মধ্যযুগীয় যে ভক্তি ভাবনা দৈববিশ্বাসকে অবলম্বন করে, মঙ্গল দেবদেবীর উপাসনাকে আশ্রয় করে প্রবহমান হয়ে চলেছিলো এয়োদশ শতক থেকে শুরু করে ষোড়শ সপ্তদশ শতক পর্যন্ত, অষ্টাদশ শতকে এসে যেন সেই ভক্তি ও দৈববিশ্বাসে লাগলো সংশয়ের আঘাত। এই অন্তর্বর্তীকালে, একদিকে যেমন গৌড়ীয় বৈষ্ণুবধর্মে ও কাব্যে গোস্বামী শাসনের ফলে মানবীয়-আবেগ বিরহিত শুদ্ধ অহৈতুকী ভক্তির আধ্যাত্মিকতায় বৈশ্ববচেতনা মানুষের সাংসারিক জীবনের নিত্য সুখ দুঃখের বৃত্ত থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, তারই বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় একান্ত মানবিক প্রেমকেই অবলম্বন করে সহজিয়া বৈষ্ণুবের আত্মরতিপরায়ণতা বিকৃতি লাভ করেছিল। অপরদিকে মঙ্গল কামনায় ও উপাসনায় দেখা গিয়েছিলো নিতান্তই জাগতিক বাসনার স্থূলতাজাত লোভ, অসংযম ও সম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা। এই সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা বৈঘ্নবধর্মেও কম দেখা দেয়নি। মঙ্গল কবিমানস যেহেতু প্রথম থেকেই সংসার বাসনার সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে আবদ্ধ, এবং যেহেতু সমকালীন সমাজের বেষ্টনের মধ্যে অবরুদ্ধ থেকে সেই অবস্থাকে দেবত্ব দিয়ে মণ্ডিত করতে চেষ্টা করেছে, সেইহেতু সমাজে যখন যে শক্তির প্রাবল্য দেখা দিয়েছে তখনই সেই শক্তি পিছনে আপন আপন দেবতার ক্রিয়া দেখতে পেয়েছে। এইভাবেই রচিত হয়েছে মঙ্গলকাব্য।
মধ্যযুগীয় ধর্মচেতনার অনুরূপ অবক্ষয়ের ছবি ফুটে উঠেছে ভারতচন্দ্রের মঙ্গল কাব্যে। পৃথিবীতে কলিপ্রভাবে প্রকৃত ধর্ম বলতে কিছু নেই তা অভিশপ্ত নলকূবের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছে–
ভূমে কলি বড় বলবান।
নাহি রাখে ধর্মে বিধান।।
এটা ভারতচন্দ্রের সমকালীন পরিবেশের কথা। সত্যসন্ধ কবি সেই ধর্মবোধের বিকৃতি ও শৈথিল্যের চিত্র এঁকেছেন ব্যাস কাহিনিতে। এই ব্যাসদেবের মুখেই ভারতচন্দ্র শুনিয়েছেন–
সর্বশাস্ত্র দেখিয়া সিদ্ধান্ত কৈনু এই
ভজনীয় যেজন সেজন মোক্ষ দেই।।
এরূপ মুক্তি কামনা ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গত অধিকার। কিন্তু যখনই এর মধ্যে প্রবেশ করেছে ভেদবুদ্ধিজনিত অহংকার তখনই ধর্মের শুদ্ধতা হারিয়েছে। স্বার্থ সাধনের ঐকান্তিক চেষ্টায় ব্যাসদেবের অসত্য উচ্চারণ–
সত্য সত্য এই সত্য আরো সত্য করি।
সর্বশাস্ত্রে বেদ মুখ্য সর্ববেদে হরি।।
আবার এই স্বার্থ চরিতার্থতার জন্যই বিষ্ণুকে পরিহার করে শিবের ভজনা শুরু করলেন যখন তখন তিনি বিষ্ণু নিন্দায় পঞ্চমুখ হলেন। “রাগে মত্ত হইয়া ছাড়িল হরিনাম।” ব্যাসদেবের এই দোলাচল চিত্ততা যুগসন্ধি জনিত অরাজকতার ফল।
ভারতচন্দ্র নিজস্ব চিন্তা ভাবনা অনুযায়ী বললেন, বাংলাদেশে ভাস্কর পাণ্ডিতের আক্রমণ আলিবর্দীর পাপের ফল। যখন নবাব আলিবর্দী ভুবনেশ্বর লুণ্ঠন করে প্রচণ্ড অত্যাচার ও লুণ্ঠনে মত্ত, তখন স্বয়ং শিব তাঁর ভক্ত বর্গীরাজকে স্বপ্নে দেখা দিলেন–
“স্বপ্নে দেখি বর্গীরাজা হইল ক্রোধিত।
পাঠাইল রঘুরাজ ভাস্কর পণ্ডিত।।”
তবু ভারতচন্দ্রের কবি মানসে এই মধ্য যুগীয়তার অবশেষ ছিলো অতি স্বল্প স্থায়ী। তাঁর ধর্মবোধ তাঁকে নির্ভুলভাবে দেখিয়ে ছিলো সেই যুগ সন্ধিকালের সার্বিক অসামঞ্জস্য । দুদৈর্বের ফলে মানুষের শুভ কাজও যে অশুভ ফল আনে, তার বাস্তব অভিজ্ঞতা ভারতচন্দ্রের ছিলো। তাইতো ব্যাসদের যখন কঠিন তপস্যায় অন্নদার ধ্যান করেছেন, তখন দেবী অন্নপূর্ণার–
“কপালে টনক নড়ে হাত হৈতে হাতা পড়ে
উছুট লাগিয়া পদ টলে।”
আর তাই–
দুর্দৈব যখন ধরে ভাল কর্মে মন্দ করে
অন্নদার উপজিল রোধ।
যুগের সার্বিক ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকাণ্ডে যে ভালো মন্দের পার্থক্য থাকে না, যুগসন্ধিকালের কবি ভারতচন্দ্র সেই সত্যটিও স্পষ্ট করলেন–
নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়
বিস্তর ধার্মিক লোক ঠেকে গেল দায়।
কর্ম ও ফলে নিদারুণ অসামঞ্জস্য ছিলো অষ্টাদশ শতকের বাংলাদেশের বাস্তব অভিজ্ঞতা। মঙ্গলকাব্যের পুরাণ সম্মত ভক্তি কাহিনির আধারে এইভাবে কবি উপস্থিত করেছে নতুন জীবন জিজ্ঞাসা–
বেদেতে মহিমা তব পরম নিগূঢ়।
সেই বেদ পড়ি মোর পতি হৈল মূঢ় ॥
ভারতচন্দ্রের জীবন জিজ্ঞাসা পূর্ণরূপে মানবকেন্দ্রিক। তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনার মর্মকেন্দ্রেও ছিল মানুষ। আর সেই মানুষ কেবল দৈব নিগৃহীত অথবা কেবল দৈব কৃপাপুষ্ট নয়, নানা বিরোধী দোষে গুণে পূর্ণ সেই মানবিক সত্তায় কবি দেখাতে চেয়েছেন বাস্তব জগৎ সংসারের অকরুণ সংসারের চিহ্নগুলি। তাই দেব চরিত্র কবির কাব্যে মানব নিয়তির অধীন হয়ে দেখা দিয়েছে। শিব যিনি দেবাদিদেব মহাদেব তাঁকে দেখা যায় নিতান্ত সাধারণ নিরন্ন ক্ষুধার্ত মানুষের মতই অন্নপ্রার্থী। দেবী অন্নপূর্ণাও নরলোকে আপনার পূজা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে মানবীটিকে নিমিত্ত করেছিলেন, তার জীবনেও নিয়তির অতি কঠিন পরিহাসের অসহনীয় জ্বালা। অন্নহীন, বস্ত্রহীন অস্থিচর্মসার সেই নারীর দারিদ্র্যের প্রতি হৃদয়হীন মানুষের কি নিষ্ঠুর পরিহাস “গেঁয়ো লোকে দিয়াছে পদ্মিনী নাম তার।” লোকের এই ব্যঙ্গের উপর কবি হেনেছেন উচ্চতর ব্যঙ্গের আঘাত। অর্থাৎ দরিদ্রের ও নিরন্নের জীবন-স্বপ্নের কাব্য রচনা করেছেন কবি আবার অন্যদিকে রাজসভার ও রাজার প্রমোদের আয়োজন সম্পন্ন করেছেন কবি—এমনই স্বতবিরোধ ছিলো কবির যুগপরিবেশ।
কবি ভগবানকেও মানবিক ন্যায় অন্যায় বোধের অধীন করে জেনেছেন, এবং গভীর আর্তিতে উচ্চারণ করেছেন–
“নিত্য তুমি খেল যাহা নিত্য নহে ভালো তাহা
আমি যা খেলিতে চাহি, সে খেলা খেলাও হে।”
যুগসন্ধি কালের কবির কাব্য-খেলায় সেইজন্য এত জটিলতা, হাস্য পরিহাসের অন্তরালে দীর্ঘশ্বাস, দেবতার অলৌকিক শক্তির প্রভূত নিদর্শন সত্ত্বেও একই কাব্য শিথিল ভক্তির পটভূমিকায় জাগতিক মানুষেরই বিপর্যয়ের কাহিনি।
Leave a comment