ভূমিকা: ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে সাম্প্রদায়িক বিভেদ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেছেন যে, “কখনও ভুললে চলবে না, ভারতের সাম্প্রদায়িকতা হল একটি পরবর্তীকালের ঘটনা যা আমাদের চোখের সামনে বিকশিত হয়েছে।” তবে এই বিভেদের উৎস ও বিকাশ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ ব্রিটিশ সরকারের ‘বিভাজন ও শাসননীতি’-কে, আবার অনেকে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কুফলকে, আবার কেউ কেউ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের পৃথক স্বার্থচিন্তাকে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের জন্য দায়ী করে থাকেন।
[1] সরকারের উদ্দেশ্য: সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি এদেশে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন দমন করে নিজেদের শাসন নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ‘বিভাজন ও শাসননীতি’ গ্রহণ করে। বিভাজন ও শাসননীতির মূল কথা ছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি করা।
[2] হিন্দু তােষণ: প্রথমদিকে সরকার ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণিকে নিজেদের অনুগত শ্রেণি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এই সময় মুসলিম সম্প্রদায় ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সাদরে গ্রহণ করেনি। এই অবস্থায় সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সমর্থন করে। সরকার হিন্দুদের নিয়ে, বিশেষত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নিয়ে গঠিত মধ্যবিত্তশ্রেণিকে তােষণ করতে থাকে।
[3] সরকারি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা: ব্রিটিশ সরকার মুখে বহু ন্যায়নীতির কথা বলে এবং আইনের চোখে সাম্যনীতির কথা ঘােষণা করে। কিন্তু বাস্তবে সরকার ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণিকে আর্থিক সহায়তা দান, স্থানীয় ও প্রাদেশিক স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সরকারি চাকরিতে নিয়ােগের ব্যবস্থা করে। এর ফলে মুসলিম, বিভিন্ন অব্রাহ্মণ হিন্দু, ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায় প্রভৃতি সরকারি অর্থনৈতিক সহায়তা ও সুবিধা লাভ করে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
[4] মুসলিম তােষণ: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতে মুসলিমরাই ছিল রাজশক্তি। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে হিন্দু সম্প্রদায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনায় মুসমিল সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণি হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের অগ্রদূত। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের উসকে দেয় এবং মুসলিম তােষণ শুরু করে। আলিগড় আন্দোলনের নেতা স্যার সৈয়দ আহমেদ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে ‘অ্যাংলাে ওরিয়েন্টাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই আলিগড় কলেজ ও আলিগড় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আর্চিবােন্ড, থিওডোের বেক, মরিসন প্রমুখ ইংরেজ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলিমদের মনে বিচ্ছিন্নতার মানসিকতা তৈরি করেন।
[5] পশ্চাদপদ শ্রেণিকে তােষণ: ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের আনুগত্য সুনিশ্চিত হওয়ার পর সরকার হিন্দু সম্প্রদায়কে উচ্চবর্ণ ও অনগ্রসর—এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অব্রাহ্মণ ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির প্রতি তােষণনীতি গ্রহণ করে। আজমগড়ের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ইউটিস জে. কিটস ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারির ভিত্তিতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে অনগ্রসর শ্রেণির একটি তালিকা তৈরি করেন এবং শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে তাদের জন্য সংরক্ষণ ও বাড়তি সুযােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেট জর্জ ফ্রাঙ্কিস হ্যামিলটন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে বড়ােলাট লর্ড কার্জনকে লেখেন যে, “আমরা যদি হিন্দুদের দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত করতে পারি তবে আমাদের শক্তি আরও সুদৃঢ় হবে।” সরকারের এই মনােভাবকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে ব্রায়ণ্য শ্রেণির বিরুদ্ধে দাবিদাওয়া আদায়ের বিষয়ে সরকার অনগ্রসর শ্রেণির নেতাদের উৎসাহিত করতে থাকে। মহীশূর, মাদ্রাজ, বােম্বাই প্রভৃতি প্রদেশগুলিতে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ চালু হয়। যুক্ত প্রদেশে প্রতি চারটি আসনের মধ্যে ব্রাহ়ণ, কায়স্থ, মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য ১টি করে আসন সংরক্ষিত হয়।
উপসংহার: হিন্দু মুসলিম বিভাজন ছাড়াও সরকার হিন্দুদের বিভিন্ন উপ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে। এভাবে সরকার অনগ্রসর সম্প্রদায়কে তাদের অনুগত শ্রেণিতে পরিণত করে জাতীয় আন্দোলন থেকে তাদের দূরে রাখার চেষ্টা চালায়।
Leave a comment