উত্তর : বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে মৈথিলি, হিন্দি এবং বাংলার মিশ্রণে একপ্রকার কৃত্রিম সাহিত্য ভাষা সৃষ্টি হয়েছিল। এই মিশ্রিত ভাষা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘ব্রজবুলি’ নামে পরিচিত। বিশেষত বিদ্যাপতির পদগুলো ব্রজবুলিতেই রচিত। তাছাড়া এই ধারণার পশ্চাতে অনেক পণ্ডিত যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করেন বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণ সম্ভবত এই ভাষাতেই কথা বলতেন।

অর্থাৎ তাঁদের মতে ব্রজবুলি অর্থ ব্রজের বা রাখালের বুলি। প্রকৃতপক্ষে মৈথিলি কবি বিদ্যাপতির পদের ভাব ও ভাষার অনুসরণে বাংলা, উড়িষ্যা ও আসামে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রজবুলি ভাষার সৃষ্টি হয়। মৈথিলি ভাষার ক্রমরূপান্তর হিসেবে এ ভাষার বিকাশ। ব্রজবুলি কখনো মুখের ভাষা ছিল না; সাহিত্যকর্ম ব্যতীত অন্যত্র এর ব্যবহারও নেই। এই কবিভাষা বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্যবহৃত হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

ব্রজবুলির ‘কয়েকটি বৈশিষ্ট্য:

  1. তিনটি শ,ষ, স-এর পরিবর্তে একটিমাত্র ‘স’ এর ব্যবহার।
  2. ব্যঞ্জনধ্বনির বর্জন ও স্বরধ্বনির ব্যবহার প্রবণতা।
  3. ভিন্ন দুই যুক্ত ব্যঞ্জন অনেক সময় এক ব্যঞ্জনের দ্বিত্বে রূপান্তরিত হয়েছে।
  4. অনেক সময় দুই যুক্ত ব্যঞ্জনের একটি লোপ পেয়েছে।
  5. আনুনাসিক উচ্চারণ কম।
  6. সম্প্রদানের পৃথক রূপ নেই।
  7. তৎসম ও তদ্ভব শব্দই বেশি ব্যবহৃত।

বৈষ্ণব সাহিত্য এক সময় এ দেশের জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মনে সাহিত্য রসের আবেদন সৃষ্টি করেছিল। বৈষ্ণব সাহিত্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। মৈথিলি ও বাংলার সংমিশ্রণে ব্রজবুলি ভাষায় অসাধারণ ধ্বনিসাম্য ও ধ্বনি ঝংকারের সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যাপতির প্রভাবে বাংলাদেশে পদাবলী রচনা ব্রজবুলি ভাষা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ব্রজবুলি নামটি প্রথম কিভাবে সাধারণ্যে পরিচিত হয়েছে তা বলা কঠিন। ব্রজধাম-বৃন্দাবন অঞ্চলে যে আঞ্চলিক হিন্দিভাষা ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে এই ভাষার একেবারেই মিল নেই। দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন:

“এ ভাষা মৈথিলি ভাষার অনুকরণে সৃষ্ট। প্রাকৃতপৈঙ্গলে এ ভাষার প্রাথমিক নমুনা আছে। তবে বিদ্যাপতির পদ প্রচারে এই ভাষা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক পদে এই ভাষা ব্যবহৃত হয় এবং ব্রজ বা বৃন্দাবন রাধাকৃষ্ণের লীলাস্থলী, এই জন্যই বোধ হয় এই ভাষার নাম ব্রজবুলি হইয়াছে। বৃন্দাবনেও বাংলা ও হিন্দির সংমিশ্রণে উৎপন্ন একপ্রকার ভাষা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সে ভাষার সহিত পদাবলী প্রচলিত ব্রজবুলির সম্বন্ধ নাই। মৈথিলী, হিন্দি, উড়িয়া এবং অসমীয়া ভাষার প্রভাব পদাবলীতে যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়।”

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ব্রজবুলি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন এভাবে:

“A curious jargon, a mixed Maithili and Bengali with a few western Hindi form….entirely different from the Western Hind. dialect, called Braja-bhakha, current round about Mathura.”

ব্রজবুলির ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে চৈতন্য পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে। বাঙালি বিদ্যাপতি মিথিলার বিদ্যাপতির যোগ্য উত্তরসাধক। তাঁর অতি উৎকৃষ্ট কিছুসংখ্যক ব্রজবুলি পদের নিদর্শন মেলে। সপ্তদশ শতকে কবি গোবিন্দদাস ব্রজবুলিতে বহুসংখ্যক প্রথমশ্রেণির পদ রচনা করেন। জ্ঞানদাস, বলরামদাস, জগদানন্দ, রাধামোহন, রায়শেখর প্রভৃতি পদকারদের নাম এ প্রসঙ্গে চলে আসে। তবে বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্রজবুলি ভাষার প্রবর্তক বিদ্যাপতি। তবে নানাকারণে মিথিলায় সে ধারা বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেনি। ব্রজবুলিতে-রচিত পদের নমুনা এখানে দেওয়া হলো;

১. কণ্টক গাড়ি কমল সম পদতল

মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।

গাগরী বারী ঢারি করু পিছল

চলতহি অঙ্গুলি চাপি। -গোবিন্দদাস

২. নন্দ নন্দন চন্দ চন্দন

গন্ধ নিন্দিত অঙ্গ।

জলদ সুন্দর কম্বু কন্ধর

নিন্দি সিন্ধুর ভঙ্গ। -গোবিন্দদাস।

পনেরো শতকেই মিথিলা, বাংলা, আসাম, উড়িষ্যা প্রভৃতি প্রদেশে পদাবলী রচনার রীতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। বাংলাদেশই ব্রজবুলি রচনার উর্বর ক্ষেত্র। সাহিত্য রচনার এই বিশেষ রীতি পদাবলী সাহিত্যকে করেছে ব্যঞ্জনাদীপ্ত ও বৈচিত্র্যময়।