‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ে রামপ্রসাদ রচিত পদগুলিতে তাঁর সাধক কবি পরিচয়ের যে সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা করো।
ভক্তের সংশয় ও অভিমান শেষ পর্যন্ত ‘ভক্তের আকৃতি বিষয়ক পদগুলিতে কীভাবে বিশুদ্ধ ভক্তিতে সমাপ্ত হয়েছে, রামপ্রসাদের পাঠ্যপদ অবলম্বনে বিশ্লেষণ করে দেখাও।
কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের একটি সাধারণ পরিচয় এই যে তিনি ছিলেন ‘সাধক কবি’ অর্থাৎ তার সাধনা এবং কবিত্বশক্তি ছিল পরস্পর-নির্ভর। এদের একটিকে আশ্রয় করেই অপরটি দাঁড়িয়ে আছে। তার রচিত পদগুলির বাইরে যেমন তাঁর সাধক- জীবনের অপর কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না, তেমনি কোনো পদেই তাঁর সাধনার অনুভূতি ভিন্ন অন্য কোনো প্রসঙ্গ নেই। তাই বলা চলে, তাঁর কবিতায় যেমন সাধনার সুরটিই প্রধান, তেমনি সাধনাকে অবলম্বন ক’রেই তাঁর কবিত্বশক্তির উদ্গম ও পরিপুষ্টি ঘটে। অতএব কবি রামপ্রসাদ রূপে কিংবা সাধক রামপ্রসাদ রূপে বিচার করতে গেলেও অনিবার্যভাবেই অপরটিরও অনুপ্রবেশ ঘটবে, একটিকে এড়িয়ে অপরটিকে প্রকাশ করা হয়তো সম্ভবপর নয় বলেই একাস্ত স্বাভাবিক কারণেই তার নামের পুর্বে ‘সাধক কবি’ উপাধি যুক্ত হয়ে থাকেন এবং এটিই তার সার্থকতম পরিচয়।
কবিবর রামপ্রসাদের কোনো প্রামাণিক জীবনীগ্রন্থ নেই। ঈশ্বরগুপ্ত-রচিত তার জীবনীগ্রন্থটি লোকশ্রুতিমূলক এবং অনুমান নির্ভর। তা থেকে মনে হয় রামপ্রসাদের ছিল সহজাত কবিত্ব প্রতিভা। যখন যেমন খুশি তিনি কবিতা রচনা করতে পারতেন, কিন্তু ঐ সমস্ত কবিতা বা গানই ছিল তাঁর ধর্ম-ভাবনা তথা সাধনা সম্পৃক্ত। যতদূর জানা যায়, তাঁর কবিত্বশক্তিতে যুদ্ধ হয়েই তার কলকাতাস্থিত কর্মকর্তা তার জন্য একটি মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন এবং নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে হালিশহরে ১৪ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। এগুলি তাঁর কবিত্ব শক্তির পরোক্ষ প্রমাণ। প্রত্যক্ষ প্রমাণরূপে আমরা তাঁর রচিত কিছু পদ পেয়েছি তাতেও পরোক্ষ প্রমাণের সমর্থন পাওয়া যায়। ‘শাক্তপদ’ নামে ‘আগমনী-বিজয়ার স্বল্পসংখ্যক উমাসঙ্গীত’ এবং সাধনা-সম্পর্কিত অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীত ব্যতীতও কবি রামপ্রসাদ পালাবন্দী-রূপে ‘কালীকীর্তন’ এবং বিদ্যাসুন্দর কাব্যও রচনা করেছিলেন, যদিও তাঁর সার্থকতম কবিত্বশক্তির পরিচয় পাওয়া যায় ‘শাক্তপদ গুলিতেই। কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কবিরঞ্জন রামপ্রসাদের কবিত্ব শক্তি বিষয়ে বলেছেন : “কবিতা বিষয়ে রামপ্রসাদ সেনের অলৌকিক শক্তি ও অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, ইহা চক্ষে যাহা দেখিতেন, এবং ইহার অন্তঃকরণে যখন যাহা উদয় হইত তত্ক্ষণাত্ তাহাই রচনা করিতেন, কষ্মিকালে দৎ-কলম লইয়া বসেন নাই।
পূর্বোক্ত অলোচনা থেকে রামপ্রসাদের রচিত পদগুলির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। কবিতা তথা গানগুলি যে তার হৃদয়ের গভীরতম উৎস থেকে উৎসারিত তা’ যে বহিঃপ্রমাণ থেকে লব্ধ, তেমনি বিচার-বিবেচনা দ্বারাও সমর্থিত। কাব্যের আঙ্গিক গঠনে, ছন্দোরচনায় এবং অলঙ্কার প্রয়োগে রামপ্রসাদ যে সমগ্র মধ্যযুগে একটি ঈর্ষণীয় কৃতিত্বের অধিকারী এ কথা যে কোনো সুধী সমালোচকই স্বীকার করতে বাধ্য। এ জাতীয় স্তবক-নির্মাণ কুশলতা ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি বাংলার লৌকিক ছন্দ অর্থাৎ স্বরবৃত্ত ছন্দের তিনিই প্রথম সার্থক রূপকার। সর্বপকাদি অলঙ্কার সাহায্যে তিনি যে সাধারণ চিত্রকল্প এবং অর্থময়তা সৃষ্টি করেছেন, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা মেলা ভার। অতএব কবি-রূপে রামপ্রসাদের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।
পূর্বোক্ত অলোচনায় রামপ্রসাদের কবিভাবনর পরিচয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু রামপ্রসাদ তো শুধু কবি নন, তিনি সাধকও বটে, বরং বলা চলে, রামপ্রসাদের প্রধান পরিচয় তিনি সাধক– কবিত্ব সাধনার সঙ্গে সহযোগিতা করেছে মাত্র।
রামপ্রসাদ ছিলেন তান্ত্রিক সাধক। তান্ত্রিক সাধনার নানা স্তর, নানাবিধ রূপ প্রচলিত আছে। সহজভাবে বলা চলে, রামপ্রসাদের সাধনা ছিল মাতৃসাধনী) শাক্ত ধর্ম প্রচারবিমুখ এবং শক্তিসাধনা গোপন প্রকৃতির বলেই তার অন্দর মহলে প্রবেশ করা সাধারণের সাধ্যাতীত ব্যাপার। তবে এ সাধনার ধারা বহুমুখী, এতে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অধিকার আছে— যদিও সাধনার স্তরভেদে অধিকারী ভেদ স্বীকার করে নিতে হয়। তান্ত্রিক উপাসনার স্বরূপের পরিচয় দিতে গিয়ে অধ্যাপক চিত্তাহরণ চক্রবর্তী লিখেছেন, “পুজাকালে পূজক সবৈশ্বৰ্যসম্পন্ন দেবতাকে চিন্তা করিয়া সোহহং মন্ত্র জপ করিবেন, অনন্যমনা হইয়া দেবরূপে নিজেকে কল্পনা করিবেন, এবং আনন্দামৃতমগ্ন হইয়া ক্ষণকাল অবস্থান করিবেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, -তান্ত্রিক সাধনায় সাধক উপাস্য দেবীর সঙ্গে একীভূত হয়ে যান। রামপ্রসাদের সাধনায় আমরা এরই পরিচয় পাই যখন রামপ্রসাদ তার উপাস্য দেবীকে মাতৃরূপে কল্পনা করেছেন। এই মাতৃকল্পনা তাঁর সাধনারই অঙ্গ-
‘মা আমায় ঘুরাবে কত,
কলুর চোখ-ঢাকা বলদের মত?’
কিংবা—
‘বল মা আমি দাঁড়াই কোথা,
আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা।’
প্রভৃতি পদে মাতৃ সকাশে রামপ্রসাদের এই আত্মোৎসর্গের মধ্যে কবির সাধক মনেরই পরিচয় ফুটে উঠেছে।
সাধক-কবি রামপ্রসাদ কখনো কখনো তন্ত্রসাধনার তাৎপর্য প্রতীকের সাহায্যে আভাষিত করেছেন—
‘হাৎকমল মঞ্চে দোলে করালবদনী শ্যামা।
মন পবন দুলাইছে দিবস রজনী ও মা।।
ইড়া পিঙ্গলা নামা সুষুম্না মনোরমা,
তার মধ্যে গাঁথা শ্যামা ব্রহ্মসনাতনী ও মা।’
সাধক রামপ্রসাদ সাংসারিক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাকে গ্রাহ্য করেন না তিনি শুধু মাতৃকৃপাভিক্ষু। তাই তিনি অক্লেশে বলতে পারেন—
‘প্রসাদ বলে, ব্রহ্মময়ী, বোঝা নাবাও ক্ষণেক জিরাই।
দেখ, সুখ পেয়ে লোক গর্ব করে, আমি করি দুঃখের বড়াই।।’
মাতৃসাধক রামপ্রসাদের শেষ কথা—
‘অর্ধ অঙ্গ জায়গীর মাগো, তবু শিবের মাইনে ভারি।
আমি-বিনা-মাইনের চাকর, কেবল চরণধুলার অধিকারী।।’
‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ের পদগুলি বিশ্লেষণ করলে রামপ্রসাদ যে সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নিত হ’য়ে ‘সাধক-কবি আখ্যার যোগ্য অধিকারী বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন, তার সম্যক্ পরিচয় পাওয়া যায়।
Leave a comment