‘ভারতবর্ষে রামমােহন রায় আধুনিক শিক্ষার অগ্রদূত’-আলােচনা করাে।
ভারতে যেসব প্রগতিশীল চিন্তানায়কেরা সমাজের কুসংস্কার দূর করার জন্য এবং মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ গড়ে তােলার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা রামমােহন রায়|ধর্মসংস্কার থেকে শুরু করে সমাজসংস্কার, বাংলা ভাষার উন্নয়ন, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূর করা, সহমরণ বর্জন প্রভৃতি বিষয়ে তিনি আন্দোলন করেছিলেন।
আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মচিন্তা: রামমােহনের শিক্ষাচিন্তা ও সংস্কারমূলক কাজকর্মগুলি ছিল আধুনিক যুগের সঙ্গে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য উভয় শিক্ষা সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষায় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মতত্ত্বেও পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তিনি। তিনি নিজে ছিলেন একেশ্বরবাদী এবং পৌত্তলিকতার বিরােধী। সর্বধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন সমান শ্রদ্ধাশীল। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্য থেকে ধর্মবিরােধ দূর করতে তিনি তুলনামূলক ধর্মের প্রবর্তন করেন।
সমাজসংস্কার: রামমােহন হিন্দুসমাজকে কুসংস্কার-মুক্ত করার জন্য নানান ধরনের সমাজসংস্কারের কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তাঁর ওইসব কাজের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল—কৌলীন্যপ্রথা, সতীদাহপ্রথা, বহুবিবাহ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন ইত্যাদি বন্ধ করা। এককথায় তিনি এদেশের কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। যদিও দেশের বেশিরভাগ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, রক্ষপরশীল ও সংকীর্ণ মনােবৃত্তির মানুষের জন্য সমাজসংস্কারে তিনি সর্বতােভাবে সফল হতে পারেননি, তবুও এ কথা বলা যায় উত্তরকালে তাঁর চিন্তাধারারই জয় হয়েছে।
শিক্ষাসংস্কার: শিক্ষাক্ষেত্রে রামমােহন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট ভাবধারাকে গ্রহণ করে তার পুনরুজ্জীবন ঘটানাে এবং বাংলা ভাষার উন্নতিসাধন করার জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষার মাধ্যমে তিনি মানুষের যুক্তিবাদী মনের যথাযথ বিকাশের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, দর্শন প্রভৃতি আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে তিনি ভারতীয় জনগণকে আধুনিকমনস্ক হতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন সংস্কৃত, আরবি বা ফারসি ভাষার মাধ্যমে দেশীয় শিক্ষার্থীদের উন্নতি অসম্ভব|তাই তিনি বিজ্ঞান শিক্ষায় গুরুত্ব দেন। বিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয়গুলির মধ্যে বিজ্ঞান, গণিত এবং রসায়নশাস্ত্রকে প্রাধান্য দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। 1822 খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইঙ্গ-বৈদিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে তিনি ইউক্লিডের জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং যন্ত্রবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেন।
সাহিত্যে অবদান: শিক্ষার উন্নতির জন্য কেবল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, দেশীয় ছাত্রদের জন্য পুস্তক রচনায় নিজেকে নিয়ােগ করেছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় ভূগােল, ব্যাকরণ এবং জ্যোতির্বিদ্যার বই লেখেন। 1815 থেকে 1830 খিস্টাব্দের মধ্যে তিনি প্রায় ত্রিশটি। পুস্তক রচনা করেন, একাধিক পত্রপত্রিকা প্রকাশ এবং প্রবন্ধ রচনা করেন।
স্ত্রীশিক্ষা প্রসার: স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও রামমােহনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। 1822 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘নারীদের প্রাচীন অধিকারের বর্তমান সংকোচনের ওপর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য নামক একটি বই লেখেন। এতে মহিলাদের আইনানুগ নানান অধিকার এবং তাদের শিক্ষাদানের জন্য দাবি করা হয়। এই বইতে তিনি বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র থেকে উদাহরণ সংগ্রহ করে দেখান যে অতি প্রাচীনকালেও নারীশিক্ষার প্রচলন ছিল এবং তারা সমাজে বিশেষ মর্যাদা পেতেন।
এই সমস্ত কাজ ছাড়াও বাংলা ভাষা ও গদ্য সাহিত্যের উন্নতিসাধন, পত্রপত্রিকা প্রকাশন, হিন্দু মহাবিদ্যালয় স্থাপনে উৎসাহ দান, বেদান্ত মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি শিক্ষাসংক্রান্ত কাজের সঙ্গে রামমােহন নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করেছিলেন।
ভারতপথিক রামমােহন রায়ই সর্বপ্রথম বাংলায় সনাতন স্বাধীনতা-প্রবৃত্তি এবং মানবিক গুগগুলিকে সংস্কারমুক্ত করে বর্তমানের উপযােগী করে তুলতে পেরেছিলেন। তাই ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে রাজা রামমােহন রায় আধুনিকতার অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত।
Leave a comment