সূচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের সুবিস্তৃত অঞ্চলে রেলপথের প্রসার ঘটে। ভারতের ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের কিছু সুফলও লক্ষ করা যায়।

[1] যােগাযােগের প্রসার: ভারতে রেলপথের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটে। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য গড়ে ওঠে এবং সরকারি কাজে গতি বৃদ্ধি পায়।

[2] পরিবহণের উন্নতি: রেলপথ স্থাপনের আগে ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত ছিল। রেলপথ স্থাপনের পর এর মাধ্যমে ভারতের মানুষ ও পণ্য পরিবহণে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। অতি দ্রুত মানুষ ও পণ্য চলাচল সম্ভব হওয়ায় দুর্ভিক্ষ ও খরার সময় দূরদূরান্তে খাদ্য পাঠানাে সহজ হয়।

[3] আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি: রেলপথের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারগুলির মধ্যে যােগাযােগ স্থাপিত হলে তাদের মধ্যে পণ্য চলাচল সম্ভব হয়। ফলে পণ্যমূল্যের আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পায় এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।

[4] রপ্তানি বৃদ্ধি: রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণের ব্যয় খুব কম হত। ফলে ভারতের বিভিন্ন কৃষিপণ্য রেলের মাধ্যমে সহজে বন্দরে নিয়ে যাওয়া যেত। বন্দরগুলি থেকে ভারতের পণ্যসামগ্রী সহজে আন্তর্জাতিক প্রতিযােগিতার বাজারে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। ১৮৬২ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারত থেকে রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় ২১/২ গুণ বৃদ্ধি পায়।

[5] আমদানি বৃদ্ধি: রেলের মাধ্যমে ভারতে বিদেশি পণ্যের আমদানি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বিলাতের বিভিন্ন শিল্পপণ্য ও বিলাস-সামগ্রী ভারতের বন্দরে এসে তা রেলের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পৌছে যায়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে আমদানির পরিমাণ ৩ গুণ বৃদ্ধি পায়।

[6] আন্তর্জাতিক বাজার: আগে আঞ্চলিক প্রয়ােজনের ভিত্তিতে ভারতে কৃষি-উৎপাদন চলত। রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতের কৃষিপণ্য রেলের মাধ্যমে বন্দরে পৌছে সহজেই আন্তর্জাতিক বাজারে যাওয়ার সুযােগ পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি মূল্য পাওয়া যায় এমন কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

[7] শিল্পায়ন: কার্ল মার্কস বলেছেন যে, রেল ব্যবস্থা ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের প্রকৃত অগ্রদূত হবে। বাস্তবক্ষেত্রেও রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতে শিল্পের বিকাশের পটভূমি তৈরি হয়। রেল ব্যবস্থা স্বল্পব্যয়ে কাঁচামালের জোগান দিয়ে এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌছে দিয়ে লােহা, ইস্পাত, কয়লা প্রভৃতি আধুনিক শিল্পের বিকাশে সাহায্য করে।

[8] কর্মসংস্থান: ভারতে রেলপথ স্থাপনের ফলে রেলপথ নির্মাণ, রেল কারখানা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযােগ হয়। দেশের ভূমিহীন কৃষকরা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে রেলের কাজে নিযুক্ত হয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেলে নিযুক্ত মােট কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লক্ষ ৭৩ হাজার।

[9] জাতীয় ঐক্য: রেলপথের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যােগাযােগ বৃদ্ধি পায় এবং ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয়তাবােধ বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার: ভারতে রেলপথের প্রসারের বিভিন্ন সদর্থক প্রভাব বা সুফল থাকলেও ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই যে এদেশে রেলপথ স্থাপন করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবে সার্বিক বিচারে রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতীয়রা উপকৃতই হয়। রেলপথ প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন কুপ্রভাবও লক্ষ করা যায়। মার্কিন ঐতিহাসিক বুকানন বলেছেন যে, “স্বনির্ভরতার যে বর্ম ভারতের গ্রামগুলিকে এতদিন রক্ষা করে এসেছিল, ইস্পাতের রেল সেই বর্ম ভেদ করে গ্রাম-জীবনের রক্ত শােষণ শুরু করে দেয়।”