নগর কেন্দ্রসমূহ:

ভারতবর্ষে নগরের উদ্ভব হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫০ অব্দে। হরপ্পা-সংস্কৃতির মধ্যে এই প্রথম পর্বের নগরায়ণের প্রকাশ ঘটে। প্রথম পর্বের নগরায়ণের পতন ঘটে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দে। ভারতবর্ষে দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণ ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণের মূল কেন্দ্র ছিল মধ্যগাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল। পূর্বে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার সমভূমি এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণের বিকাশকাল খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত সম্প্রসারিত ছিল বলে মনে করা হয়। এই পর্বের নগরগুলি অধিকাংশ ছিল মূলত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের ওপর অবস্থিত। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণের কিছু চরিত্রগত পার্থক্য লক্ষণীয়। হরপ্পীয় নগরায়ণ স্থায়ী হয়েছিল মোটামুটি ছয়শো বছর (খ্রিঃ পূঃ ১৭৫০-২৩৫০)। এর কিছু অবক্ষয়ী নিদর্শন আনুমানিক ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাওয়া যায়। যাকে ‘পরবর্তী-হরপ্পা (Late Harappan) সংস্কৃতি’ বলা হয়। কিন্তু এর প্রায় এক হাজার বছর ভারতে নগরজীবনের কোনো ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি এই উপমহাদেশ থেকে পোড়ামাটির ইটও অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণ উদ্ভব কাল থেকে খ্রিস্টীয় ৩০০ শতক পর্যন্ত অবাধ গতিতে এগিয়েছিল। পরবর্তীকালে অধিকাংশ নগরেরই পতন হয় এবং নগরের গুরুত্ব হ্রাস পায়। শর্মার মতে, সীমিত আকারে বা পুনরুজ্জীবিত রূপে যেভাবেই হোক, দ্বাদশ শতক ও তার পরেও নগরজীবনের অস্তিত্ব বজায় থাকে।

ভারতে তৃতীয় পর্যায়ের নগরায়ণ ঘটে আদি-মধ্যযুগে। কিন্তু এই নগরায়ণের সঠিক সময়কাল সম্পর্কে অধ্যাপক শর্মার সাথে অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মতভেদ দেখা যায়। শর্মার মতে, ৩০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অধিকাংশ নগর বিলুপ্তির পথে এগোতে থাকে। সামান্য কিছু ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকে। তারপর সেগুলিও ধ্বংস হয়ে যায়। এমন নগর এদেশে খুব কমই আছে, যার অস্তিত্ব ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল বলে মনে করা যায়।

এই প্রসঙ্গে আদি-মধ্যযুগে বাণিজ্যের সংকোচনজনিত কারণে নগরায়ণ-ব্যবস্থার অধোগতির বিষয়টি স্মরণীয়। নবম শতক থেকে আরবদের লেখার মধ্যে আরব ও ভারতীয় বণিকদের বাণিজ্যের কথা জানা যায়। সুলেমান (৮৫১ খ্রিঃ), ইবন খুরদাবাদ (৯৯২ খ্রিঃ), আল মাসুদি (৯১৫ খ্রিঃ), আল ইদ্রিসি (১১৬২ খ্রিঃ) প্রমুখের লেখায় গুজরাট, কোধন ও মালাবার উপকূলের ভারতীয় বন্দর ও শহরের অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। চোল বন্দরে প্রায় দশ হাজার মুসলমান বাস করতেন বলে আল মাসুদি লক্ষ্য করেছেন। নবম শতকের ‘রাষ্ট্রকুট লেখমালা’তে এই বক্তব্যের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। ইহুদি বণিকদের গেনিজা পত্রমালার ভিত্তিতে এস. ডি. গয়েতিয়েন ভারত ও আলেকজান্দ্রিয়ার উজ্জ্বল বাণিজ্যের কথা বলেছেন। নবম শতকে আরব বণিকদের রচনা থেকে বাংলায় ‘সমন্দর’ নামক বন্দরের অস্তিত্ব জানা যায়। এই সকল বিবরণ থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, আদি-মধ্যযুগে বাণিজ্যের গতি সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়নি এবং নগরায়ণের কাজ সীমিত আকারে হলেও অব্যাহত ছিল।

অন্যদিকে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় একথা বিশ্বাস করেন যে, চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত সময়কালে উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি সমৃদ্ধ নগর অবক্ষয়ের কবলে পড়েছিল। কিন্তু এই অবক্ষয় সার্বিক ছিল বলে ড. চট্টোপাধ্যায় মনে করেন না। সমকালীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন ও লেখর ভিত্তিতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, আদি-মধ্যযুগেও বেশ কিছু নগর নিজ নিজ চরিত্র বজায় রাখতে পেরেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, দ্বিতীয় পর্বের বিখ্যাত নগর অহিচ্ছত্র (বেরিলি জেলা) ষষ্ঠ শতকের পরেও শহুরে চরিত্র বজায় রেখেছিল। দিল্লির পুরোনো কিল্লা, উত্তরপ্রদেশের অত্রঞ্জিঘেড়া প্রভৃতি স্থানে উৎখনন করে তুর্কি অভিযানের পূর্ব পর্যন্ত নগরের অবক্ষয়ের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। একইভাবে ৩০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের অন্তর্বর্তীকালে বারাণসী নগরের অস্তিত্ব অব্যাহত ছিল। বারাণসীর সন্নিকটে রাজঘাটে চতুর্থ স্তর (৩০০-৭০০ খ্রিঃ) এবং পঞ্চম স্তরে (৭০০-১২০০ খ্রিঃ) খননকার্যের ফলে এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন লেখমালার সাক্ষ্য থেকেও আদি-মধ্যযুগের নগর-কেন্দ্রগুলির অনুসন্ধান পাওয়া যায়। ৮৬৭-৯০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উৎকীর্ণ দশটি লেখ থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় ‘বুলন্দ’ শহরের সন্নিকটে ‘তত্তানন্দপুর’ শহরের অস্তিত্ব জানা যায়। লেখমালাতে বিভিন্ন রাস্তার বর্ণনা (কুরথ্যা ও বৃহদ্রথ্যা), শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বাজার (পূর্ব হট্ট), বাজারে যাওয়ার পথ (হট্টমার্গ) ইত্যাদি উন্নত নগরজীবনের সাক্ষ্য বহন করে। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী লিখেছেন, “তত্তানন্দপুর যে নগরসুলভ আকার ও চরিত্র ধারণ করেছিল, ‘আহাড়ের’ উৎখনন থেকেও তার সমর্থন মিলেছে।” প্রতিহার সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ‘সিয়াডোনি’-তে প্রাপ্ত লেখটি ৯০৭-৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে সেখানে নগরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এখানে ‘পত্তন’ (শহর), ‘হট্ট’ (বিপণনকেন্দ্র), ‘অপরসরক’ (বারান্দাযুক্ত বাড়ি) ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার নগর চরিত্রের আভাস দেয়। নগরজীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘মণ্ডপিকার’ও অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করা হয়। বাণিজ্যিক কেন্দ্রের পাশাপাশি সম্ভবত ‘সিয়াডোনি’ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৮৭৫ ও ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের দুটি লেখ থেকে জানা যায় যে, গুর্জর-প্রতিহারদের আর একটি ব্যস্ত নগর ছিল ‘গোপাদ্রি, (বর্তমান গোয়ালিয়র)। নগরটি সম্ভবত প্রাকার দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। সে কারণে নগরটিকে ‘কোট্ট’ বা ‘কেল্লা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিহার রাজাগণ নিযুক্ত ‘কোট্ট পাল’ এই দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। ‘বলাধিকৃত’ উপাধিধারী উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারী গোপাদ্রিতে অবস্থান করতেন। এর থেকে এই নগরীর প্রশাসনিক গুরুত্ব বোঝা যায়। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় গুর্জর ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ‘পৃথুদক’ (আধুনিক পেহোয়া) নামক আদি-মধ্যযুগের একটি নগরের উল্লেখ করেছেন। ৮৮২-৮৩ খ্রিস্টাব্দের একটি লেখর ভিত্তিতে তিনি বলেছেন, পৃথুদক ছিল উত্তরাপথের প্রধান অশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্র। এই লেখ থেকে বিভিন্ন অশ্ব ব্যবসায়ীর বিবরণ জানা যায়। তবে পৃথুদকের তুলনায় সিয়াডোনি ও গোপাদ্রি অনেক বেশি সমৃদ্ধ, ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল বলে অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় মনে করেন। সিয়াডোনি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ছিল। অন্যদিকে ‘গোপাদ্রি’ সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

দশম শতকে উৎকীর্ণ কলচুরি রাজ্যের শাসক দ্বিতীয় লক্ষ্মণরাজ-এর ‘করিতলাই লেখ’র ভিত্তিতে ড. চট্টোপাধ্যায় ওই অঞ্চলে (মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর) নগরায়ণের সাক্ষ্য উপস্থিত করেছেন। এই লেখতে ‘পুরপত্তন’ কথাটি উৎকীর্ণ আছে। এ ছাড়া ‘বিলহরি’ লেখতে ওই অঞ্চলে বৃহদাকার ‘পত্তন মণ্ডপিকার’ কথা উল্লেখ আছে। সম্ভবত বিলহরির সুবিস্তৃত উৎপাদনক্ষেত্র ওই অঞ্চলে প্রচুর কৃষিজাত উদ্বৃত্ত জোগান দিত। এইভাবে বিলহরি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। একইভাবে রাজস্থানের ‘নাডোল’ কৃষি-বাণিজ্যের আর একটি কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এখানে ‘মণ্ডপিকা’ গড়ে উঠলে নাডোল শহুরে চরিত্র লাভ করে। পরবর্তীকালে চহমান রাজাদের রাজধানী হিসেবে ‘নাডোল’ প্রতিষ্ঠা পায়।

আর চম্পকলক্ষ্মী (R. Champaklakshmi) মালাবার উপকূল-সহ দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্যের প্রসার সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তিনিও আদি-মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্যকেন্দ্রিক নগরের উদ্ভবের কথা স্বীকার করেছেন। “গ্রোথ অব আর্বান সেন্টার্স ইন সাউথ ইন্ডিয়া ….” শীর্ষক প্রবন্ধে! ‘কুড়ামুক্কু-পালাইয়ারাই’ নামক জোড়া শহরের উত্থান ও বিকাশের কথা উল্লেখ করেছেন। কাবেরী বদ্বীপ অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই যুগ্ম শহরের পটভূমিতে তিনি স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের চাহিদা, সন্নিহিত পশ্চাৎভূমি থেকে উদ্বৃত্তের জোগান ইত্যাদি উপাদানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন। বাণিজ্যের কারণে এখানে জনবসতি বৃদ্ধি পায়। শহরের উদ্ভবের প্রাথমিক পর্বে স্থানীয় মন্দির কর্তৃপক্ষ নানাভাবে বণিকদের সাহায্য করেন। এইভাবে কুড়ামুক্কু পালাইয়ারাই শহরের প্রতিষ্ঠা ঘটে।

আদি-মধ্যযুগে তৃতীয় পর্বের নগরায়ণের চরিত্র প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণ থেকে স্বতন্ত্র ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ণের ভিত্তি ছিল কোনো উন্নত ও বৃহৎ শক্তি হিসেবে তাদের গুরুত্ব। কিন্তু তৃতীয় পর্বের নগরগুলি ছিল আঞ্চলিক এবং বাণিজ্যক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আদি মধ্যযুগের নগরগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন স্তর ও স্থানীয় শক্তির কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।