“(ভাব ও রসের বস্তুজগৎ ও কাব্যজগতের, এই ভেদকে সুস্পষ্ট প্রকাশের জন্য আলঙ্কারিকেরা বলেন,) রস ও কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ।”

“কাব্যপাঠকের মনে হয়, কাব্যের চরিত্র ও ভাব পরের, কিন্তু সম্পূর্ণ পরের নয়; আমার‌ নিজের, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজেরও নয়।”

কাব্যের আত্মা যে রস, তার বিশ্লেষণে আলঙ্কারিকগণ দুরকম উপাদানের সন্ধান লাভ করেন—বাহ্যিক ও মানসিক। কবির সৃষ্ট কাব্যের জগৎ থেকে আসে ঐ বাহ্যিক উপাদান। এই বাহ্যিক উপাদানের ক্রিয়ায় মনের লৌকিক ‘ভাব’ নামক চিত্তবৃত্তিগুলি অলৌকিক ‘রসে’ পরিণত হয়। কিন্তু এই ভাবগুলি রস নয়, কিংবা মানুষের মনে যা কিছু ভাবের উদ্বোধন ঘটায়, তাও রস নয়। ‘শোক’ একটি মানসিক ভাব, লৌকিক জগতের ঘটনা-পরম্পরায় মানুষ শোকগ্রস্ত হয়–কিন্তু এই শোককে ‘রস’ বলা যায় না কিংবা শোকের কারণটিকেও কাব্য বলা যায় না। অথচ এই লৌকিক শোক এবং লৌকিক কারণকেই যদি কবি তাঁর অঘটন ঘটন-পটীয়সী প্রতিভার বলে অলৌকিক চিত্ররূপে কাব্যে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তবেই পাঠকের মনে ‘করুণ রসে’র সৃষ্টি হয়। অতএব দেখা যাচ্ছে, লৌকিক-রূপে যে ভাব ছিল বস্তুজগতের বিষয়, তাই অলৌকিক রসরূপে কাবাজগতের বিষয়ে রূপান্তরিত হলো। এই কারণেই আলঙ্কারিকগণ বলে থাকেন যে রস ও কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ। একসময় যা ছিল কারো ব্যক্তিগত অতএব লৌকিক শোক, তা-ই লৌকিক ভাব-রূপে কবির মনকে আশ্রয় করে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রস-রূপ প্রাপ্ত হয়ে কাব্যাকারে প্রকাশিত হয়, তখন তা আর ব্যক্তিগত বা লৌকিক থাকে না, তা হয় ব্যক্তিসম্পর্ক-বর্জিত, অতএব নৈর্ব্যক্তিক নির্বিশেষ অলৌকিক রস।

লৌকিক ভাব কোন প্রক্রিয়ায় অলৌকিক রসে পরিণত হয়ে কাব্যের জগৎকে মায়ার জগতে পরিণত করে, সে-বিষয়ে ‘সাহিত্যদর্পণ’কার বিশ্বনাথ বলেন যে বিভাব ও অনুভাবের মধ্যে এমন একটি ব্যাপার আছে, যাতে কাব্যচিত্রিত চরিত্র বা ভাব এবং পাঠকের মধ্যে একটি সাধারণ সম্বন্ধের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন,

‘ব্যাপারোহস্তি বিভাবাদের্নাম্না সাধারণী-কৃতিঃ।

তৎপ্রভাবেন যস্যাসন্ পাথোধিপ্লবনাদয়ঃ।।

প্রমাতা তদভেদেন স্বাত্মানং প্রতিপদ্যতে। 

উৎসাহাদিসমুদ্বোধঃ সাধারণ্যাভিমানতঃ।।

—অর্থাৎ বিভাব-অনুভাবাদির সাধারণীকৃতি নামে একটি ব্যাপার আছে। এরই প্রভাবে সমুদ্রতরঙ্গের মতো অসাধারণ সামর্থ্যে সমৃদ্ধ রামচন্দ্রের সঙ্গে পাঠক স্বীয় আত্মার অভেদত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। অর্থাৎ যা ছিল ব্যক্তিগতভাবে রামচন্দ্রের অভিজ্ঞতা, সাধারণীকরণের ফলে তা-ই পাঠকের উপলব্ধিতে পরিণত হলো। এই প্রসঙ্গটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেই কবিরাজ বিশ্বনাথ আবার বলেছেন—

“পরস্য ন পরস্যেতি মতেতি ন মমেচি চ।

তদাস্বাদে বিভাবাদেঃ পরিচ্ছেদো ন বিদ্যতে।।

অর্থাৎ সাধারণী-কৃতির ফলে এটি পরের হয়েও পরের নয়, আমার হয়েও আমার নয়—বিভাবাদি পদার্থের এরকম কাব্যগত আস্বাদ কোনো ব্যক্তিত্বের পরিচ্ছেদে পরিচ্ছিন্ন থাকে না অর্থাৎ ভেদজ্ঞান তিরোহিত হয়।

দার্শনিক অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এই ব্যাপারটিকে তাঁর ‘কাব্যবিচার’ গ্রন্থে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন : “নানাবিধ বেশভূষা পরিধান করে বলিয়া নাটকে কোন বিশেষ ব্যক্তি বলিয়া মনে হয় অথচ রাম বলিয়া মনে হয় না। তাহা রোমাঞাদি দ্বারা লৌকিক দেশকালাদির সহিত সম্বন্ধ-বিহীনভাবে নটগত রত্যাদি প্রকটিত করে। সেই রত্যাদি ভাবের মধ্যে স্বকীয় বাসনার উদ্বোধ-প্রযুক্ত দর্শক অনুপ্রবিষ্ট হন। এইজন্য দর্শকের মনে যে রত্যাদি ভাব উপস্থিত হয়, তাহা তাহার ব্যক্তিগত নহে। বিভাবাদির দ্বারা পাঠক বা দর্শকের চিত্তে একটি সৌন্দর্যঘটিত চিত্তবৃত্তি উৎপন্ন হয়। এই চিত্তবৃত্তিকে বিভাবাদির সাধারণীভাব কহে।” সোজা কথায় বলা চলে, নাটকে বা কাব্যে বর্ণিত লৌকিক বিষয়টি যখন রঙ্গমঞ্চে কিংবা সাহিত্যে উপস্থাপিত হয়, তখন তা দেশকালাদির বিশেষ স্বভাব বর্জিত হয়ে একটি সাধারণ আকার ধারণ করে এবং বিভিন্ন বৃত্তি, ব্যবসায় নিযুক্ত কিংবা ভিন্ন রুচি-প্রকৃতির কাব্যরসিক দর্শক-পাঠকের চিত্তে তা একই প্রকার অলৌকিক রসের উদ্বোধন ঘটায়। সাধারণীকৃত স্বভাবটি বিভিন্ন কাব্যরসিকের নিকট ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয় না; সকল দর্শক-পাঠকেরই যেন ব্যক্তিচেতনার বিলোপ ঘটে এবং বর্ণনীয় বিষয়ের সঙ্গে তাঁরা একাত্মতা বোধ করেন। এই সাধারণীকৃতির ফলেই তাই বাস্তব জগতের লৌকিক ভাব-ক্রিয়াদি সাহিত্য রস-রূপে অলৌকিক অর্থাৎ ব্যক্তিসম্পর্ক-বর্জিত সর্বসাধারণের বিষয় হয়ে ওঠে। তখন আর এটি সেই লৌকিক বাস্তব অগৎ থাকে না, হয়ে ওঠে অলৌকিক মায়ার জগৎ। আচার্য অভিনব গুপ্ত একেই বলেছেন, ‘সর্বসামাজিকানাম্ একঘনতা।’ ভারতীয় আলঙ্কারিকগণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য-বর্জিত রসানুভূতির জগতে ‘সাধারণীকরণ’। ভারতীয় আলঙ্কারিকগণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য-বর্জিত রসানুভূতির জগতে ‘সাধারণীকরণ’ কথাটির সাহায্যে যে উপলব্বির কথা বলেছেন, তার সমর্থন পাওয়া যায় পাশ্চাত্ত্য দর্শনেও। কান্ট বলেন, “Conse quently the judgement of taste accompanied with the consciousness of separation from all interest, must claim validity for everyman, without this universality depending on objects. That is there must be bound up with it a title to subjective universality.” ভারতীয় রসতত্ত্বের স্বরূপ এই subjective universality-র মধ্য দিয়েই যথাযথভাবে প্রকাশ পায়।

এই সাধারণীকরণের মধ্য দিয়ে আত্মাপর ভেদ লোপ পায় বলেই অপরের অভিজ্ঞতার বস্তুকে সাহিত্য পাঠ বা অভিনয়াদি দর্শনের মধ্য দিয়ে দর্শন-পাঠক আপনার উপলব্ধিতে গ্রহণ করতে পারে। স্রষ্টা কবির যে অনুভূতি কাব্যাকারে প্রকাশিত হয়, তা কখনো তার ব্যক্তিত্বের পরিচ্ছেদে পরিচ্ছিন্ন থাকে না। কাব্যে যাবতীয় ভেদ তিরোহিত হয় বলেই যে কোনো রসজ্ঞ পাঠকই তা থেকে সমভাবে রসগ্রহণে সমর্থ হয়ে থাকেন। যা পরের হয়েও পরের নয়, অথবা আমার হয়েও আমার নয়, সেখানেই পরত্বের কিংবা সমত্বের লৌকিক সত্তা সম্পূর্ণ লোপ পায় এবং তা সাধারণীকরণের ফলে অলৌকিক রসরূপ লাভ করে। তার ফলেই কাব্যের সৃষ্টি হয়ে ওঠে সকল হৃদয়ে সম-বাদী। শব্দে সমর্পিত লৌকিক কারণ ও কার্য একটি সাধারণ রূপ লাভ করে, তেমনি লৌকিক ‘রতি’ প্রভৃতি অন্তর ভাবও সাধারণীকৃত হয়ে পাঠক-চিত্তে অভিব্যক্ত হয়, ফলে কাব্যে বর্ণিত বিষয়ের সঙ্গে পাঠকের একাত্মতা বোধের সৃষ্টি হয়—এটিকে ‘তন্ময়তা’ নাম দেওয়া চলে।

কবি তথা লেখক ও পাঠকের এই যে হৃদয়-সংযোগের কথা এখানে প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকগণ উল্লেখ করেছেন, অনুরূপ ভাবনা রবীন্দ্রনাথের রচনায়ও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে—

একাকী গায়কের নহে তো গান

গাহিতে হবে দুই জনে।’

উক্তি থেকেই বোঝা যায়, শিল্পীর সৃষ্টি সম্পূর্ণ হয় না, যতক্ষণ না তা শ্রোতার মনকেও স্পর্শ করে। অন্যত্রও তিনি বলেছেন, “সাহিত্য ব্যক্তি বিশেষের নহে, তাহা রচয়িতার নহে, তাহা দৈববাণী।” এখানে লৌকিক ভাব যে সাহিত্যে অলৌকিক রসরূপ লাভ করে সে কথাই বলা হয়েছে। সাধারণীকরণ-বিষয়েও তিনি বলেন, “সাধারণের জিনিসকে বিশেষভাবে নিজের করিয়া, সেই উপায়েই তাহাকে পুনশ্চ বিশেষভাবে সাধারণের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।” কাব্যকে সর্বজনের উপভোগ্য করে তোলার জন্যই ভাবের লৌকিক পরিমিতত্বকে ছাড়িয়ে উঠতে হবে, এতেই আবদ্ধ আর অভিভূত থাকলে যেমন কাব্যরসের আস্বাদ হয় না, তেমনি কাব্যরস সৃষ্টিও হয় না। ক্রৌঞ্ঝীর লৌকিক শ্লোককে অবলম্বন করেই বাল্মীকি অলৌকিক কাব্যরসের ভাণ্ডার ‘রামায়ণ’ সৃষ্টি করেন।