সূচনা: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত শাসন-সংক্রান্ত বিষয়ে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি ২০ বছর অন্তর চার্টার অ্যাক্ট বা সনদ আইন পাস করে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে থাকে।

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন

প্রেক্ষাপট: ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন ব্রিটিশ ভারতের শাসনব্যবস্থা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে একটি বিল পাস করেন। যেটি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের (২ আগস্ট) ভারত শাসন আইন (Government of India Act, 1858) নামে পরিচিত।

শর্তাবলি: ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন অনুসারে- [a] ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। [b] ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ সরকার অর্থাৎ ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে গ্রহণ করেন। [c] ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া বা ভারত-সচিব নামে ভারত বিষয়ক একজন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ইংল্যান্ডে অবস্থান করে পরােক্ষভাবে ভারতের শাসন পরিচালনা করেন। [d] ১৫ সদস্যবিশিষ্ট ইন্ডিয়া কাউন্সিল’ গঠন করে ভারত-সচিবের কাজে সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়। [e] রানির প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের গভর্নর-জেনারেল-কে প্রত্যক্ষভাবে ভারত শাসনের অধিকার দেওয়া হয়। [f] এখন থেকে গভর্নর-জেনারেলের উপাধি হয় ভাইসরয়। লর্ড ক্যানিং ভারতের প্রথম ভাইসরয় হিসেবে নিযুক্ত হন।

মূল্যায়ন: [a] ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা ভারত-সচিবের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। ফলে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় সম্পদশালী ব্রিটিশদের প্রভাব বাড়ে। [b] এই আইনে শাসনকার্যে ভারতীয়দের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন

প্রেক্ষাপট: ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের ত্রুটিগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন পাস করে।

শর্তাবলি: ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন অনুসারে- [a] বড়ােলাটের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে ৬ থেকে ১২ জন সদস্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এর অর্ধেক হবে ইংরেজ ও ভারতীয়দের সমন্বয়ে বেসরকারি সদস্য। [b] কেন্দ্রের আইন পরিষদের মতাে বাংলা, বােম্বাই এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রাদেশিক আইন পরিষদ গঠিত হয়। [c] বড়ােলাটের সম্মতিপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের কোনাে আইন ভারত-সচিব নাকচ করতে পারতেন।

মূল্যায়ন: [a] ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভা গড়ে ওঠেনি। [b] অবশ্য এই আইনেই সর্বপ্রথম আইন রচনার কাজে ভারতীয়দের যােগদানের অধিকার দেওয়া হয়।

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন

প্রেক্ষাপট: ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের আইনের দ্বারা ভারতীয়দের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। ভারতীয়রা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় অধিক সংখ্যক নির্বাচিত প্রতিনিধি গ্রহণের দাবি জানাতে থাকে। এর ফলে সরকার ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন পাস করে।

শর্তাবলি: ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে বলা হয়, [a] বড়ােলাটের আইন পরিষদে ১০ থেকে ১৬ জন অতিরিক্ত সদস্য থাকবেন। [b] আইন পরিষদের ২/৫ অংশ বেসরকারি সদস্য হবেন। [c] এই সদস্যদের ৫ জন নির্বাচিত এবং বাকিরা বড়ােলাটের দ্বারা মনােনীত হবেন।

মূল্যায়ন: [a] ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা ভারতীয়রা প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার পায়নি। [b] ভারতীয়রা শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রকৃত অধিকার পায়নি। [c] অবশ্য এই আইনের মাধ্যমে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘােষ, গােপালকৃয় গােখলে প্রমুখ কেন্দ্রীয় আইনসভায় পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হন।

উপসহার: ভারত শাসন আইনগুলি ভারতীয়দের ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবি পূরণে কখনও আন্তরিক ছিল না। এই আইনগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের স্বার্থরক্ষা এবং এদেশে ব্রিটিশ শাসন ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা, ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা করা নয়।