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। তবে দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যয়বাহুল্য প্রভৃতি বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত এই বিচারব্যবস্থা। এই কারণে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার সংস্কার সাধনের প্রয়ােজন রয়েছে।

জিরাে আওয়ার ও অনাস্থা প্রস্তাব সম্পর্কে আলােচনা করাে।

ছাঁটাই প্রস্তাব বলতে কী বােঝায়? বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব সম্পর্কে আলােচনা করাে।

মুলতুবি প্রস্তাব ও দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।