তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি। কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ।

ভাব-সম্প্রসারণ : মানবজীবন তরুলতা ও পশুপাখির জীবনের মতাে নয়। তাই মনুষ্যগৃহে জন্মগ্রহণ করলেই মনুষ্য অধিকারী হওয়া যায় না। প্রকৃত মানুষ হতে হলে প্রচুর ত্যাগ-তিতিক্ষা, দৃঢ় মনােবল, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মানবিক গুণাবলি অর্জন করা একান্তভাবে আবশ্যক। বস্তুত মনুষ্যত্বের পরিচর্যার মধ্য দিয়েই মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্ব জন্মমাত্রই অর্জিত হয় না। জন্মের সময় মানবশিশুর সঙ্গে ইতরপ্রাণীর কোনাে পার্থক্য থাকে না। জীবনের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সামাজিকীকরণ ও মনুষ্যত্ব অর্জনের মাধ্যমে মানুষ যথার্থরূপে মানুষ হয়ে ওঠে। তরুলতা ও পশুপাখির বিবেক ও বুদ্ধি নেই। এজন্য তাদের বিবেক-বিবেচনা ও বুদ্ধির বিকাশও নেই । কিন্তু মানুষের বিবেক ও বুদ্ধি উভয়ই বিদ্যমান। ফলে জ্ঞান আহরণ, সংস্কৃতিচর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ নিজের বিবেক ও বুদ্ধিকে বিকশিত করে তুলতে পারে। যা অন্য কোনাে প্রাণী বা বৃক্ষলতার পক্ষে সম্ভব নয় । জন্মের পরে তাদের শুধু দৈহিক বৃদ্ধি হয়, কিন্তু মনের বিকাশ সাধিত হয় না। পক্ষান্তরে, মানুষ জন্ম পরবর্তী সময়ে বিদ্যা-শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে। এ মানবিক গুণই মানুষকে তরুলতা ও পশুপাখি থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। আবার, জীবনের প্রয়ােজনে মানুষকে একে একে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে হয়, যা তরুলতা বা পশুপাখির বেলায় কল্পনাও করা যায় না। তাই জন্মােত্তর স্থবির। তরুলতা ও বুদ্ধিহীন পশুপাখি স্বতঃসিদ্ধভাবে তরুলতা ও পশুপাখি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা ঘটে।

মানুষকে মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করতে হলে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়, যা মনুষ্যজীবনে অর্জন করা খুবই কঠিন। প্রাণপণ প্রচেষ্টা ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনার মধ্য দিয়ে মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। তাছাড়া তরুলতা প্রাকৃতিক নিয়মে জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে এবং একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আবার, পশুপাখি আহার, নিদ্রা ও মৈথুন এই ত্রিপ্রবৃত্তির মধ্যেই তাদের জন্ম। থেকে মৃত্যু অবধি সীমাবদ্ধ জীবন আবর্তিত। কিন্তু মানুষকে আরও অনেক কিছু ভাবতে হয়, করতে হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বড়াে কর্ম হলাে মানুষকে ধর্ম পালন করতে হয়, স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভে এবং মানবাত্মার উন্নতিকল্পে মানুষকে স্রষ্টার আরাধনা করতে হয়। এছাড়া সামাজিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক তথা বিশ্ব-মানবতার কল্যাণে সাধ্যমতাে শুভকর্মে নিয়ােজিত হয়ে জন্ম সার্থক করে মানুষ। বর্তমানে আমরা যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে আধুনিক বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছি, এর রূপকার কেবলই মানুষ। এখানে তরুলতা কিংবা পশুপাখির কোনাে অবদান নেই। তবে মানুষ তার বুদ্ধি প্রয়ােগ করে সুকৌশলে মানবসভ্যতা বিনির্মাণে তরুলতা ও পশুপাখিকে কাজে লাগিয়েছে, যার কৃতিত্বও মানুষেরই প্রাপ্য। মােটকথা, বেঁচে থাকার সংগ্রামের পাশাপাশি মানুষকে নিরন্তর সুন্দরের সাধনায় ব্রতী থেকে জীবনকে সার্থক করে তুলতে হয়। মন নামক অমূল্য সম্পদের প্রভাবে পৃথিবীতে মানুষ মানুষ’ নামে পরিচিত। মানুষের বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতা, মহানুভবতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি মহৎ গুণাবলি রয়েছে, কিন্তু তরুলতা বা পশুপাখির তা নেই। প্রকৃতপক্ষে, মন বা বিবেকই মানুষকে মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে আত্মপরিচয়ের মর্যাদা দিয়েছে।