কবি-পরিচিতি : সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে কালিদাস রাজাধিরাজ। অবশ্য একালের বিচারে শূদ্রক-রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকটি নানা কারণে বিশেষ মান্যতা প্রাপ্ত হলেও সেকালের ঐতিহ্যবাদীদের বিচারে ভবভূতিই কালিদাসের পরবর্তী উচ্চার্য নাম। অবশ্য সেকালে কেউ কেউ কালিদাসকে সবদিকে কবিমাত্র এবং ভবভূতিকে ‘মহাকবি’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে কালিদাসেরও ওপর স্থান দিতে চেয়েছেন (‘কবয়ঃ কালিদাসাস্যাঃ ভবভূতির্মহাকবিঃ।’)। অবশ্য স্বয়ং ভবভূতি নিজের মূল্যবোধ বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই সমকালে যথেষ্ট সমাদর না পাওয়া সত্ত্বেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলেছিলেন—

‘উৎপৎসাতেহস্তি মম কোহপি সমানধর্মা।

কালোহায়ং নিরবধিঃ বিপুলাচ পৃথ্বী।।’

-এই নিরবধি কাল ও বিপুলা পৃথিবীতে নিশ্চয়ই আমার সমানধর্মা কেউ জন্মগ্রহণ করবে। (যে আমার কাব্যের মর্ম বুঝবে)। যাহোক্, ভবভূতি একজন কৃতি নাট্যকার ছিলেন এবং তিনি তাঁর প্রত্যেকটি নাটকের ‘প্রস্তাবনা তৈই আত্মপরিচয় একটু বিস্তৃতভাবেই দান করেছেন। এ বিষয়ে আমরা অবশ্যই ভাগ্যবান্, কারণ কালিদাসাদি বহু কবির বিষয়ে যখন কিছুমাত্র জানবার সুযোগ পাইনি, সেখানে কবি ভবভূতি তাঁর বিষয়ে অনেকখানি বলে গেছেন। কবি ভবভূতি-রচিত প্রথম নাটক ‘মহাবীরচরিতে ই তিনি একটু বিস্তৃততরভাবেই আত্মপরিচয় দান করেছেন। তা’ থেকে জানা যায়, কবির পূর্বপুরুষদের বাস ছিল দক্ষিণাপথের পদ্মপুর নামক নগরে। তথায় তৈত্তিরীয় শাখার কাশ্যপগোত্রীয় ব্রহ্মবাদী পতিতপাবন, পঞ্চাগ্নি-ব্রতপরায়ণ সোমপায়ী উদুম্বরনামা ব্রাহ্মণগণ বাস করতেন। সেই বংশের বাজপেয়যাজী মহাকবি ভট্টগোপালের পঞ্চম পৌত্র, পবিত্রকীর্তি নীলকন্ঠের আত্মসম্ভূত ‘শ্রীকণ্ঠপদলাঞ্ছনো ভবভূতিনাম’ কবি অর্থাৎ ‘ভবভূতি নামক কবি, যার উপাধি শ্রীকণ্ঠ’—তাঁর মাতা জাতুকণী দেবী। কবি অপর দুটি নাটকেও সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু সর্বত্রই বলেছেন, ‘শ্রীকণ্ঠ পদলাঞ্ছনো ভবভূতিনাম’—অতএব কবির নাম ভবভূতি এবং উপাধি ‘শ্রীকণ্ঠ’—এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়, কিন্তু তাঁর নাটকের টীকা ভাষ্যকারগণই এ বিষয়ে ভিন্ন মতের উল্লেখ করে থাকেন। তাঁদের মতে, কবির পিতৃদত্ত নাম ‘শ্রীকণ্ঠ’, পরে তিনি ‘ভবভূতি’ নামে পরিচিত হন। এ বিষয়ে বীর রাঘব, জগদ্ধর, ত্রিপুরারি, ঘনশ্যাম প্রভৃতি সব টীকাকারই অভিন্ন মত অথচ পরবর্তীকালে যে-সকল কোষগ্রন্থ কিংবা অলঙ্কারগ্রন্থে কবির রচনা থেকে দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত হয়েছে, সেখানে সর্বত্রই তিনি ‘ভবভূতি’, অপর কোনো নাম নেই।

জীবৎকাল : ব্যক্তিগত পরিচয়ের ব্যাপারে কবি ভবভূতি কিছুটা উচ্চকণ্ঠ হলে দুর্ভাগ্যক্রমে স্বীয় কাল বিষয়ে তিনি একেবারে নীরব থাকায় পরোক্ষ প্রমাণের সহায়তা ছাড়া তাঁর কালনির্ণয়ে অগ্রসর হবার কোনো পথ নেই। কবি কল্হণ-রচিত ‘রাজতরঙ্গিণী’ (রচনাকাল ১১৫৮-৫৯ খ্রিঃ) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে কান্যকুব্জ-রাজ যশোবর্মা বাকপতিরাজ ও ভবভূতি আদি কবির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাপতিরাজ (‘বপইরাঅ) ও তাঁর ‘গৌড়বধঃ’ (গউড়বহো’) কাব্যে ভবভূতির নাম উল্লেখ করেছেন। ৭৩৬ খ্রিঃ যশোবর্মা কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য-কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলেন। অতএব, এর পূর্বেই অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দীর প্রথম পাদেই ভবভূতি বর্তমান ছিলেন, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভিন্নসূত্র থেকেও তারিখটিকে যাচাই করা চলে। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে কবি বাণভট্ট ভাস-কালিদাসাদির নাম উল্লেখ করলেও ভবভূতির নাম উল্লেখ করেননি, অতএব ভবভূতি সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আবির্ভূত হন নি। অষ্টম শতাব্দীতে বামন তাঁর ‘কাব্যালঙ্কার সুবৃত্তি’তে ভবভূতির রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, অতএব তৎপূর্বেই ভবভূতির রচনা সমাপ্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে অনুমান করা চলে, সম্ভবত সপ্তম শতাব্দীর শেষার্ধ ভবভূতির আবির্ভাব কাল এবং অষ্টম শতাব্দীর প্রথম পাদ তাঁর কাব্যরচনা কাল।

রচনাবলী : ভবভূতি-রচিত তিনখানি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়—’মহাবীরচরিত’, ‘মালতীমাধব’ এবং ‘উত্তররামচরিত’। এই তিনখানিই নাটক। অনুমান করা হয়, এর বাইরেও তিনি আরো কোনো কোনো গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যেগুলি কাল-কবলিত হয়েছে। কারণ, বিভিন্ন কোষগ্রন্থ এবং শ্লোকসংগ্রহ অথবা গ্রন্থে ভবভূতির নামাঙ্কিত এমন কিছু কিছু শ্লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, যার কোনো কোনোটি এই তিনটি নাটকের কোনোটিতেই পাওয়া যায় না। কাজেই তাঁর কিছু রচনা বিলুপ্ত বলে মনে করতে হয়।