সূচনা: ব্রিটিশ সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে এদেশে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ সৃষ্টি করে ব্রিটিশবিরােধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। ফলে উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতালাভ পর্যন্ত সময়কালে ভারতে হিন্দু, মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।

[1] সরকারের বিভেদনীতি: সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার ভারতে নিজেদের শাসনকে নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে হিন্দু-মুসলিম সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি করে জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা চালায়। সরকার মহাবিদ্রোহের পর থেকে হিন্দু তােষণ, বঙ্গভঙ্গের পর থেকে মুসলিম তােষণ এবং পরবর্তীকালে অনগ্রসর হিন্দুশ্রেণিকে তােষণ করে।

[2] উন্নয়নে বৈষম্য: হিন্দু সম্প্রদায় পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতি ঘটায়। ব্রিটিশ প্রশাসনের নিম্নস্তরের বিভিন্ন পদে কাজের জন্য শিক্ষিত হিন্দু ব্রাহ়ণরা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে মুসলিমরা দূরে থাকায় তারা ক্রমে পিছিয়ে পড়ে। ফলে হিন্দুরা অধিকাংশ সরকারি ও সামাজিক সুযােগসুবিধা লাভ করলেও মুসলিমরা তা থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে মানসিক বিভেদ বৃদ্ধি পায়।

[3] সৈয়দ আহমদের ভূমিকা: স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের উদ্যোগে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠা আলিগড় আন্দোলন প্রথম থেকেই সাম্প্রদায়িক মনােভাব প্রচার করতে থাকে। সৈয়দ আহমেদ মুসলিমদের বােঝানাের চেষ্টা করেন যে, হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি, তাদের স্বার্থও পৃথক। এদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। তিনি মুসলিমদের কংগ্রেসের চেয়ে ব্রিটিশদের প্রতি বেশি ভরসা করার উপদেশ দেন। তার হিন্দুবিদ্বেষী নীতি ভারতে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’র জন্ম দেয়।

[4] ধর্মীয় বিভেদ: হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক মিল থাকলেও ধর্মীয় বিভেদ ছিল তীব্র। ধর্মীয় কারণে তারা উভয়ই নিজেদের সম্পূর্ণ পৃথক বলে মনে করত। ভারত সচিব লর্ড ক্রস (১৮৮৬-১৮৯২ খ্রি.) বড়ােলাট লর্ড ডাফরিনকে বলেন যে, ভারতীয়দের ধর্মীয় বিভেদ আমাদের পক্ষে লাভজনক হবে।

[5] প্যান ইসলামবাদের আদর্শ: ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় প্যান ইসলাম অর্থাৎ ইসলামের বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। তাদের অনেকেই ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পরিবর্তে আরব, সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিল। তারা ভারতের স্বাধীনতা অপেক্ষা তুরস্কের সুলতান খলিফার মর্যাদারক্ষায় বেশি আন্তরিক ছিল।

[6] ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কুফল: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগােষ্ঠীগুলি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান সুযােগ পায়নি। শিল্পায়নের অভাবে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে হিন্দুরা নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করায় মুসলিম সম্প্রদায় পিছিয়ে পড়ে। এরূপ অর্থনৈতিক বৈষম্য হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনােভাব বৃদ্ধি করে।

[7] বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ: অভিজাত মুসলিমরা বাণিজ্য বা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে জমিদারি পেশায় যুক্ত হয়। এদিকে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসারের ফলে হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। ফলে জমিদার সম্প্রদায়ভুক্ত অভিজাত মুসলিমরা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। এই শ্রেণিগত বৈষম্য সাম্প্রদায়িক মনােভাব বৃদ্ধি করে।

[8] হিন্দু জাতীয়তাবাদ: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতের প্রাচীন সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়। দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্য সমাজ ও শুদ্ধি আন্দোলন, বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সাহিত্য, তিলকের শিবাজী ও গণপতি উৎসব, অরবিন্দ ঘােষ ও বিপিনচন্দ্র পালের আন্দোলনের ভাবধারায় কালী ও দুর্গার মাতৃমূর্তির প্রচার প্রভৃতি ঘটনা মুসলিমরা সুনজরে দেখেনি।

[9] বঙ্গভঙ্গ: বাংলা ছিল জাতীয় কংগ্রেস এবং ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের পীঠস্থান। ব্রিটিশবিরােধী শক্তিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সরকার মুসলিম তােষণ শুরু করে। এজন্য বড়ােলাট লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক মনােভাবকে উসকে দিয়ে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করে এবং এই পরিকল্পনায় মুসলিমদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করে। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটে। বেশিরভাগ মুসলিম স্বদেশি আন্দোলন থেকে দূরে থেকে বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে।

[10] মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা: মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ প্রভৃতি উদ্দেশ্যে ভারতে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লিগ গঠন করে। লিগের ক্রমিক প্রসারে আতঙ্কিত হয়ে এর পালটা হিসেবে গড়ে ওঠে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিন্দু মহাসভা (১৯১৫ খ্রি.)। উভয় সম্প্রদায়ের প্রধান কর্মসূচির অঙ্গ হয়ে পড়ে বিপক্ষ প্রতিষ্ঠানের দাবিদাওয়াগুলির বিরােধিতা করা। এর ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

উপসংহার: হিন্দু মুসলিম বিভেদের ফলে ভারতের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ অব্যাহত থাকে।