সূচনা: উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত যেসব শিল্পে দেশীয় পুঁজির বিনিয়ােগ শুরু হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল বস্ত্র, পাট, চা, কয়লা, লৌহ ইস্পাত, ইঞ্জিনিয়ারিং ও রাসায়নিক শিল্প।

[1] বস্ত্র শিল্পোদ্যোগের কারণ : বস্ত্র শিল্পে দেশীয় উদ্যোগের উল্লেখযােগ্য কারণগুলাে নিম্নরূপ一

  • [a] ভৌগােলিক সুবিধা নিয়ে বােম্বাই ও গুজরাটের পারসি এবং মাড়ােয়ারি ব্যবসায়ীরা তাদের মূলধন বিনিয়ােগ করার জন্য বস্ত্র শিল্পকেই সবার আগে বেছে নেয়। 

  • [b] গুজরাট ও বােম্বাই অঞ্চলে প্রথম রেলপথের সূচনার সুবিধাকে কাজে লাগায় দেশীয় বস্ত্র শিল্পপতিরা। 

  • [c] বস্ত্র শিল্পের প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল তুলাের চাষ দক্ষিণ ভারতে বেশি হওয়ায় দেশীয় শিল্পপতিরা বস্ত্র শিল্পে মূলধন বিনিয়ােগে উৎসাহী হয়ে ওঠে। 

  • [d] পারসি বস্ত্র ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই আফ্রিকা ও চিনের সঙ্গে তুলাের ব্যাবসা গড়ে তুলেছিল বলে তারা সেই অভিজ্ঞতা ভারতের বস্ত্রশিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজে লাগায়।

বস্ত্র শিল্প স্থাপন: 

  • [a] ভারতীয় উদ্যোগে বােম্বাইয়ে প্রথম ভারতের বৃহত্তম বস্ত্রশিল্প ‘বােম্বে স্পিনিং অ্যান্ড উইভিং কোম্পানি স্থাপন করেন ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। পারসি শিল্পপতি কাউয়াসজি নানাভাই দাভর। 

  • [b] রণছােড়লাল ছেপটলাল নামে এক গুজরাতি ব্রাহ়মণ আমেদাবাদে একটি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৫৯ খ্রি.)। 

  • [c] পারসি শিল্পপতি জামশেদজি টাটার উদ্যোগে নাগপুরে স্থাপিত হয় ‘এম্প্রেস মিল’ (১৮৭৭ খ্রি.)।

বস্ত্র শিল্পের প্রসার: ভারতীয় উদ্যোগে কাপড়ের কলের সংখ্যা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে ‘বয়কট’ ও ‘স্বদেশি’ আন্দোলনের প্রভাবে দেশে সুতিবস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে এই শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। দেখা গেছে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে যেখানে কাপড়ের কলের মােট সংখ্যা ছিল ৫৮টি, সেখানে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ২০৬টিতে। ওই কলগুলিতে প্রায় দুই লক্ষ শ্রমিক কাজ করত।

[2] পাট শিল্প: ভারতীয় উদ্যোগে পাট শিল্পে প্রথম (১৯২১ খ্রি.) অর্থ বিনিয়ােগ করেন মাড়ােয়ারি শিল্পপতি বিড়লা, এরপর বিনিয়ােগ করেন স্বরূপচাঁদ হুকুমচঁাদ (১৯২২ খ্রি.)। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারত থেকে আনুমানিক ২ কোটি ৫ লক্ষ টাকার পাটজাত দ্রব্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।

[3] চা শিল্প: চা শিল্পেও ভারতীয় পুঁজির বিনিয়ােগ শুরু হয়। আসাম টি কোম্পানিতে পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ বিনিয়ােগের পাশাপাশি ভারতীয় পুঁজিরও বিনিয়ােগ শুরু হয়। সম্পূর্ণ দেশীয় উদ্যোগে জয়চাদ সান্যাল জলপাইগুড়ি টি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে (১৮৭৮ খ্রি.)। এর পাশাপাশি মােতিলাল শীল, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মির্জা ইস্পাহানি প্রমুখ চা শিল্পে পুঁজি বিনিয়ােগ করেন।

[4] কয়লা শিল্প: কয়লা শিল্পে দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত কার অ্যান্ড টেগাের কোম্পানি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নেয়। তার এই উদ্যোগের পরেই রানিগঞ্জ, আসানসােল, বরাকর, সীতারামপুর প্রভৃতি অঞ্চলে দেশীয় উদ্যোগে কয়লাখনিতে পুঁজি বিনিয়ােগ শুরু হয়। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, দেশীয় উদ্যোগে বর্ধমানের রানিগঞ্জ, আসানসােল, বরাকর, অণ্ডালসহ বিভিন্ন স্থানে ৪০টি এবং মানভূম, ছােটোনাগপুর জেলায় ৬২টি ছােটো কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। দেশীয় মালিকানাধীন এইসব কয়লাখনি নিয়ে ইন্ডিয়ান মাইনিং ফেডারেশন গঠিত হয়।

[5] লৌহ-ইস্পাত শিল্প: বাঙালি শিল্পপতি কিশােরীলাল মুখােপাধ্যায় ও রাজেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় ছাড়াও অবাঙালি নওয়াল কিশাের, পারসি শিল্পপতি জামশেদজি টাটা ভারতে লৌহ ইস্পাত শিল্প বিকাশের ব্যাপারে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে কিশােরীলাল মুখােপাধ্যায় ছােটো ছােটো যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য হাওড়ার শিবপুরে একটি লৌহ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাঙালি প্রযুক্তিবিদ রাজেন্দ্রনাথ ও ইংরেজ প্রযুক্তিবিদ মার্টিন যৌথভাবে মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি (১৮৯২ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করে হাওড়া-আমতা রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এই সময় লক্ষ্ণৌতে জামশেদজি টাটার উদ্যোগে ও বাঙালি প্রযুক্তিবিদ প্রমথনাথের সহযােগিতায় ১৯০৭ খ্রি. বিহারের জামশেদপুরে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। জামশেদজি টাটার দুই পুত্র দোরাবজি এবং রতনজি পিতার তৈরি করা টাটা কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন করিয়ে লৌহ ইস্পাত শিল্পের ক্ষেত্রে নিজেদের কোম্পানিকে একচেটিয়া কর্তৃত্বের অধিকারী করে তােলেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখানে উন্নতমানের লৌহপিণ্ড এবং ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশুদ্ধ ইস্পাত-পিণ্ড উৎপাদন শুরু হলে ভারতে লৌহ ইস্পাত শিল্পে যুগান্তর আসে।

[6] ইঞ্জিনিয়ারিং ও রাসায়নিক শিল্প: ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার মার্টিনের সঙ্গে একযােগে বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। এই কোম্পানির প্রচেষ্টাতেই প্রথম হাওড়া থেকে আমতা রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে (১৮৯৭ খ্রি.)। এ ছাড়াও হাওড়া থেকে শিয়াখালা লাইট রেলপথ (১৮৯৮ খ্রি.) গড়ে তােলে এই কোম্পানি। মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই একটি জাহাজ নির্মান কারখানা গড়ে তােলেন (১৯১১ খ্রি.)। রাসায়নিক শিল্পের ক্ষেত্রে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। এ ছাড়াও ড. নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা গড়ে তােলেন।

উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে দেশীয় উদ্যোগে শিল্পের প্রসার জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তিকে অনেকটাই দৃঢ় করেছিল।

ডালহৌসির রেলপথ বিস্তার নীতি আলােচনা করাে।

ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে রেলপথ বিস্তার নীতি আলােচনা করাে।

দ্বৈত শাসন কী? এর গুরুত্ব আলােচনা করাে।

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে ইউরােপীয় উদ্যোগে শিল্পের বিকাশের বিবরণ দাও।