সূচনা: কোম্পানির শাসনের সুযােগ নিতে ইউরােপীয় পুঁজিপতি গােষ্ঠী ভারতের শিল্পোন্নয়নের জন্য নয়, শুধু নিজেদের মুনাফা অর্জনের জন্যই শিল্পক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়ােগ করেছিল।
ভারতে ইউরােপীয় শিল্পোদ্যোগের মাধ্যমে পুঁজি অনুপ্রবেশের বেশ কিছু কারণ ছিল一
[1] ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার কল্যাণে ইউরােপীয় তথা ব্রিটিশ শিল্পপতিদের পক্ষে বেশ কিছু আইন তৈরি হয়। এর সুবাদে ভারতে শিল্পপণ্যের বাজার দখল করা ইউরােপীয়দের পক্ষে অনেক সহজ হয়েছিল।
[2] সস্তা শিল্প শ্রমিক: ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অধীনে পদানত থাকা বহু অসহায় নিঃস্ব ভারতবাসীকে সস্তা শ্রমিক (Cheap labour) রূপে পেতে বিদেশি শিল্পপতিদের অসুবিধা হয়নি। ইউরােপীয় শিল্পপতিরা অল্প বেতন দিয়ে ভারতীয় শ্রমিকদের বেশি সময়ে খাটিয়ে নিতে পারত।
[3] শিল্পের উপযুক্ত পরিবেশ: শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়ােজনীয় সুযােগসুবিধা, যেমন—সস্তায় কাঁচামাল, কম পরিবহণ খরচ, সুলভ শ্রমিক ইত্যাদি কারণে বিদেশি শিল্পোদ্যোগীরা ভারতকে বেছে নিয়েছিল।
[4] ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব: ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ায় নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়। এগুলিকে কাজে লাগিয়ে বিদেশি উদ্যোগপতিরা ভারতের কাঁচামালের সাহায্য নিয়ে এদেশেই শিল্প গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
[5] ব্যাপক লাভের হাতছানি: ইউরােপীয় শিল্পপতিরা ভারতে সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ করে শিল্পোৎপাদন করত। উৎপাদিত পণ্য তারা ভারতে ও বিদেশের বাজারে বেশি দামে বিক্রয় করতে পারত বলে তাদের লাভের পরিমাণ অধিক হত। ভারতে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়ােগ করলে যে বিপুল পরিমাণ লাভ হবে তা দিয়েই পুনরায় নতুন শিল্পের পুঁজি গঠিত হবে। এই হিসাব কষেই বিদেশি শিল্পপতিরা এদেশে এসেছিল।
[6] শিল্পপণ্যের বাজার: ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে বিদেশি শিল্পজাত পণ্যের যে বিশাল চাহিদা ছিল তা লক্ষ করে ইউরােপীয় শিল্পোদ্যোগীরা এদেশে মূলধন বিনিয়ােগ করে।
[1] পটশিল্প: প্রথম দিকে ইউরােপীয় উদ্যোগ কেন্দ্রীভূত ছিল পাট ও কয়লা শিল্পে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার কাছে রিষড়ায় ভারতের প্রথম চটকলটি স্থাপন করেন জর্জ অকল্যান্ড নামে ব্রিটিশ বাণিজ্য সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক। ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এদেশে মােট পাটকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪টি। পাটশিল্পকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে গঠিত হয় জুট ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যাসােসিয়েশন (১৮৮৪ খ্রি.), যা ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান জুটমিলস অ্যাসােসিয়েশন নামে পরিচিতি লাভ করে।
[2] কয়লা শিল্প: কয়লা শিল্পে ইউরােপীয় উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানি, বরাকর কোল কোম্পানি, বেঙ্গল কোল কোম্পানি প্রভৃতি। রানিগঞ্জে প্রথম সংগঠিতভাবে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হয় (১৮৭০ খ্রি.)। ১৮৫৪ খ্রি. শুধুমাত্র বাংলা এবং বিহারে যেখানে কয়লাখনির সংখ্যা ছিল তিনটি, সেখানে ইউরােপীয় উদ্যোগে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ছাপ্পান্নটিতে।
[3] কাগজ শিল্প: ইউরােপীয় প্রচেষ্টায় হুগলি নদীর তীরে বালিতে প্রথম যন্ত্রোৎপাদিত কাগজের উৎপাদনও শুরু হয় (১৮৭০ খ্রি.)। এরপর লক্ষ্ণৌ (১৮৭৯ খ্রি.), টিটাগড় (১৮৮২ খ্রি.), রানিগঞ্জে (১৮৮৯ খ্রি.), কাগজকল স্থাপিত হয়। এ ছাড়াও পরবর্তী সময়ে ইউরােপীয় উদ্যোগে ভদ্রাবতীতে ‘মহীশূর পেপার মিল (১৯৩৯ খ্রি.), হায়দ্রাবাদে ‘শিবপুর পেপার মিল (১৯৪২ খ্রি.) গড়ে ওঠে।
[4] বাগিচা শিল্প: নীল, কফি, চা ইত্যাদি উৎপাদন শিল্পেও ইউরােপীয় প্রচেষ্টা স্মরণীয়। রবার্ট ব্রস প্রথম আসামের জঙ্গলে চা গাছ আবিষ্কার করেন (১৮২৩ খ্রি.)। অ্যান্ড্রু চার্লটন এদেশে প্রথম চা গাছ রােপণ করেন (১৮৩২ খ্রি.)। লুই বােনার প্রথম হুগলির চন্দননগরে নীল চাষ শুরু করেন (১৭৭৭ খ্রি.)। ব্রিটিশ প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘আসাম টি কোম্পানি (১৮৩৯ খ্রি.)। ইউরােপীয় মালিকানাধীনে নীলগিরি অঞ্চলে প্রথম কফি চাষ শুরু হয় (১৮২৩ খ্রি.)।
[5] চর্ম শিল্প: কোম্পানির প্রচেষ্টায় মাদ্রাজে দেশের বৃহত্তম চর্ম শিল্পকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮৫৫ খ্রি.)। সেনাবাহিনীকে জুতাে সরবরাহের লক্ষ্যে কানপুরে গড়ে ওঠে ‘হার্নেস অ্যান্ড স্যাডলরি ফ্যাক্টরি (১৮৬০)। চর্ম শিল্পের সামগ্রিক উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে সরকারি তরফে হাইডস সেস এনকোয়ারি কমিটি গঠন করা হয় (১৯৩০ খ্রি.)।
[6] লৌহ ইস্পাত শিল্প: ভারতে লৌহ-ইস্পাত শিল্পে ইউরােপীয় উদ্যোগপতিদের মধ্যে প্রথম অর্থ বিনিয়ােগ করেছিল মেসার্স মট অ্যান্ড ফারকুহার নামক একটি সংস্থা। মাদ্রাজের পাের্টানােভায় প্রথম ১৮৩০ খ্রি. জোসিয়া মাশাল হিথ নামে এক প্রাক্তন ইংরেজ কর্মচারীর উদ্যোগে প্রথম লৌহ-ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয়।
[7] বস্ত্র শিল্প: ভারতে কার্পাস বস্ত্র শিল্পকেন্দ্রটি প্রথম ইউরােপীয়দের উদ্যোগেই গড়ে ওঠে। ১৮১৮ খ্রি. গঠিত হয়েছিল হাওড়ার বাউরিয়া কটন মিল, ১৮৩০ খ্রি. ফরাসি উদ্যোগে পণ্ডিচেরিতে এবং ১৮৫৩ খ্রি. জেমস ল্যান্ডন নামে জনৈক ইংরেজ শিল্পপতিদের প্রয়াসে ব্রোচে একটি সুতাকাটার কল স্থাপিত হয়।
উপসংহার: প্রাক্ প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে এদেশে আধুনিক শিল্পবিকাশের গতি ছিল খুবই ধীর। রমেশচন্দ্র দত্তের মতে-ব্রিটিশ সরকারের অনুদার শিল্পনীতির ফলেই ভারতে শিল্পবিপ্লব ঘটেনি।
Leave a comment