সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্যোগ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, আইনশৃঙ্খলার অবনতির পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ কোম্পানি এদেশে নতুন এক সুসংবদ্ধ পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তােলে। ভারতে ইংরেজ শাসনের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে এই পুলিশ বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

[1] হেস্টিংসের উদ্যোগ : বড়ােলাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতে নিয়মিত পুলিশ বাহিনী গড়ে তােলেন। 

  • [i] তিনি বাংলাকে দশটি এবং বিহারকে আটটি ফৌজদারি জেলায় বিভক্ত করেন। 

  • [ii] প্রতিটি জেলায় একটি করে ফৌজদারি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই থানাগুলিতে একজন করে দেশীয় ফৌজদার নিযুক্ত হন যিনি জেলার প্রধান পুলিশ কর্মচারী ছিলেন। 

  • [iii] ফৌজদারকে সাহায্য করার জন্য ৩৪ জন কর্মচারী ছিল যার মধ্যে ২০ জন ছিল সিপাই। 

  • [iv] প্রতিটি থানার সঙ্গে একটি করে জেলখানা স্থাপিত হয়। 

  • [v] ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ফৌজদারের পদ বিলুপ্ত করা হয়। কোম্পানির দেওয়ানি আদালতের বিচারকরা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা পেয়ে পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

  • [vi] শহরের শান্তিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় কোতােয়ালের হাতে।

[2] কর্নওয়ালিশের উদ্যোগ: 

  • [i] লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদারদের হাত থেকে আরক্ষা বিষয়ক দায়িত্ব সম্পূর্ণ কেড়ে নেন এবং জেলাগুলিকে বিভিন্ন থানায় বিভক্ত করেন। 

  • [ii] থানার দায়িত্বভার দেওয়া হয় একজন দারােগার হাতে। তার অধীনে ২০ থেকে ৩০ জন কনস্টেবল থাকত। 

  • [iii] ম্যাজিস্ট্রেটরা দারােগাকে নিয়ােগ ও তাঁর কাজের তদারকি করতেন। 

  • [iv] প্রতিটি গ্রামে একজন করে চৌকিদার থাকত। তিনি গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে দারােগাকে অবহিত করতেন। 

  • [v] আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কলকাতা শহরে একজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ এবং অন্যান্য শহরে কোতােয়াল’ নিযুক্ত করা হয়। 

  • [vi] দারােগা ব্যবস্থা ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও চালু হয়।

[3] পরবর্তী সংস্কার: পুলিশি ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ধরা পড়ায় ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে দারােগা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর পুলিশি ব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলার রাজস্ব বিভাগের প্রধান কালেক্টরদের হাতে। ফলে কালেক্টরদের অধীনস্থ রাজস্ব বিভাগের অধস্তন কর্মচারীরা। গ্রামগঞ্জে পুলিশি ব্যবস্থা দেখাশােনা করতে থাকে। তাদের উদ্যোগে পুলিশি জুলুমবাজি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।

[4] অন্যান্য অঞ্চলে পুলিশি ব্যবস্থা: 

  • [i] ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের পর স্যার নাপিয়ের সিন্ধু অঞ্চলে রাজকীয় আইরিশ পুলিশ বাহিনীর আদলে একটি পৃথক পুলিশি দফতর খােলেন। সমগ্র সিন্ধু অঞ্চলকে একজন ইনস্পেকটর-জেনারেল এর তত্ত্বাবধানে আনা হয়। 

  • [ii] তার অধীনে প্রতিটি জেলায় একজন করে ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ (ডি. এস. পি.) নিয়ােগ করা হয়। 

  • [iii] সিন্ধু অঞ্চলের পুলিশি ব্যবস্থা ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে, ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাইয়ে এবং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে চালু হয়।

[5] মহাবিদ্রোহের পরবর্তী পদক্ষেপ: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাপিয়ে দেয়। ফলে সরকার পুলিশি ব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় করার প্রয়ােজন অনুভব করে। 

  • [i] ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ কমিশনার নিয়ােগ করা হয়। 

  • [ii] ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অসামরিক কর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ভারতের পুলিশ বাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। 

  • [iii] বিভিন্ন স্তরের পুলিশকে দায়বদ্ধতার অধীনে আনা হয়। অধস্তন পুলিশ বাহিনী ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ (ডি. এস. পি.)-এর কাছে, ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ আবার ইনস্পেক্টর-জেনারেল ও জেলা কালেক্টরের কাছে এবং জেলা কালেক্টররা প্রাদেশিক সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে বলা হয়।

[6] ভারতীয়দের প্রতি বঞ্চনা: পুলিশ বাহিনীর নিম্নপদগুলিতে ভারতীয়রা নিযুক্ত হত। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিক্ষিত ভারতীয়রা পুলিশি বাহিনীর উচ্চপদে নিয়ােগের সুযােগ পেলেও বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যেত যে, “পদমর্যাদায় ইউরােপীয়রা যেখানে শুরু করতেন, ভারতীয়দের চাকরি জীবন শেষ হত সেখানে।”

উপসংহার: ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে, ব্রিটিশ রাজত্বের তৃতীয় স্তম্ভ ছিল পুলিশ। 

  • [i] পুলিশ বাহিনী প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হয়ে উঠেছিল। 

  • [ii] পুলিশ বাহিনী সেনাবাহিনীর সহায়ক হিসেবে কাজ করত। 

  • [iii] দেশের বিভিন্ন অংশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, খুন-রাহাজানি- ডাকাতি দমন করা প্রভৃতি দায়িত্ব পুলিশ বাহিনী পালন, করত। 

  • [iv] সরকার বিরােধী বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ ও অন্যান্য আন্দোলনগুলি পুলিশ বাহিনী অতি সক্রিয়তার সঙ্গে দমন করে এদেশে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করত।