মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারগুলির সংশোধন পদ্ধতি

ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারাগুলি সংশােধন করতে গেলে সংবিধান সংশােধন করতে হয়। সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারা অনুসারে সংসদের উভয়কক্ষে উপস্থিত ও ভােটপ্রদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে এই সংশােধন করা যায়।

ভারতের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং ঘােষিত মৌলিক অধিকারগুলির কয়েকটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলির মধ্যে প্রধান পাঁচটি হল一

[1] বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত: ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারগুলি লিপিবদ্ধ রয়েছে। সংবিধান রচয়িতারা এক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং রাজনৈতিক তত্ত্বের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অধিকারের সনদ, ফ্রান্সের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘােষণা’, আয়ার্ল্যান্ডের সংবিধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডাইসির আইনের অনুশাসন তত্ত্ব এবং গান্ধিজির চিন্তাধারা ইত্যাদির কথা এই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

[2] জরুরি অবস্থায় অবলবৎযােগ্য: রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জরুরি অবস্থা ঘােষিত হলে ২১ নং ধারায় উল্লিখিত জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার ছাড়া অন্যান্য মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায় না।

[3] আইনগত ও রাজনৈতিক প্রকৃতি-বিশিষ্ট: ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলির প্রকৃতি প্রধানত আইনগত ও রাজনৈতিক। কোনাে অর্থনৈতিক অধিকারকে মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

[4] সর্বজনীন নয়: মৌলিক অধিকারগুলির প্রকৃতি সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ ভারতে বসবাসকারী সব ব্যক্তি সব মৌলিক অধিকার সমানভাবে ভােগ করতে পারে না। কয়েকটি মৌলিক অধিকার শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকরা ভােগ করতে পারে, যেমন স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমানাধিকার প্রভৃতি। অন্যদিকে, এমন কয়েকটি অধিকার আছে যেগুলি নাগরিক ও অ-নাগরিক নির্বিশেষে ভারতের সমস্ত অধিবাসী সমানভাবে ভােগ করতে পারে, যেমন—আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ইত্যাদি।

[5] সীমিত বা নিয়ন্ত্রিত: ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত ও ঘােষিত মৌলিক অধিকারগুলি অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত নয়। অবশ্য কোনাে রাষ্ট্রই অবাধ বা সীমাহীন কোনাে অধিকার নাগরিকদের দেয় না, কারণ অধিকার অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হলে তা স্বৈরাচারে পরিণত হয়। এ কে গােপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলায় (১৯৫০) বিচারপতি মুখার্জি তাঁর রায়ে ঘােষণা করেন যে, চরম অথবা অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা বলে কিছু হতে পারে না। কারণ নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরােপুরিভাবে মুক্ত থাকার অর্থ হল নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাকে ডেকে আনা।

অধিকার বলতে সমাজজীবনে এমন কতকগুলি শর্ত বোঝায় যেগুলির অভাবে কোনাে ব্যক্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা জ্ঞানাবলির প্রকাশ অসম্ভব। কিন্তু সব অধিকার মৌলিক নয়। মৌলিক অধিকার বলতে এমন কতকগুলি অধিকারকে বােঝায় যে অধিকারগুলি মানুষের মৌল প্রয়ােজন পূরণ করে। ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারগুলির ওপর সাধারণ অবস্থান ও জরুরি অবস্থার সময় বিভিন্ন ধরনের বাধানিষেধ, সীমাবদ্ধতা, ব্যতিক্রম ইত্যাদি লক্ষ করা যায়। যথা

[1] জনস্বার্থ, সার্বভৌমত্ব, শৃঙ্খলা রক্ষা, দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা, তপশিলি জাতি, উপজাতি ইত্যাদি সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষা ইত্যাদি কারণে ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের ওপর বাধানিষেধ আরােপ করা যায়।

[2] মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে সামাজিক, পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের উল্লেখ থাকলেও অর্থনৈতিক অধিকারের কোনও উল্লেখ নেই।

[3] মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ক্ষমতা আদালতকে প্রদান করা হলেও, ভারতের বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল হওয়ায় সাধারণ মানুষ বিচারব্যবস্থার এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

[4] ৩৯(খ) ও ৩৯(গ) নং ধারায় বর্ণিত নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে কার্যকর করার জন্য ১৯ নং ধারায় বর্ণিত মৌলিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করে আইন প্রণয়ন করা যায়।

[5] সংসদ আইন করে সৈন্যবাহিনীর সদস্যদের মৌলিক অধিকার ভোগ সঙ্কুচিত করতে পারে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের সম্পত্তি রক্ষা, গােয়েন্দাগিরি প্রতিরােধ করা, টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত বাহিনী বা সংস্থার ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকারের সীমা পার্লামেন্ট আইন করে সঙ্কুচিত করতে পারে।

[6] ভারতের কোনাে অংশে সামরিক আইন বলবৎ থাকলে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে মৌলিক অধিকার সীমাবদ্ধ করা যায়।

[7] দেশে জরুরি অবস্থা জারি থাকলে ভারতীয় সংবিধানের ২০ ও ২১ নং ধারায় বর্ণিত মৌলিক অধিকার ছাড়া অন্যান্য মৌলিক অধিকার ভােগের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করা যায়।

মূল্যায়ন: আলােচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি অবাধ নয়। প্রয়ােজনে ওই অধিকারগুলির ওপর রাষ্ট্র যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরােপ করতে পারে।