মুকুন্দরামের দ্বিতীয় অবিস্মরণীয় চরিত্র সৃষ্টি হচ্ছে ভাঁড়ু দত্ত। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে ভাঁড়ু দত্ত সজীব ও বাস্তব চরিত্র হিসাবে অনন্য। ভাঁড়ু দত্তের চরিত্রাঙ্কনে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সমালোচকগণ বলেন একালে জন্মগ্রহণ করলে কবি মুকুন্দরাম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক রূপে আখ্যাত হতেন। ভাঁড় দত্ত ছিল কালকেতুর নগরে প্রথম থেকে যারা বসবাস করত তাদের অন্যতম। কালকেতু অশিক্ষিত নীচকুলোদ্ভব ব্যাধ-সম্ভান, সে এতবড় নগরের অধিশ্বর তা ভাঁড়ু মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু সে মহাধূর্ত। তাই বাক্যজালে কালকেতুকে জড়াতে চাইল। কালকেতুর দরবারে প্রবেশ করে উচ্চকণ্ঠে তার কুল-গৌরব ঘোষণা করতে আরম্ভ করল এবং কালকেতু খুড়া সম্বোধন করে আত্মীয়তার সম্পর্ক পাতাল।
ভাঁড়ু এবার আসল কথাটি পাড়ল। কি করে রাজ্য চালতে হয়। তার কাছে যেন শিখে নেয়। এ বিষয়ে ভাঁড়ুর অভিজ্ঞতা আছে। কাজেই মণ্ডলের পদটি যেন সে তাকেই দেয়-
“দেহ মোরে সর্বভার তারালা আদি হার
তুমি থাক নিশ্চিন্তে নিলয়।।”
সদ্য রাজা হওয়া দরিদ্র সস্তান কালকেতু ভাঁড়ুর দাবি মেনে নিতে বাধ্য হল। কালকেতু প্রথমেই বুলান মণ্ডলকে প্রধান রূপে গ্রহণ করেছিল, এটি ভাঁড়ুর মনঃপুত হয়নি। তাই বুলানের বিরুদ্ধে সে কালকেতুর কান ভাঙতে থাকে।
“দেওয়ান ভেটে বেটা বহিত আমার চিঠি।
যারে বল বুলান মণ্ডল।
থাকিতে সকল প্রজা আগুয়ান মোর পূজা
কহিলাম সকল প্রজা।।”
কালকেতু ব্যাধ সম্ভান। প্রজা-শাসন ইত্যাদি ব্যাপার তার অজানা। তার পক্ষে কোনটা উচিত কোনটা অনুচিত বুঝতে পারা সম্ভব নয়।
গুজরাট নগরে নানাজাতির প্রজার আগমন ঘটল, চতুর ভাঁড়ু মনস্থির করল প্রথম থেকেই হাটের দখল নিতে হবে। তোলা তুলতে হবে—
“লণ্ডে লণ্ডে গালি দেই করে শালাশালা।
আমি মহামণ্ডল আমার আগে তোলা।”
সব শুনে কালকেতু মহাকুদ্ধ। সে ভাঁড়ুকে ডেকে শাসাল। ভাঁড়ু কথায় কান দিলই না। সে তো মণ্ডল, কাজেই বাজার হতে ন্যায্য মতই সে তোলা তুলেছে। কালকেতু ভাঁড়ুকে তখন তাড়িয়ে দিল। ভাঁড়ুও ছাড়বার পাত্র নয়। সে শাসাতে শাসাতে বলে—
“হরিদত্তের বেটা হই জয়দত্তের নাতি,
হাটে লয়্যা বেচাইব বীরের ঘোড়া হাতি।।
তবে সুশাসিত হবে গুজরাট ধরা।
পুনর্বার হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা।।”
ভাঁড়ু দত্ত কলিঙ্গের সভায় উপস্থিত হল কালকেতুর সর্বনাশ সাধনে। কলিঙ্গের কাছে গিয়ে কালকেতুর কুৎসা গাইতে লাগল, বলল কালকেতু কলিঙ্গরাজের রাজ্যে বাস করে গুজরাট নগর স্থাপন করেছে এবং বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক হয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করছে।
কালকেতুকে সায়েস্তা করার জন্য কলিঙ্গরাজের সাহায্যে গুজরাট আক্রমণ করল কিন্তু প্রথমে কোন ফল হল না। তখন কোটাল ভাঁড়ুকে বলে কালকেতুকে ধরে এনে দিতে হবে। কালকেতু ফুল্লরার উপদেশ মতো ধান্যঘরে আত্মগোপন করেছে। ভাঁড়ু তার সন্ধানে পুরীর ভিতর প্রবেশ করল এবং সুচতুর ভাঁড়ু ফুল্লরাকে ভুলিয়ে কালকেতুর ধান্য ঘরে আত্মগোপন করার কথা জানতে পারে। বলাবাহুল্য কালকেতু বন্দী হল। দেবীর কৃপায় কালকেতু মুক্ত হল। সকল মৃতব্যক্তি প্রাণ ফিরে পেল।
দুই কান কাটা লোকের ন্যায় ভাঁড়ুর লজ্জা নেই। সে শাক, বেগুন, কচু মূলা ইত্যাদি ভেট নিয়ে কালকেতুর সমীপে এসে আবার তোষামোদ করতে লাগল—
“তুমি খুড়া হৈলে বন্দী অনুক্ষণ আমি কান্দি
বহু তোমার নাহি খায় ভাত।
দেখিয়া তোমার মুখ পাসরিলু সব দুখ।
দশ দিক হইল অবদাত।।”
কালকেতু আর সুচতুর ভাঁড়ুর ফাঁদে পা দেয় না। তাই আদেশ দিল—
“মুড়াহ ভাঁড়ুর মুণ্ড অভক্ষে পূরিয়া তুণ্ড
দুই গালে দেহ কালি চুণ।।”
দয়াল কালকেতু ভাঁড়ুকে শিক্ষা দেবার জন্য এসব করেছিল। পুনরায় সে ভাঁড়ুর ঘরবাড়ি ফেরৎ দিল, ক্ষমা করেও দিল।
কবিকঙ্কণের ভাঁড়ু-চরিত্র মৌলিক সৃষ্টি না হলেও সার্থক এক চরিত্র সৃষ্টি। শঠ চূড়ামণি ভাঁড়ু দত্তের সাক্ষাৎ মধ্যযুগের চেয়েও বর্তমানযুগে অনেক বেশি পাওয়া যায়। এ জাতীয় চরিত্র সৃষ্টিতে মুকুন্দরাম কল্পনা শক্তি ও বাস্তব সাহায্য নিয়েছেন। চরিত্র সৃষ্টিতে মুকুন্দরাম যে দক্ষ কারিগর তা ভাঁড়ু দত্ত চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের বুঝে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না।
Leave a comment