ভূমিকা: ভারতীয় সংসদীয় সরকারের প্রকৃতি অনুধাবনের জন্য পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা বিশ্লেষণ করা প্রয়ােজন। সাংবিধানিক বিচারে পার্লামেন্টের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করেছে। পার্লামেন্টের ভূমিকা কেন্দ্র করে ভারতের সংসদীয় রাজনীতি ও সরকারের প্রকৃতি আবর্তিত হয়েছে। ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ ইংল্যান্ডের অনুকরণে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার মডেল প্রতিষ্ঠা করলেও পার্লামেন্টের মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংবিধান প্রণেতাগণ ব্রিটিশ মডেল (পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব)-কে অনুসরণ করেননি। সংবিধান প্রণেতাগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান (ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও ভারসাম্য তত্ত্ব) দ্বারা প্রভাবিত হন। ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ এক্ষেত্রে গ্রেট ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী পন্থা অনুসরণ করেছেন, তারা আইনসভার সার্বভৌমত্ব এবং বিচার বিভাগের প্রাধান্যের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেছেন। ভারতের পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আইনগত দৃষ্টিকোণ এবং কার্যগত ভূমিকা ব্যাখ্যা বা আলােচনা করা প্রয়ােজন।

আইনগত দৃষ্টিকোণ: ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম প্রধান বিচারপতি হরিলাল কানাইয়া মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারতের পার্লামেন্ট কি সার্বভৌম সংস্থা বা অসীম ক্ষমতাশালী কোনাে অনিয়ন্ত্রিত সংস্থা নয়। ভারতের সংবিধানে পার্লামেন্টের ক্ষমতার সীমানা নির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা আছে। পার্লামেন্ট-প্রণীত আইন সংবিধান নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করেছে কি না আদালত তা বিচার করতে পারে। সংবিধান লঙ্ঘিত হলে আদালত পার্লামেন্ট-প্রণীত যে-কোনাে আইন বাতিল করে দিতে পারে। গােপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলায় বিচারপতি এস কে দাস উল্লেখ করেছিলেন, পার্লামেন্ট এবং রাজ্য আইনসভাকে তাদের নির্দিষ্ট অঞ্চলে আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদান করলেও আইনসভা সংবিধান-নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করছে কি না আদালত তার বিচার করতে পারে। পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতা নিজের আইন প্রণয়নের এক্তিয়ারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

কার্যগত দৃষ্টিকোণ: পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের জন্য পার্লামেন্টের কার্যগত প্রকৃত অবস্থান আলােচনা করা প্রয়ােজন। সংবিধান অনুসারে আইন প্রণয়ন, মন্ত্রীসভা গঠন, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ এবং সরকারি আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হলেও বাস্তবে ভারতীয় পার্লামেন্ট প্রকৃত ক্ষমতা ভােগ করে না। এই কারণেই ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদার গুরুত্ব সংক্রান্ত বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ আইনসভার সঙ্গে তুলনামূলক আলােচনার মাধ্যমে তুলে ধরা হল一

[1] ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতাে চরম ক্ষমতাসম্পন্ন নয়: ভারতীয় পার্লামেন্টের প্রকৃত মর্যাদার স্বরূপ উদঘাটন জানতে হলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং মার্কিন কংগ্রেসের মর্যাদার সঙ্গে একটি তুলনামূলক আলােচনা করা প্রয়ােজন। ব্রিটেনে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী বলে বিবেচিত হয়। কারণ সেখানে বিচার বিভাগ পার্লামেন্ট-প্রণীত কোনাে আইনকে বাতিল বলে ঘােষণা করতে পারে না। ভারতের পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত নয়। ভারতে একটি লিখিত সংবিধান আছে। এই সংবিধানে স্পষ্টভাবে পার্লামেন্টের ক্ষমতাসমূহ উল্লিখিত আছে। এই লিখিত সংবিধানের দ্বারা ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ।

এ ছাড়া, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে বন্টিত আছে। কোনাে আইনসভাই এককভাবে আইন প্রণয়নের সকল ক্ষমতার অধিকারী নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য পার্লামেন্ট সমগ্র দেশের সকল ক্ষেত্রে এককভাবে আইন প্রণয়ন ক্ষমতার অধিকারী নয়। তা ছাড়া ভারতে সংবিধানবিরােধী কোনাে আইন পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত হলে বিচারসভার পুণর্মূল্যায়নের অধিকারে সুপ্রিমকোর্ট তা বাতিল করে দিতে পারে।

ভারতীয় পার্লামেন্ট সংবিধানের যে-কোনাে অংশ সংশােধন করতে পারে না। যেমন- ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল রাজ্য মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, সংবিধানের মৌল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে পার্লামেন্ট সংবিধানের যে-কোনাে অংশের পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম। কিন্তু মৌল কাঠামো বলতে কোন বিষয়কে বােঝানাে হয় সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ না থাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব কার্যত সুপ্রিমকোর্ট নিজের হাতেই রেখে দিয়েছে। এ ছাড়া এখানে আদালতের বিচার বিভাগীয় সমীক্ষার ক্ষমতা স্বীকার করা হয়েছে।

[2] মার্কিন কংগ্রেসের মতাে কম ক্ষমতাসম্পন্ন নয়: মার্কিন কংগ্রেসের ক্ষমতা পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, মার্কিন সংবিধানে সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন কংগ্রেসের উপরে অবস্থিত রয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের কার্যাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মার্কিন কংগ্রেস রচিত কোনাে আইনকে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে বা ন্যায়নীতি লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিতে পারে। এই কারণেই মার্কিন কংগ্রেস অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী নয় বলে বিবেচিত হয়েছে। এই কারণে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট সে দেশের আইনসভার অনির্বাচিত শক্তিশালী তৃতীয় কক্ষ বা সংবিধানের তৃতীয় চক্ষু বলে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট চরম ক্ষমতাসম্পন্ন নয়। ন্যায়নীতি লঙ্ঘনের জন্য ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট পার্লামেন্ট-প্রণীত আইন বাতিল করার কোন অধিকার ভােগ করতে পারে না। যেমন গােপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলার (১৯৫০ খ্রি.) রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সংবিধানের নির্দিষ্ট সীমানার মধ্য থেকে ভারতের পার্লামেন্টের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, মার্কিন কংগ্রেসের মতাে দুর্বল না হলেও ভারতীয় পার্লামেন্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতাে সার্বভৌম আইনসভা নয়।

[3] ক্যাবিনেটের প্রাধান্য: পার্লামেন্টের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা হলেও কার্যক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে মন্ত্রীরাই উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে ক্যাবিনেট ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা মাের্চার নেতৃবৃন্দ ক্যাবিনেটে স্থান লাভ করে বলে তাদের দ্বারা উত্থাপিত কোনাে বিলে সম্মতি জ্ঞাপন করার ক্ষমতা মাের্চার সাধারণ সদস্যদের থাকে না। তত্ত্বগতভাবে পার্লামেন্ট ক্যাবিনেট নিয়ন্ত্রণ করলেও বাস্তবে পার্লামেন্টই ক্যাবিনেট কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে নিজ দল বা মাের্চার সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। বস্তুত ভারতের ক্যাবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সুতরাং বলা যায়, ব্রিটেনের পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতা কিংবা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রাধান্য এই ব্যবস্থার মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থান করেছে ভারতীয় পার্লামেন্ট। ভারতীয় সংবিধান যেহেতু লিখিত, তাই লিখিত সংবিধানে ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা সমূহ উল্লেখ করা রয়েছে। ভারতীয় পার্লামেন্ট লিখিত সংবিধান দ্বারা তার ক্ষমতাসমূহকে নির্দিষ্ট সীমানায় সীমাবদ্ধ রেখেছে।

উপসংহার: সবশেষে বলা যায় যে, ভারতে সংসদীয় সার্বভৌমত্ব বিচারবিভাগীয় প্রাধান্যের মধ্যে এক সমন্বয়মূলক পদ্মা গৃহীত হয়েছে। সংবিধানের মৌল কাঠামো উল্লেখযােগ্য ধারণা ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতার উপর সীমাবদ্ধ। পার্লামেন্ট-প্রণীত আইন সংবিধান-ইন্দিকট সীমা অতিক্রম করলে আদালত অসাংবিধানিকতার দায়ে সংশ্লিষ্ট আইনকে অবৈধ ও বাতিল বলে ঘােষণা করতে পারে। অর্থাৎ প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতীয় পার্লামেন্ট সংবিধান-নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে চরম ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় পার্লামেন্টের প্রকৃত ক্ষমতা তত্ত্বগত, বাস্তবসম্মত নয়। এই সমস্ত কারণে ভারতীয় পার্লামেন্ট সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করা চলে না। ভারতীয় পার্লামেন্ট সার্বভৌম ক্ষমতাহীন একটি আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান বলেই অভিহিত করা চলে।