ইতালীয় ‘বালারে’ শব্দ থেকে ‘ব্যালাড’ শব্দটির উৎপত্তি। যার আক্ষরিক অর্থ নাচা, ফলে মানতেই হয় উৎপত্তি সূত্রে ব্যালাডের সঙ্গে নৃত্যের একটি সংযোগ ছিল। আধুনিককালে • যে জনপ্রিয় নৃত্যানুষ্ঠান ব্যালে (ballet) এ থেকেই এসেছে। সুতরাং আখ্যান, নৃত্য এবং সংগীত এই নিয়েই ব্যালাড, বাংলায় এই ধরনের আখ্যান কাব্যকে বলা হয় গাথাকবিতা।
সমালোচক হার্ডসনের মতে ‘ব্যালাড হল সবচেয়ে প্রাচীন কাব্য কল্প। সমস্ত সাহিত্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর আবির্ভাব ঘটে। সেই সঙ্গে একথা স্বীকার করতে হয় ব্যালাড এখন একটি নির্দিষ্ট পরিভাষায় পরিণত হয়েছে। তবে বিশেষ কোনো সাহিত্যে একে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন নয়। প্রথাগতভাবে যাকে ব্যালাড বলে তা মধ্যযুগের ইংল্যান্ড বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অজ্ঞাত নানা রচয়িতাদের হাতে যে সব গাথা কবিতা লেখা হয়েছিল তা মূলত ব্যালাড নামেই অভিহিত। জীবনের মৌলিক দিকগুলিই এর বিষয়বস্তু। যেমন বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হত যুদ্ধ বিগ্রহ বা রোমাঞ্চকর কার্যকলাপের উপর। অবশ্য তা বলে প্রেম, করুণা, শোক প্রভৃতি সকল কোমল অনুভূতি সেখানে বর্জিত হত না, তুলনায় বাংলায় যে লোকসাহিত্য তার সঙ্গে নৃত্যের একটা নিগুঢ় যোগ ছিল, বাংলা সাহিত্যের প্রাগাধুনিক যুগে সবই ছিল সংগীত। এ দুটিই মূলত প্রমাণ করে বাংলা লোকসাহিত্য ও ব্যালাড জাতীয় রচনা।
ব্যালাডের বৈশিষ্ট্য :
১। ব্যালাডে থাকে এক শিশুসুলভ সারল্য। জীবনের সহজ ও মৌলিক বৃত্তিগুলিই নির্বিচারে সেখানে স্থান পায়।
২। কাহিনির নাটকীয়তা বিস্তর। শিশুসুলভ সারল্যের জন্যই সম্ভবত নাটকীয় উপাদান সেখানে প্রচুর ব্যবহার হয়। একটি নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি তা থেকে উদ্ধার পাওয়া এবং তার পরেই আর একটি নাটকীয় উত্তেজনা এই ভারে রুদ্ধশ্বাস গতি নিয়ে এর কাহিনি এগিয়ে চলে
৩। নৈর্ব্যক্তিকতা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। যে-কোনো ব্যালাডই একটি বিশেষ জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করে। ব্যক্তিগত কথাও যেমন সেখানে পাওয়া যায় না, ব্যক্তিগত মানসিকতাও সেখানে তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না।
৪। ছন্দ এর বিশেষ অঙ্গ। ব্যালাডের প্রতি পঙ্ক্তিতে থাকে সাতটি শ্বাসাঘাত, অর্থাৎ সাতবার সেখানে ঝোক পড়ে। অবশ্য আধুনিক ব্যালাডে এত দীর্ঘ পক্তি রক্ষিত হয়নি। যেখানে চার ও তিন শ্বাসাঘাত সম্পন্ন দুটি পঙক্তিতে পরিণত হয়েছে।
প্রথাগত ব্যালাডের আদর্শেই আধুনিককালে বেশ কিছু ব্যালাড রচিত হয়েছে ইংরেজিতে। মধ্যযুগীয় ব্যালাডের প্রথম সংকলক পার্সি বহু ব্যালাড রচনা করেছেন। সমালোচক কথিত–পার্সির সার কলিসকে নিয়ে লেখা আখ্যান কবি কোলরীজকে তাঁর বিখ্যাত সাহিত্যিক ব্যালার্ড ‘ক্রিস্টাবেল’ রচনার প্রেরণা জুগিয়েছিল। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং টমাস হার্ডি থেকে শুরু করে কোলরীজ, কীট্স প্রভৃতি অনেকেই আধুনিক ব্যালাড রচনা করেছেন। তবে মধ্যযুগের ব্যালাড নৈর্ব্যক্তিকতা তাঁদের দীর্ঘ কবিতার সন্ধান মেলে না।
বাংলা সাহিত্যে প্রথাগত ব্যালাড ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা কথা প্রথমে বলা হয়। বহু কবির মুখে মুখে রক্ষিত এইসব গাথা ও গীতিকা উদ্ধার করেন দীনেশচন্দ্র সেন। একদিকে যেমন এখানে লোকসাহিত্যের বিশিষ্ট লক্ষণ আছে, অন্যদিকে আছে নাটকীয়তা ও লৌকিক প্রেমের রোমাঞ। মধ্যযুগীয় ইংরেজি ব্যালাডে রবিনহুডের যে কাহিনি পাওয়া যায় বাংলায়ও সেরকম রঘু ডাকাত বা বিশে ডাকাতের কাহিনি মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। খগেন্দ্রনাথ মিত্র এ সকল কাহিনির লিখিত রূপ দিয়েছেন। আমাদের মধ্যযুগীয় সাহিত্যের মধ্যে ধর্মমঙ্গলের লাউসেন রাঙাবতীর কাহিনি বা নাথ সাহিত্যের মীন নাথ গোরক্ষনাথের কাহিনিও ব্যালাডের পর্যায়ভূক্ত।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সাহিত্যিক ব্যালাড বলতে প্রথমে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনি’ কাব্যের অন্তর্গত বহু গাথা কবিতা যার অনেকগুলির কাহিনি ছিল–রাজেন্দ্রলাল মিত্রের Sanskrit Buddhist literature in Napel, সেনার সম্পাদিত—মহাবস্তু, অ্যাকোয়ার্থ সম্পাদিত Marathi Ballads থেকে সংগৃহীত। এছাড়া কবি নজরুল ইসলামের ‘শাত হল আরব’, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ‘শ্রীধর, জসীমউদ্দিনের ‘নকসীকাঁথার মাঠ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
Leave a comment