প্রশ্নঃ বাংলাদেশে ব্রিটিশ শাসনবিরােধী আন্দোলনে শহীদ তিতুমীরের ভূমিকা আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজী আন্দোলন হিন্দু জমিদার শ্রেণিকে আতঙ্কিত করে তােলে। কারণ বাংলার মাটি থেকে সকল প্রকার জুলুম অত্যাচারের মূলােৎপাটনে যে কয়জন সগ্রামী নেতা হিন্দু জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলেন, শহীদ তিতুমীর তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের পথিকৃৎ। নিজের দেশকে বিদেশি শাসক ইংরেজদের গােলামির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি সর্বাত্মক জেহাদ ঘােষণা করেছিলেন।

ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে শহীদ তিতুমীরের ভূমিকাঃ

১. ইসলামের মূলনীতির ওপর শাসন কায়েমঃ তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ব্রিটিশ শাসকদের অনৈসলামিক কার্যাবলি তার হৃদয়ে চরমভাবে রেখাপাত করে। অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের ইসলামবিরােধী কার্যাবলি প্রতিরােধ করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন এবং তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জেহাদ ঘোষণা করেন।

২. জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামঃ সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা মােকাবেলার জন্য তিতুমীর অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের পদলেহী জমিদার, হার্জন ও নীলকরদের শােষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি ১৮১৫ সালে সর্বপ্রথম হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

৩. জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনঃ তৎকালীন জমিদাররা ইংরেজদের ছত্রছায়ায় মুসলমানদের ওপর বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন চালাত। যেমন কৃষ্ণদেব রায় মুসলমানদের দাড়ির ওপর আড়াই টাকা কর ধার্য করে। এতে মুসলমানরা তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়। তিতুমীর কৃষ্ণদেবের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেন।

৪. আলেকজান্ডারের পরাজয়ঃ তিতুমীরের আন্দোলন ক্ষিপ্রতার সাথে অগ্রসর হতে থাকলে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ভীত হয়ে বারাসাতের তৎকালীন ম্যাজিটে আলেকজান্ডারের সাহায্য প্রার্থনা করে। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ বাহিনী নিয়ে তিতুমরিকে দান করতে গিয়ে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

৫. বাঁশের কেল্লা স্থাপনঃ ভারত উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনার জন্য ১৮৩১ খিস্টাব্দে তিতুমীর বারাসাতের অদূরে নারিকেলবাড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন।

৬. জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযােগ দায়েরঃ তিনি অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে অভিযােগ দায়ের করেন। এতে কয়েকজন জমিদার সদলবলে তিতুমীরকে আক্রমণ করে। অপূর্ব বীরত্ব ও দক্ষতার সাথে তিতুমীর এ সম্মিলিত আক্রমণ নস্যাৎ করে দেন। ফলে জমিদাররা পরাজিত হয়।

৭. কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেট-এর পরাজয়ঃ ১৮২৯ সালের নভেম্বরে কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেট ৩০০ সৈন্য নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে। তিতুমীরের বাহিনী তাদেরও পরাজিত এবং বিতাড়িত করতে সক্ষম হন।

৮. স্বাধীনতা ঘােষণাঃ তিতুমীরের নিকট জমিদাররা পরাজিত হলে তিনি চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুরের কিয়দংশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।

৯. নারিকেলবাড়িয়ার যুদ্ধঃ তিতুমীর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুরের স্বাধীনতা ঘােষণা করে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘােষণা করেছেন এ সংবাদ অবগত হয়ে একদল ইংরেজ সৈন্য তিতুমীরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। অতঃপর কর্নেল স্টুয়ার্টের অধীনে একদল শক্তিশালী ইংরেজ সৈন্য কামান নিয়ে অগ্রসর হয়। তিতুমীর বাঁশের লাঠির সাহায্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর বহু অনুচরসহ শাহাদাত বরণ করেন। ইংরেজদের কামানের গােলার আঘাতে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়।

উপসংহারঃ তিতুমীরের মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলাদেশে ব্রিটিশ শাসনবিরােধী প্রতিরােধ সংগ্রামের সাময়িক অবসান হলেও এ দেশবাসীর প্রতিরােধ চেতনা আদৌ অবদমিত হয়নি। শহীদ তিতুমীরের আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে বিফল হলেও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সগ্রামে বঙ্গীয় মুসলিম সমাজে বিশেষ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তাই তার নিষ্ঠা কর্তব্যবােধ, আদর্শিক অনুরাগ, বীরত্ব, দেশপ্রেম চিরদিন বাংলার মুসলমানদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।