কারিগরি শিক্ষা, শিক্ষার্থীর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক গুলোকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার মাধ্যমে তার অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ ও নতুন উদ্ভাবনী শক্তির যে জাগরণ ঘটায়, তার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ জীবনে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে।

বর্তমানে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার বিশেষ বিকাশ ঘটলেও এই শিক্ষাকে কিভাবে বাস্তবসম্মত ও কার্যকর করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নিম্নে এই সমস্যাগুলি উল্লেখ করা হল।

(১) সামাজিক মনোভাব: এখন পর্যন্ত ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষ এই শিক্ষাকে নীচু নজরে দেখে। সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করে BA, MA পাস করাকে মর্যাদার চোখে দেখে এবং প্রধান কারণ হল সাধারণ মানুষের মধ্যে যৌন চেতনার অভাব ও সামাজিক চেতনার অভাব, কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা কারিগরি শিক্ষার প্রধান সমস্যা।

(২) সুপরিকল্পনার অভাব : আমাদের দেশে যে-সমস্ত শিল্প রয়েছে। সেই শিল্পগুলো কী ধরনের দক্ষ মানুষের প্রয়োজন সেই সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কি কি ধরনের দক্ষ কারিগর চাই বা কত সংখ্যক প্রয়োজন সেই সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। এই পরিকল্পনার অভাব কারিগরি শিক্ষার অন্যতম সমস্যা।

(৩) উপযুক্ত প্রশাসকের (ম্যানেজমেন্টের) অভাব : দক্ষ ম্যানেজমেন্ট অভাবে আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত মানের শিক্ষা প্রদান করতে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের কারিগরি শিক্ষা বিশেষভাবে নির্ভর করে উপদেষ্টা পরিষদ ও দক্ষ প্রশাসকের উপর। কিন্তু এ দেশের ম্যানেজমেন্টের উন্নতমানের না হওয়ায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পঠন পাঠন ব্যবস্থা যথেষ্ট বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

(৪) উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব : এই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষকদের বেতন হার অত্যন্ত কম হওয়ায় দক্ষ শিক্ষক পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা, গবেষণাগার, পরীক্ষাগার ইত্যাদির অভাব থাকায় এই পেশায় উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যায় না। 

(৫) ভাষাগত সমস্যা : বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল ভাষাগত সমস্যা। এই শিক্ষায় বইগুলো ইংরেজি ভাষায় লেখা। ফলে তা শিক্ষার্থীদের বােঝাতে খুবই অসুবিধা হয়। 

(৬) অর্থাভাব : বর্তমান যুগ হল প্রযুক্তির যুগ। তাই উন্নত প্রযুক্তির জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থের অভাবে ওয়ার্কশপ ও ল্যাবরেটরি না থাকায় শিক্ষার্থীরা অত্যাধুনিক জ্ঞানলাভ করতে পারে না। এই অর্থের অভাবে শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক জ্ঞান পেলে ব্যবহারিক জ্ঞান সেরকম পায় না। 

(৭) শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারিগরি শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় গঠিত সমস্যা : শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উপযুক্ত সমন্বয়ের অভাবে ঠিকমতো প্রশিক্ষণের পর নিয়োগ হয় না। ফলে শিক্ষিত কর্মীর চাকরি পায় না। 

(৮) কর্মরত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব : কর্মরত শিক্ষকদের শিক্ষকতা চলাকালীন প্রশিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা নেই। প্রতিদিন বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। সেই জ্ঞান শিক্ষক না পাওয়ার শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। ফলে শিল্প কারখানায় তা প্রয়োগ হচ্ছে না। উন্নত জ্ঞানের অভাবে শিল্প উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ছে।

(৯) আধুনিকীকরণের অভাব : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবিস্কৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে দেশে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এখনও পুরােনাে আমলের যন্ত্রপাতির মাধ্যমেই কাজ করে যাচ্ছে।

(১০) সংযোগের অভাব : বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা মহলের সরাসরি সংযোগ না থাকায় কী ধরনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী প্রয়োজন তা জানা সম্ভব হয় না। ফলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েও অনেকে চাকরি পায় না।

তবে উপরোক্ত সমস্যা গুলো আলোচনা করে বলা যায়, ভারতীয় শিক্ষা কমিশন (১৯৬৪-৬৬ খ্রি.) সাধারণ শিক্ষার ভিড় কমানোর জন্য কারিগরি শিক্ষার জন্য সুপারিশ করে। যাদের মেধা উচ্চশিক্ষার জন্য নয় তাদের জন্য দক্ষতা বিকশিত হতে পারে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে। কারিগরি শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করতে সরকারকে আরও বেশি পরিকল্পনা নিতে হবে।