সূচনা: লর্ড ডালহৌসি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য যে সমস্ত পন্থা নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হল স্বত্ববিলােপ নীতি।
ভারতের ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড ডালহৌসি যেসব নীতি অবলম্বন করে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটান সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য হল স্বত্ববিলােপ নীতি। এই নীতি অনুসারে তিনি ব্রিটিশ কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট দেশীয় রাজ্যগুলির অপুত্রক রাজাদের দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার নাকচ করেন। তাই সেই রাজার মৃত্যুর পর তার সিংহাসনে উত্তরাধিকারীর স্বত্ব বা অধিকার বিলুপ্ত হত। ফলে সেই রাজ্যটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হত।
স্বত্ববিলােপ নীতির শর্তাবলি
লর্ড ডালহৌসি প্রবর্তিত স্বত্ববিলােপ নীতির প্রধান শর্তাবলি অনুসারেㅡ
[1] দেশীয় রাজ্যগুলির শ্রেণিবিভাগ: ডালহৌসি ভারতের দেশীয় হিন্দু রাজ্যগুলিকে প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত করেন, যথাㅡ
-
[a] কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট দেশীয় রাজ্য।
-
[b] কোম্পানির আশ্রিত বা অধীনস্থ করদ রাজ্য এবং
-
[c] স্বাধীন দেশীয় রাজ্য।
[2] কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট দেশীয় রাজ্য: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা সৃষ্ট কোনাে দেশীয় রাজ্যের রাজার পুত্রসন্তান না থাকলে সেই রাজা কোনাে উত্তরাধিকারী বা দত্তক পুত্র গ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে রাজার মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর অভাবে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে।
[3] কোম্পানির আশ্রিত করদ রাজ্য: কোম্পানির আশ্রিত করদ রাজ্যের রাজারা কোম্পানির অনুমতি নিয়ে দত্তক সন্তান গ্রহণ করতে পারবে। তবে কোম্পানি সেই দেশীয় রাজাকে দত্তক গ্রহণের অনুমতি না দিলে রাজার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীহীন রাজ্যটি কোম্পানির অধিকারে চলে যাবে।
[4] স্বাধীন দেশীয় রাজ্য: স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলির উত্তরাধিকার সম্পর্কে সরকার কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না।
স্বত্ববিলােপ নীতির প্রয়ােগ
লর্ড ডালহৌসির আগে মণ্ডাভি (১৮৩৯ খ্রি.), কোলাবা ও জলায়ুন (১৮৪০ খ্রি.) এবং সুরাটে (১৮৪২ খ্রি.) স্বত্ববিলােপ নীতির প্রয়ােগ ঘটানাে হয়। তবে ভারতে সর্বপ্রথম ডালহৌসিই এই নীতি কঠোরভাবে প্রয়ােগ করে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং কয়েকজন দেশীয় রাজার পদমর্যাদা বাতিল করেন, যেমনㅡ
[1] রাজ্য অধিকার: ডালহৌসি স্বত্ববিলােপ নীতির মাধ্যমে সাতারা (১৮৪৮ খ্রি.), জয়েৎপুর, সম্বলপুর, বাঘাট ও ভগৎ (১৮৫০ খ্রি.), উদয়পুর (১৮৫২ খ্রি.), করৌলি, ঝাসি ও নাগপুর (১৮৫৪ খ্রি.) প্রভৃতি রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
[2] রাজার পদমর্যাদা বাতিল: স্বত্ববিলােপ নীতি প্রয়ােগ করে ডালহৌসি কয়েকজন দেশীয় রাজার পদমর্যাদা ও ভাতা বাতিল করেন। পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর মৃত্যুর (১৮৫১ খ্রি.) পর তার দত্তক পুত্র নানাসাহেবের বৃত্তি ও পেশােয়া উপাধি বাতিল করা হয়। কর্নাটকেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হয় (১৮৫৩ খ্রি.)।
স্বত্ববিলােপ নীতির সমালােচনা
লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলােপ নীতি সমালােচনার উর্ধ্বে ছিল না।
-
[i] স্বাধীন দেশীয় রাজ্য, কোম্পানির সৃষ্ট রাজ্য ও কোম্পানির আশ্রিত রাজ্যগুলিতে এই নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ফলে কয়েকটি রাজ্যের ক্ষেত্রে এই নীতির অপপ্রয়ােগ ঘটে।
-
[ii] স্বত্ববিলােপ নীতির শর্তগুলিকে ডালহৌসি নিজেই অমান্য করেন। যদিও পরিচালক সভার নির্দেশে শেষপর্যন্ত ন্যায্য উত্তরাধিকারীদের হাতে সেইসব রাজ্য ফেরত দেওয়া হয়েছিল।
-
[iii] দত্তকপুত্র গ্রহণের অধিকার ডালহৌসি খারিজ করলে দেশীয় রাজা ও প্রজারা অসন্তুষ্ট হন।
-
[iv] দেশীয় রাজ্যগুলিকে অহেতুক রাজ্যগ্রাসের ভয় দেখানাে হয়। উদয়পুর রাজ্য ব্রিটিশের সৃষ্ট না হলেও তাকে স্বত্ববিলােপ নীতির বলি হতে হয়েছিল।
উপসংহার: লর্ড ডালহৌসি অনেক ক্ষেত্রেই লন্ডনের বাের্ড অব ডিরেক্টরের পরামর্শকে অমান্য করে স্বত্ববিলােপ নীতির প্রয়ােগ ঘটিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম বাদে শুধুমাত্র হিন্দু রাজ্যগুলিতেই এই নীতির প্রয়ােগ ঘটিয়েছিলেন। ডালহৌসির স্বত্ববিলােপ নীতি দেশীয় রাজ্যগুলিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল সে প্রসঙ্গে হেনরি রাসেল বলেছেন- “আমি মনে করি তার দেশীয় রাজ্য দখল নীতি আমাদের কফিনে পেরেক পুঁতে দিয়েছে।” (“I consider the extinction of a native state is a nail driven into our coffin.”)
Leave a comment