প্রশ্নঃ ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।

অথবা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ প্রাচীনকালে ব্যাবিলনে যে সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল তা ব্যাবিলনীয় সভ্যতা নামে পরিচিত। নৃ-তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অসেমেটিক সুমেরীয় জাতি এবং সেমেটিক জাতির সংমিশ্রণে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে। গৃহ নির্মাণ, লিখন পদ্ধতি, সেচ ব্যবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাে, ধর্মীয় ব্যবস্থা ইত্যাদি দিকগুলাে বিবেচনায় ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, সামাজিক ইতিহাস পর্যালােচনায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান।

ব্যাবিলনীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহঃ ব্যাবিলনীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলাে শনাক্ত করতে হলে আমাদের ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ভাষা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজ, আইন, অলংকার সামগ্রী, জোতির্বিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় পর্যালােচনা করতে হবে। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার অনেক উপাদান বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে স্বতন্ত্র। নিম্নে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলাে আলােচনা করা হলাে-

(১) ব্যবসা-বাণিজ্যঃ ব্যাবিলন অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল মূলত নৌ-পরিবহন ভিত্তিক। ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ জমজমাট ছিল। প্রধান পুরােহিতদের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতাে বলে মন্দিরগুলাে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। কেনা বেচার জন্য রসিদ দেখানাের ব্যবস্থা ছিল। নৌ-পথে মালামাল পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট হারে শুল্ক ধার্য করা ছিল।

(২) ভাষাঃ ব্যাবিলনীয়রা প্রথমদিকে তাদের ভাষার জন্য সুমেরীয় ও আক্কাদের ওপর নির্ভর করলেও পরে ব্যাবলনীয়রা তাদের ভাষার জন্য আলাদা অভিধান রচনা করে। তাদের ভাষায় প্রায় তিনশতটির মতাে ধ্বনি ছিল। গিলগামেশ মহাকাব্য তাদের সাহিত্যের বিরাট অবদান।

(৩) কৃষিকাজঃ ব্যাবিলনে কৃষিকাজ অনেক উন্নতমানের ছিল। ব্যাবিলনীয়রা কৃষিকাজে অনেক দক্ষ ছিল। তারা ভাইক ও বাঁধ নির্মাণ করতাে। বলদের মাধ্যমে তারা হাল-চাষ করতাে। বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য তারা খাল খনন করতাে। মন্দিরের অধীন জমি কৃষকদের মধ্যে বিলি করে দিতে হতাে। তাদের হাল, হালের লাঙল, হালের বলদ ও শস্যবীজ সরবরাহ করা হতাে।

(৪) আইনঃ আইন প্রণয়নে ব্যাবিলীয়দের অবদান অসামান্য। ব্যাবিলনে লিখিত আইনের প্রচলন ছিল। ব্যাবিলনের আইনগুলাের মধ্যে হাম্বুরাবির আইন অনেক বিখ্যাত। হাম্বুরাবির আইনে অনেকগুলাে ধারা ছিল। প্রায় দুইশত বিরাশিটি আইনের মধ্যে আইনভঙ্গের শাস্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, পরিবার, সম্পত্তি, পারিশ্রমিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছিল। হাম্বুরাবির আইনে নারীদেরকে তাদের প্রাপ্ত অধিকার দেয়া হয়েছিল। হাম্বুরাবির আইনই ছিল ব্যাবিলনীয়দের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই আইন থের্কে তৎকালীন ব্যাবিলীয়ন সমাজব্যবস্থার অনেক দিক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

(৫) ধর্মীয় ব্যবস্থাঃ ব্যাবিলনীরা বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। ভিন্ন ভিন্ন নগরে ভিন্ন ভিন্ন দেবতার পূজা অর্চনা চলতাে। তবে সাধারণত একটি বিশেষ নগরে একটি বিশেষ দেবতার প্রাধান্য ছিল। সেই প্রধান দেবতাকে কেন্দ্র করে মন্দির গড়ে ওঠতাে। ব্যাবিলনীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল ইহজগতকেন্দ্রিক। তারা পরজগত নিয়ে চিন্তা করতাে না। তাদের কাছে পার্থিব জগত ছিল মহামূলবান। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল এজগতের ধন-সম্পদ আহরণ। তারা দেবতাদের রাগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের পূজা করতাে।

(৬) নারীদের অবস্থাঃ ব্যাবলনীয় সমাজে নারীদের উচ্চ মর্যাদা ছিল। পিতার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়েদের সমান অধিকার ছিল। নারীরা সম্পত্তির মালিক হতে পারতাে। তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারতাে। তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতাে ও বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাতে পারতাে। তারা ক্রীতদাস রাখতে পারতাে। তবে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার শেষদিকে নারীদের অবস্থা ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়েছিল।

(৭) সামাজিক স্তরবিন্যাসঃ ব্যাবিলনে স্তরবিন্যাস সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠেছিল। সমাজে মানুষ প্রধানত বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত ছিল। উচ্চশ্রেণিতে ছিল রাজা, পণ্ডিত, পুরােহিত এবং সৈন্যদল। মধ্যমশ্রেণিতে ছিল বড় শিল্পপতি ও স্বাধীন ব্যবসায়ীগণ নিম্নশ্রেণিতে ছিল কৃষক, সাধারণ শ্রমিক এবং যুদ্ধবন্দি।

(৮) বিবাহ প্রথাঃ ব্যাবিলনে লিখিত দলিলের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হতাে। বরের বাবা কনের বাবাকে যৌতুক হিসেবে বিভিন্ন আসবাবপত্র দিত। অর্থাৎ বিবাহ ছিল একটি বৈধ চুক্তিপত্র। স্ত্রীর মর্যাদা আইন দ্বারা সিদ্ধ ছিল।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা তার বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে অনেকটা স্বতন্ত্র ছিল। তৎকালীন সময়ে ব্যাবলনীয় সভ্যতার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যাবিলনীয় সভ্যতা একটি উন্নত সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বহন করে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ব্যাবিলনীয় সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাস, লিপিমালা, ভাষা, সামাজিক কাঠামাে পরবর্তীকালে অন্যান্য অনেক সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।