জাতিতে ইংরাজ হলেও তিনি ব্যারিস্টারি জীবনে অধিকাংশ সময়েই অবহেলিত, নির্যাতিত জাতি মুণ্ডাদের পক্ষ অলবম্বন করে কেস লড়েছিলেন ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে। হয়তো অধিকাংশ কেসে ইংরাজ বিচারকের কাছে বিচার রূপে প্রহসনে জেকব পরাস্ত হতেন। তবুও মুণ্ডাদের জীবনে জেকবের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর যত প্রতিবাদ আর ঘৃণা ইংরাজ সরকারের উপর, আন্তরিক সহানুভূতি প্রদর্শন করতেন মুণ্ডাদের প্রতি। একার্থে তিনি অবহেলিতদের কাছে মানুষ নন দেবতা। রাঁচি জেলে বন্দিদের উপরে অকথ্য অত্যাচারের কথা তিনি সংগ্রহ করে কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করতেন। ইংরাজ হলেও জেকব যে ভারতপ্রেমী তথা মুণ্ডাজাতির প্রতি সহানুভূতিশীল তা বলাই বাহুল্য।

জেকবের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় রাঁচি জেলের সুপার ও ডাক্তার অ্যান্ডারসনের বক্তব্যে। জেলখানার মধ্যে রক্তবমি হয়ে বীরসার মৃত্যু হলে অ্যান্ডারসন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। যদি তাঁদের অত্যাচারের ইতিহাস জনসমক্ষে রাষ্ট্র হয়ে যায়, তবে তাঁর “দেশি কাগজগুলোকে অত ভয় নেই, ভয় ব্যারিস্টার জেবককে। লোকটা ইংরাজ, কিন্তু মুণ্ডাদের হয়ে বিনি পয়সায় লড়েন। এবারও লড়তে আসছেন ওদের কৌসুলী হয়ে। মুণ্ডারা তাঁরই অধীনে জেল হাজতে আছে। তাঁর বিরুদ্ধে যায়, এমন একটা খবর পেলেও জেকব তাকে ছাড়বে না।”

শুধু এবার কেন দেশে যখন মুলকি লড়াই শুরু হয়েছিল জেকব তো তখন সর্দারদের পক্ষ নিয়ে ইংরাজদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। বীরসার মৃত্যু সম্পর্কিত ইংরাজদের নানারকম অর্থনৈতিক কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করে অমূল্য কলকাতায় জেকবকে পাঠিয়েছিল, জেকব বীরসার মৃত্যু সম্পর্কে পত্রিকায় বিবৃতি ছাপিয়েছিলেন। ‘মুলকি লড়াই’-এ সর্দারদের পক্ষ অবলম্বন করার পর থেকে মুণ্ডারা জেকবের উপর বিশেষ ভরসা রেখে চলেছিল। তাদের ধারণা জন্মেছিল বিপদের দিনে কেউ পাশে না থাকুক জেকব ব্যারিস্টার থাকবেন। যে মুণ্ডারা দলে দলে মিশনে গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে লেখা শিখতে অগ্রহ দেখিয়েছিলেন, সেই—“মুণ্ডারা এখন আর মিশনের উপর ভরসা রাখে না। ওদের সব ভরসা কলকাতায় ব্যারিস্টার জেকবের ‘পরে। জেকব ইংরেজদের কলঙ্ক।

একদা অমূল্যের সঙ্গে কথোপকথনকালে জেকব মুণ্ডাদের দূরবস্থার কথা এমনভাবে ব্যক্ত করেছিলেন—“যখন মুণ্ডারা মরছিল, শোষিত হচ্ছিল, বেটবেগারি দিচ্ছিল, সেবক পাট্টা লিখছিল, খুঁকাট্টি গ্রাম হারাচ্ছিল, জমিদার-মহাজন-সরকার তিন হাতে মার খাচ্ছিল, তখন কেউ ওদের কথা ভাবেনি।” বীরসা ভেবেছিল অসহায় মুণ্ডাদের কথা। তাই বীরসার আন্দোলন ভেঙে যাবার পর জেকব মুণ্ডাদের বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়াতে শুরু করেছে, সহানুভূতি দেখাতে সচেষ্ট হয়েছে। জেকব একজন ব্যারিস্টার হয়ে বুঝেছিলেন বীরসা বিদ্রোহে বন্দি মুণ্ডাদের যে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল তা অনেকাংশেই লঘুপাপে গুরুদণ্ড ধার্য করার মতো। এটা যে অনৈতিক তা তিনি স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। অথচ এই অনৈতিকতার বিরুদ্ধে তিনি বারবার লড়েছেন এবং সরকারি বিচার ব্যবস্থার কাছে হেরেছেন। হারের পর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা হল—“আমি আইনের পথে লড়লাম বটে, কিন্তু মুণ্ডারা ট্রায়ালের পর তথাকথিত ব্রিটিশ ড্যানিসের স্বরূপ যেরকম জানা গেল, এমন আর হয়নি।” মুণ্ডাদের সকল চেষ্টা, জেকবের সকল উদ্দাম ব্যর্থ হয়েছে, মুণ্ডাদের এমন আশঙ্কা যখন অমূল্য প্রকাশ করে তখন জেকব সস্নেহে অমূল্যের হাত ধরে যে লাঞ্ছনা বাক্য আওড়েছিলেন, তাতে তাঁর সত্যিকারের দরদীস্বরূপ ও নীতিসচেতন মানবিক দিকটা ফুটে উঠেছিল—“কখনো তা ভেবো না। আমি সেই সর্দার আন্দোলন থেকে মুণ্ডাদের হয়ে লড়ছি। তা বলে কি কেসে জিতেছি ? না, জিতিনি, তবু জেনো, সবশুদ্ধ, সব আন্দোলন কখন ব্যর্থ হল, কখন সার্থক তা অঙ্কের নিয়মে হিসেব করা যায় না।”

বীরসা ধরা পড়ে রাঁচি জেলে আটক থাকার অবস্থায় উদগ্রীব হয়ে তাকিয়েছিল জেকব তাকে উদ্ধার করতে আসবেন। কিন্তু কড়া পুলিশী পাহারায় জেকবের সঙ্গে বীরসার কোনো কথা বলতে দেওয়া হল না। জেকব ইংরাজদের অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে ওঠেন—“বিনা বিচারে বন্দিদের রাখার হয়েছে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল অবধি, আজও কেন তৈরি হল না। ব্রিটিশ জাস্টিসের নামে মুণ্ডাদের উপর চূড়ান্ত অবিচার চলছে। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো ব্যবস্থা সরকার করেননি।” কিন্তু জেকবের প্রতিবাদে কোনো ফল হয়না। কেবল মাসের পর মাস চলতে লাগল বিচারের নামে প্রহসন, যেন এক অদ্ভুদ মেলা।

অমূল্যের নোটবই থেকে জানা যায়, ১৯০০ সালের ১৬ মে ১১৭ জন বিচারাধীন বন্দির মধ্যে তিনজনের জামিনের জন্য জেকব আদালতে আর্জি জানালেন। জেকবের বক্তব্য ছিল—“ওদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আছে শুধু ডি.সি.স্ট্রিটফিল্টের একটা রিপোর্ট, যে ওরা বিদ্রোহে জড়িত বলে অনুমান। ওদের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে ওদের দীর্ঘদিন হাজতে রাখা হয়েছে। বহু বিচারাধীন বন্দি জেলে মারা গিয়েছে।” অমূল্যের নোটবই-এর সুবাদে আমরা জানতে পারি তিনজনের জামিনের দাবিতে সাহেব কীভাবে আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেদিন ম্যাজিস্ট্রেট জেকবের কোনো যুক্তি বা বক্তব্যকেই কোনোমতেই নস্যাৎ করতে পারেননি। ম্যাজিস্ট্রেট বাক্যুদ্ধে পরাস্ত হয়েই জেকবের কাছে উক্ত আর্জি সংক্রান্ত একটি দরখাস্ত আহ্বান করেন। বীরসার জন্যও জেকবের চেষ্টার অন্ত ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শী অমূল্যের বর্ণনায় পাওয়া যায়—বীরসা, জেকবের মর্মযন্ত্রণা আমি দেখেছি। দেখেছি তিনি ডাকবাংলোয় থাকেন, কোনো সাহেবের সঙ্গে কথা কন না। দেখেছি উনি মাঝে মাঝে কলকাতা চলে যাচ্ছেন। আইনের বই আর ফাইল নিয়ে ফিরে আসছেন। ভীষণ জেদে লড়ছেন।” জেকবের প্রচেষ্টা ও লড়াই দেখে অমূল্য বিস্ময় প্রকাশ করলে জেকবের অকপট স্বীকারোক্তি—“চামড়ার নীচে তো হাফমুণ্ডা হয়ে গেছি। কবে থেকে ওদের হয়ে লড়ছি।” এত লড়াই করেও মুণ্ডাদের জন্য কিছু না করতে পারার গ্লানি জেকবকে যেন অহরহ দহন করে চলেছে। তা তাঁর কথায় প্রকাশ পায়।

তবে বারে বারে মুণ্ডাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে পরাস্ত হওয়ার পশ্চাতে জেকব তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের মাঝে কয়েকটি কারণ অনুসন্ধান করেন। “মুণ্ডাদের কোনো লিখিত ভাষা নেই। ওরা আদিবাসী। চিরকাল ওদের ওপর অন্যায় করা হয়। বদমাস উকিলগুলো ওদের কেসে ফাঁসিয়ে নিঃস্ব করত। কোর্ট আইন কীর্তি ও মহিমা ব্রিটিশ জুডিশিয়ারির সততা ওরা কিছুই বুঝত না।” অর্থাৎ জেকব যতবার আদালতকক্ষে মুণ্ডাদের নিয়ে লড়াই করেছেন ততবার ছিলনা তাঁর কোনো আত্মবিশ্বাস, সারাক্ষণ প্রতিকূলতার মধ্যে তাকে বিচরণ করতে হয়েছে। একপ্রকার বাতাসে তলোয়ার ঘোরানোর মতন। জেকব বুঝতে সমর্থ হয়েছিলেন—“কেন সব নিয়ম অমান্য করে ওদের হাজতে রাখা ? সিংভূমের লোককে রাঁচির কেসে, রাঁচির লোককে সিংভূমের কেসে ফাঁসানো ? কেন বিচারাধীন বন্দিদের মৃত্যু ঘটে চলেছে ?” অতএব যাদের জন্য জেকব লড়াই-এ অংশগ্রহণ করেছেন সেই জাতি যদি এত দুর্বল হয়, তাহলে জেকব কেমনভাবে কেস লড়ে জিততে পারেন ?

সর্বোপরি, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নির্যাতিত অবহেলিত মুণ্ডা জাতির পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেকব দিনের পর দিন আদালত কক্ষে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন যেমনভাবে তা ভারতে তথা বিশ্বের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত রহিত। মুণ্ডারা ভারতীয় হয়েও ভারতীয়দের কাছ থেকে কখনো কোনো বিপদে সহানুভূতি বা সাহায্য পায়নি, কেবলমাত্র তারা আদিবাসী বলে। কিন্তু জেকব সুদূর মহাসাগর পার হয়ে ভারতের বুকে পদার্পণ করে স্বজাতির কলঙ্ক উদ্ঘাটনে যেভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং দুর্বল অসহায় নির্যাতিত‌ মুণ্ডাদের বিপদের বন্ধু হলে সর্বদা যেভাবে পাশে পাশে অবস্থান করেছেন তাতে অমূল্যের মতো তাকে প্রকৃত দেশ তথা ভারতপ্রেমী-রূপে তা খ্যাত করতে কোনো দ্বিধা থাকে না।