সূচনা: ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের প্রত্যক্ষ শাসনভার গ্রহণ করে। এই সময় ভারতের প্রায়। ৬০ শতাংশ ভূখণ্ডে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অবশিষ্ট প্রায় ৪০ শতাংশ ভূখণ্ডে বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এই রাজ্যগুলি সাধারণভাবে ‘দেশীয় রাজ্য’ বা ‘Princely States’ নামে পরিচিত।

[1] স্বৈরশাসন: দেশীয় রাজ্যগুলিতে পাশ্চাত্যের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল না। সেখানে শাসকগণ নিজেদের স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করতেন। রাজ্যে চূড়ান্ত ক্ষমতা ও একাধিপত্য কেন্দ্রীভূত হত রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসক ও তার নিকট আত্মীয়দের হাতে। বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের স্বৈরাচারী শাসকগণ ওয়াদিয়ার (মহীশূরের শাসক), ছত্রপতি (মহারাষ্ট্রের ভোঁসলে সম্প্রদায়ের শাসক), নিজাম (হায়দ্রাবাদের শাসক), বাদশা, মহারাজা, রাজা, নবাব, ঠাকুর, ওয়ালি, ইনামদার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের মর্যাদাসূচক উপাধি গ্রহণ করতেন। তবে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন স্তরের দেশীয় শাসকদের সাধারণভাবে ‘রাজকুমার’ বা ‘প্রিন্স’ বলে অভিহিত করতেন।

[2] আয়তন: দেশীয় রাজ্যগুলির বিভিন্ন ধরনের আয়তন ছিল। কোনাে কোনাে দেশীয় রাজ্যের আয়তন ইউরােপের অনেক রাষ্ট্রের আয়তনের তুলনায় বড়াে ছিল। বৃহদায়তন দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল হায়দ্রাবাদ, জম্মু ও কাশ্মীর, মহীশূর, বরােদা প্রভৃতি। সর্ববৃহৎ দেশীয় রাজ্য হায়দ্রাবাদের আয়তন ছিল ৮২,৬৯৮ বর্গ কিলােমিটার। বড় রাজ্যগুলি ছাড়াও অধিকাংশ দেশীয় রাজ্যের আয়তন ছিল খুবই ছােটো বা মাঝারি ধরনের। তাদের জনসংখ্যাও ছিল খুবই কম।

[3] তােপধ্বনি: দেশীয় রাজ্যের শাসকগণ ব্রিটিশ সামরিক বিভাগের বিভিন্ন স্তরে নিযুক্ত হওয়ার যােগ্য বলে বিবেচিত হতেন। কোনাে শাসক ভারতের রাজধানীতে এলে ব্রিটিশ সামরিক বিভাগ তােপধ্বনি বা গান স্যালুট-এর মাধ্যমে তাকে সম্মান দিত। বিভিন্ন স্তরের দেশীয় শাসকের জন্য ৩ থেকে ২১ বার পর্যন্ত তােপধ্বনির ব্যবস্থা ছিল। তােপধ্বনির সংখ্যা নির্দিষ্ট হত দেশীয় রাজ্যের রাজকোশের সমৃদ্ধি, শাসকের বংশকৌলীন্য, ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি বিচারের মাধ্যমে। বেশি মর্যাদাসম্পন্ন শাসকের জন্য বেশি তােপধ্বনি করা হত। অবশ্য মাত্র ১২০টি দেশীয় রাজ্যের জন্য তােপধ্বনির ব্যবস্থা ছিল।

[4] প্রজাদের দুরবস্থা: দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের অবস্থা মােটেই ভালাে ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্থ প্রজাদের তুলনায় দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের ওপর করের বােঝা সাধারণভাবে বেশি ছিল। প্রজাদের কাছ থেকে শােষণ করা অর্থ শাসকগণ নিজেদের বিলাসব্যসনে অকাতরে ব্যয় করত। এসব রাজ্যের নাগরিকরা ব্রিটিশ ভারতের তুলনায় কম নাগরিক অধিকার বা আইনের শাসন ভােগ করত।

[5] অনগ্রসরতা: বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশ ভারতের তুলনায় প্রায় সবদিক থেকে অনগ্রসর ছিল। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক, শিক্ষাগত প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশীয় রাজ্যগুলি ছিল পশ্চাদপদ। নিজেদের আত্মরক্ষার পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি তাদের ছিল না।

[6] অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রয়ােগ: দেশীয় রাজ্যগুলিতে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বড়ােলাট লর্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রবর্তন করেন। হায়দ্রাবাদ, সুরাট, তাঞ্জোর, কর্ণাটক, অযােধ্যা প্রভৃতি বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য বাধ্য হয়ে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য জানায়। এভাবে ব্রিটিশ সরকারের হাতে নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা তুলে দিয়ে দেশীয় রাজারা নিজেদের হাতে শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

[7] স্বত্ববিলােপ নীতির প্রয়ােগ: ভারতের ব্রিটিশ শাসক বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলােপ নীতি প্রয়ােগ করে সাতারা, জয়েৎপুর, সম্বলপুর, উদয়পুর, ঝাসি, নাগপুর প্রভৃতি বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

[8] স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়াস: সরকারি হিসেব অনুসারে স্বাধীনতা লাভের প্রাক্ মুহূর্তে ভারতে অন্তত ৫৬৫ টি দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই ভারতের স্বাধীনতা আইন’-এ দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজেদের ইচ্ছানুসারে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় অথবা ভারত বা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার দেওয়া হয়।

উপসংহার: স্বাধীনতা লাভের পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ঘােষণা করেন যে, ভারতের ভৌগােলিক সীমার মধ্যে কোনাে স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করা হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দৃঢ়তার সঙ্গে বেশ কয়েকটি দেশীয় রাজ্যে সামরিক অভিযান চালিয়ে সেগুলিকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যােগ দিতে বাধ্য করেন।