নিজের কাব্য প্রতিভার প্রতি সমকালীন পাঠকের অবজ্ঞা প্রদর্শন দেখে যিনি বলেছিলেন : “নিরবধিকাল আর বসুধা বিপুল/জন্মিলে জন্মিতে পারে মম সমতুল।” অর্থাৎ অনাগত ভাবীকালের উপর তাঁর কাব্যের বিচারের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। সেই শ্রীকণ্ঠ ভবভূতি সংস্কৃতি নাট্য সাহিত্যের আঙিনায় কালিদাসের পরেই একটি স্মরণীয় নাম। আত্মপরিচয়ে তিনি যেটুকু জানিয়েছেন তাতে বোঝা যায় বিদভ দেশে পদ্মপুকুর নামক নগরে ব্রাহ্মণ বংশে তাঁর জন্ম, তিনি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, শব্দ বিদ্যাপারদর্শী, ব্যাকরণ, অলংকার, ন্যায় ও মীমাংসা শাস্ত্রে বিশেষ দক্ষ ছিলেন, তিনি উজ্জ্বয়িনী নগরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণীতে’ ভবভূতিকে কান্যকুব্জের রাজা যশোবর্মনের সভাকবি বলে চিত্রিত করা হয়েছে। ভবভূতি সম্পর্কে মোটামুটি এরূপ তথ্য মেলে।

রচনাসমূহ: মূলত ভবভূতি রচিত তিনখানি নাট্যগ্রন্থের সন্ধান মেলে—মহাবীর চরিত, মালতীমাধব, উত্তরামচরিত, অনুমিত হয়— এছাড়াও ভবভূতি আরও অন্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, কারণ অন্যান্য কোষগ্রন্থ বা শ্লোকে ভবভূতি নামাঙ্কিত পাওয়া যায়।

মালতীমাধব : মালতীমাধব ভবভূতির প্রথম নাটক। এর বিষয়বস্তু লৌকিক ও কবিকল্পিত প্রেম মিলনের গতানুগতিক কাহিনি। বৌদ্ধ পরিব্রাজিকা কামন্দকীর নীতিকৌশলে মন্ত্রী ভূরিবসুর কন্যা মালতীর সঙ্গে অমাত্য দেবারতের পুত্র মাধবের মিলন—মালতীমাধব নাটকের প্রধান ঘটনা। নাটকটি ঘটনাবহুল, এতে নায়ক-নায়িকার হৃদয়গত প্রণয় চেষ্টার বর্ণনা প্রধান স্থান অধিকার করেছে। তবে নাট্যকার যে অদ্ভুত বীভৎস ও রৌদ্র রসের অবতারণা করেছেন তা অভিনব। একটি নাটকে একসঙ্গে এতগুলি রসের পরিবেশন ভবভূতির কৃতিত্বের পরিচায়ক। অবশ্য ঘটনার বাহুল্য আকস্মিকতার প্রাধান্য নাটকটির নাট্য ধর্মকে কিছুটা ক্ষুণ্ন করেছে।

এ নাটকে ভবভূতি বামাচারী তন্ত্র সাধনার বিষয়ে মূল্যবান তথ্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থিত করেছেন এবং বৌদ্ধ সাধক ও সাধকদের জনকল্যাণমূলক কার্য প্রণালীও পরিচয় দানে সক্ষম হয়েছেন। পরিব্রাজিকা কামন্দকী সংসার ত্যাগ করলেও লোককল্যাণে বিশেষ করে নায়ক-নায়িকার মিলনের প্রয়োজনে সাংসারিক কাজে লিপ্ত হতে দ্বিধা করেননি। তিনি তাঁর দুই সহযোগী অবলোকিতা ও সৌদামিনীর সাহায্যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এ ব্যাপারে কাপালিকদের মতো মহাযানী বৌদ্ধেরাও যে মন্ত্রবলে ও যোগবলের অধিকারিণী ছিলেন তা প্রমাণ মেলে সৌদামিনীর কার্যকলাপে। এছাড়া ভবভূতির কবিত্ব শক্তির পরিচয় এ নাটকে প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় বিশেষ করে বিন্ধ্য পর্বতের বর্ণনায় বিধৃত।

মহাবীর চরিত : ভবভূতির দ্বিতীয় নাটক মহাবীর চরিত বা বীরচরিত। এটি রামায়ণ আশ্রয়ে রচিত। এ নাটকে রামের ‘সিদ্ধাশ্রমে প্রবেশ থেকে রাবণ বধের পর অযোধ্যায় ফিরে আসা পর্যন্ত ঘটনাবলি বিধৃত হয়েছে। এ যেন একখানি নবরামায়ণ। নাটকটি ‘কৌমার’ ‘পরশুরাম সংবাদ’, সংসৃষ্ট চরিত্র। আরণ্যক প্রকৃতি সাতটি অঙ্কে বিভক্ত, এতে বাল্মীকি রামায়ণ বহির্ভূত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন—বিবাহ পূর্ব জীবনে বিশ্বামিত্র আশ্রমে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ উর্মিলার পূর্বরাগ প্রসঙ্গ, রাবণ কর্তৃক সীতাকে প্রত্যাখ্যান কিংবা রাবণ খচিত মাল্যবান কর্তৃক পরশুরামকে হরধনু ভেঙে সংবাদ জ্ঞাপন ইত্যাদি। এছাড়া রাম কর্তৃক তাড়কা বধ, হরধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিবাহ প্রভৃতি ঘটনা রামায়ণে লক্ষিত, কিন্তু সমগ্র কাহিনিকে নাটকীয় রূপ দিতে ভবভূতি সংলাপের মধ্য দিয়ে ঘটনার বর্ণনা করেছেন এবং নাটকের মূল দ্বন্দ্ব প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও রামচন্দ্রের ধ্বংস সাধনে তাঁর পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে এ নাটকে ভবভূতি কিছুটা স্বাতন্ত্র্য দেখিয়েছেন, এছাড়া ভবভূতি প্রধান কৃতিত্ব বীর, অদ্ভুত, রৌদ্র ও ভয়ানক রসের পরিস্ফুটনে। জামদগ্ন, পরশুরামের ক্রোধান্ধ মূর্তিটি ভবভূতির হাতে যথার্থভাবে অঙ্কিত হয়েছে।

উত্তররামচরিত : উত্তররামচরিতে সীতা বিসর্জনের পর থেকে লবকুশের জন্ম, পিতার সঙ্গে মিলন ও সীতা এবং রামের পুনর্মিলন দেখানো হয়েছে। এ নাটকটি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড অবলম্বনে রচিত। মূল ঘটনা রামায়ণ থেকে গৃহীত বটে, কিন্তু অনেক বিষয়ে ভবভূতির স্বকল্পিত, যেমন রামায়ণে যেখানে রাম সীতার বিচ্ছেদ ঘটেছে, ভবভূতি সেখানে তাঁদের পুনর্মিলনের বর্ণনা দিয়েছেন, কারণ ভারতীয় নাটকে মৃত্যুর প্রয়োগ নিষিদ্ধ, তাই নাট্যকার এ নাটকে সীতার পৃথিবী প্রবেশ না দেখিয়ে রামের সঙ্গে তাঁর মিলনেই নাটকের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছেন।

উত্তররামচরিত নাটকটিও সাতটি অঙ্কে বিভাজিত। প্রথমাঙ্ক—’চিত্ৰদৰ্শন’ অন্তঃসত্ত্বা সীতার চিত্র বিনোদনের জন্য চিত্রদর্শনের কাহিনি বর্ণিত। দ্বিতীয় অঙ্ক ‘পঞ্চবটী’তে রামায়ণ রচনার বৃত্তান্ত বর্ণিত। তৃতীয় অঙ্ক ‘ছায়া’য় রামসীতার ভাবসম্মিলনের চিত্র অঙ্কিত। চতুর্থ অঙ্ক ‘কৌশল্যা-জনক যোগে’তে লবের আবির্ভাব। পঞ্চম অঙ্ক ‘কুমার বিক্রমে’ চন্দ্রকেতুর সঙ্গে লবের যুদ্ধ। ষষ্ঠ অঙ্ক ‘কুমার প্রত্যাভিজ্ঞানে’ চন্দ্রকেতু ও লবের যুদ্ধ এবং সপ্তম অঙ্ক ‘সম্মেলন’-এ ভবভূতির নতুন পরিকল্পনা, তিনি এখানে করুণ রসোচ্ছল রামায়ণের মিলনান্তক পরিণতি দান করেছেন। এই অঙ্কে নাট্যকার নাট্য মধ্যে আর এক নাটকের অবতারণা করে অভিনেতা ও দর্শকদের এক সূত্রে গ্রথিত করেছেন।

তাই বলতেই হয়, সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসের পর নাট্যরচনায় ভবভূতির স্থান অতি উচ্চে। কারণ চরিত্র-চিত্রণে ভবভূতি বিশেষ সার্থকতা দেখিয়েছেন। রাম-সীতা লব-কুশ তাঁর হাতেই মহিমোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আবার তাঁর কবিত্ব শক্তিও বিশেষ প্রশংসনীয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন রসের উদ্ভাবনে তাঁর ক্ষমতা অপরিসীম। তাঁর মতো আর কোনো নাট্যকার সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটকে একই সঙ্গে বীরু করুণ ও শৃঙ্গার রস পরিবেশনে এমন সার্থকতা দেখাতে পারেননি। নাটকের ভিতরে নাটক প্রদর্শনের পরিকল্পনাটিও অভিনব। অতএব বিদ্যাসাগরের বক্তব্য উদ্ভূত করে আমরাও বলতে পারি— “ভবভূতির রচনা হৃদয়গ্রাহিণী ও অতি চমৎকারিণী। সংস্কৃত ভাষায় যত নাটক আছে ভবভূতি প্রণীত নাটক ত্রয়ের রচনা সে সকল অপেক্ষা সমধিক প্রগাঢ়।”