সূচনা: দক্ষিণ ভারতের কেরালায় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা হিন্দু মন্দিরে প্রবেশ এবং মন্দির-সংলগ্ন পথ-সহ অন্যান্য কিছু পথে যাতায়াত করার অধিকার পেত না। সেখানে ইঝাবা ও পুলায়া নামে দলিত হিন্দুরা উচ্চবর্ণের মানুষদের যথাক্রমে ১৬ ফুট ও ৭২ ফুটের চেয়ে কাছে আসতে পারত না। এভাবে তারা ‘তিনদাল’ বা দূরবর্তী দূষণের শিকার হয়েছিল।

[1] ভাইকম সত্যাগ্রহ

  • কংগ্রেসের ভূমিকা: কংগ্রেসের কাকিনাড়া অধিবেশনে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর কেরালা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি (কে.পি.সি.সি.) অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার এবং হিন্দু মন্দির ও জনপথগুলি অবর্ণ বা হরিজনদের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করার উদ্যোগ নেয়।

  • ভাইকম গ্রামে প্রতিবাদ: কেরালার ত্রিবাঙ্কুরের ভাইকম গ্রামে একটি বড়াে মন্দিরের চারদিকে ছিল রাস্তা। ইঝাবা, পুলায়া প্রভৃতি নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এই মন্দিরে প্রবেশ বা মন্দির-সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে হাঁটার অধিকার পেত না। এই গ্রাম থেকেই কংগ্রেস অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে।

  • সত্যাগ্রহের সূচনা: কেরালা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ ভাইকমের মন্দির সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের একটি মিছিল বের করার উদ্যোগ নেয়। এবিষয়ে সবর্ণদের নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তুলতে জোর কদমে প্রচার অভিযান চালানাে হয়। ‘নায়ার সার্ভিস সােসাইটি’, ‘নায়ার সমাজম’, ‘কেরালা হিন্দুসভা’ প্রভৃতি সবর্ণ (বৰ্ণহিন্দু) সংগঠনগুলি এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। নাম্বুদিরি নামে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাত্মণদের প্রধান সংগঠন যােগক্ষমা সভা মন্দিরের দরজা অবর্ণদের জন্য খুলে দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে।

  • আন্দোলনকারীদের মিছিল: মন্দিরের দিকে আন্দোলনকারীদের অগ্রগতি আটকাতে মন্দির কর্তৃপক্ষ ও ত্রিবাঙ্কুর সরকার মন্দিরমুখী সব রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে। সত্যাগ্রহীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে ওঠার পরিস্থিতিতে ভাইকম সত্যাগ্রহ সারা দেশে প্রবল উন্মাদনা সৃষ্টি করে। আন্দোলনে যােগ দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকরা আসতে থাকে। ৩০ মার্চ সত্যাগ্রহ শিবির থেকে কেশব মেননের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। মিছিল ক্ৰমে ভাইকমের মন্দিরের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ মিছিল আটকে দেয় এবং বহু আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

  • আন্দোলনে ব্যর্থতা: তীব্র আন্দোলন সত্ত্বেও ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ ভাইকম মন্দিরের দরজা অবর্ণ হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি।

[2] পরবর্তী আন্দোলন: সত্যাগ্রহ আন্দোলনের দ্বারা ভাইকম মন্দিরের দরজা অবর্ণ হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব না হলেও দলিত মানুষের সামাজিক সাম্যপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেমে থাকেনি। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকে।

  • মহারানির কাছে আবেদন: গান্ধিজি মহারানি ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের সঙ্গে দেখা করে একটি আপসরফা করেন। ফলে মন্দিরের অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলি ছাড়া চারপাশের রাস্তাগুলি অবর্ণ হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

  • গুরুবায়ুর মন্দিরে সত্যাগ্রহ: কেরালার গুরুবায়ুর মন্দিরে অবর্ণদের প্রবেশের দাবিতে কবি সুব্রমনিয়ান তিরুমান্বুর-এর নেতৃত্বে ১৬ জনের একটি সত্যাগ্রহী দল ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে (২১ অক্টোবর) গুরুবায়ুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। প্রচুর যুবক আন্দোলনে যােগ দেয়। সমগ্র কেরালায় ‘মন্দির প্রবেশ দিবস’ (১ নভেম্বর) পালিত হয়। প্রার্থনা, মিছিল, অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি চলতে থাকে।

  • কেলাপ্পান ও গােপালনের আন্দোলন: অবর্ণ হিন্দুদের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার দাবিতে কে. কেলাপ্পান ও এ. কে. গােপালনের নেতৃত্বে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে (নভেম্বর) আন্দোলন আবার জোরদার হয়ে ওঠে। সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য মন্দিরের দরজা না খােলা পর্যন্ত তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে অনশন শুরু করেন। কেলাপ্পান শেষ পর্যন্ত গান্ধিজির অনুরােধে অনশন ভাঙলেও এই আন্দোলন সারা দেশে আবার আলােড়ন সৃষ্টি করে। গােপালন সারা কেরালায় প্রচার করে আন্দোলন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেন।

  • আন্দোলনের জয়: দীর্ঘ আন্দোলনের পর অবর্ণ হিন্দুদের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া সম্ভব হয়। ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জাতপাত-নির্বিশেষে সমস্ত হিন্দুদের জন্য সরকার-নিয়ন্ত্রিত সব মন্দির খুলে দেওয়ার কথা ঘােষণা করেন। চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারির নেতৃত্বে মাদ্রাজ মন্ত্রীসভা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সকলের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কংগ্রেস শাসিত অন্যান্য প্রদেশগুলিতেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

উপসংহার: ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভেদ জিইয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই সরকার নিম্নবর্ণের মানুষদের মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ নেয়নি। বরং সরকারের পুলিশ অনেক সময় মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন দমন করে সবর্ণ ও অবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল।