ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে ইউরােপীয়দের উদ্যোগে সর্বপ্রথম শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭ খ্রি.) পর থেকে ভারতে শিল্পায়নের অগ্রগতি শুরু হয়।

[1] সস্তা কাঁচামাল: যে-কোনাে দেশে শিল্পের বিকাশের জন্য সস্তায় ও পর্যাপ্ত পরিমাণে শিল্পের প্রয়ােজনীয় কাঁচামালের সরবরাহ থাকা দরকার। ভারত ছিল মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে শিল্পের প্রয়ােজনীয় তুলাে, পাট, চা, আখ প্রভৃতি কৃষিপণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হত। এসব কাঁচামাল সস্তায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়ার ফলে বিদেশি পুঁজিপতিরা ভারতে শিল্প স্থাপনে খুবই আগ্রহী ছিল।

[2] সুলভ শ্রমিক: শিল্পে প্রতিযােগিতার বাজারে উৎপাদন ব্যয় কমানাে খুব প্রয়ােজন। ভারতে খুব অল্প মজুরিতে শিল্পের কাজে নিয়ােগ করার মতাে প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যেত। ফলে এদেশে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কম হত।

[3] পুঁজির জোগান: শিল্প স্থাপনের জন্য প্রচুর মূলধনের জোগান। প্রয়ােজন। ভারতে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ শিল্পপতিরা সহজ সুদে ঋণ পেত। ভারতীয়রা এরূপ সুবিধা পেত না।

[4] পণ্যের চাহিদা: ভারতে ইউরােপীয়দের শিল্প কারখানায়। উৎপাদিত শিল্পপণ্যের চাহিদা ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে যথেষ্টই ছিল যা শিল্পপতিদের শিল্প প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করেছিল।

[5] বিপুল লাভের আশা: ব্রিটিশ পুজিপতিরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইংল্যান্ডের তুলনায় ভারতে শিল্প স্থাপনে পুঁজি বিনিয়ােগ তাদের পক্ষে বেশি লাভজনক ও নিরাপদ।

[6] সহায়তা: ব্রিটিশ শিল্পপতিরা ভারতে শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পেয়েছিল। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল ব্রিটেন থেকে যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানি, বিদেশি বিমা কোম্পানি ও সরকারি কর্মচারীদের পৃষ্ঠপােষকতা প্রভৃতি।

ব্রিটিশ শিল্পপতি ও ভারতের ইংরেজ বণিকরা মনে করত যে, ভারতে দেশীয় উদ্যোগে আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটলে ভারতের বাজার ও কাঁচামাল তাদের হাতছাড়া হবে। এজন্য তারা নানা উপায়ে ভারতীয় উদ্যোগে এদেশে শিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত।

[1] শুল্ক সমস্যা: ভারতের ব্রিটিশ সরকার ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা সুতিবস্ত্রের ওপর নামমাত্র শুল্ক আরােপ করলেও বিলাতে রপ্তানি করা ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর বিপুল পরিমাণ শুল্ক চাপিয়েছিল। ফলে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের মূল্য অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং প্রতিযােগিতায় পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

[2] পরিবহণে বৈষম্য: রেলে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের তুলনায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা রেলে পণ্য পরিবহণের সময় বেশি মাশুল দিতে বাধ্য হত। তথাপি উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে যে শিল্পোদ্যোগ শুরু হয়, তাতে ব্রিটিশ পুঁজির প্রাধান্য থাকলেও ভারতীয় পুঁজি একেবারে পিছিয়ে ছিল না।

[3] সংরক্ষণ নীতির অভাব: ভারতীয়দের শিল্পোদ্যোগকে বিদেশি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযােগিতার হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারের উচিত ছিল শুল্ক সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করা। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এরূপ কোনাে উদ্যোগ নিয়ে ভারতীয় মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পকে রক্ষার কোনাে চেষ্টা করেনি। ফলে সস্তা বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় ভারতীয় শিল্পপতিদের শিল্পপণ্য পিছিয়ে পড়ে।

[4] লাইসেন্স-এর সমস্যা: ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা শিল্প স্থাপনের জন্য সরকারের কাছ থেকে সহজেই লাইসেন্স পেয়ে যেত। কিন্তু সরকার ভারতীয় শিল্পগুলিকে লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে টালবাহনা করত।

[5] মূলধনের অভাব: ইউরােপীয় পুঁজিপতিদের মতাে বিপুল পরিমাণ মূলধন বিনিয়ােগ করে এদেশে শিল্প স্থাপনের সামর্থ্য অধিকাংশ ভারতীয় পুঁজিপতিদের ছিল না। তাদের অধিকাংশেরই মূলধন ছিল সীমিত।

[6] ব্যাংক ঋণের সমস্যা: ভারতীয় শিল্পপতিরা শিল্প স্থাপনের জন্য ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পেত না। তাদের ঋণ দেওয়া হলেও সুদের হার ছিল খুব বেশি।

[7] বিনিয়ােগে অনীহা: ভারতীয় পুঁজিপতিদের বেশিরভাগই শিল্প স্থাপনের জন্য খুব বেশি পুঁজি বিনিয়ােগে অনীহা দেখাত। তারা শিল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়ােগের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পেত না।