ব্যবসায় মূল্যবোধ কাকে বলে :-
মূল্যবোধ হলো এমনসব আচার-আচরণ ও কর্মপ্রক্রিয়ার সমষ্টি যা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। সততা, ন্যায় পরায়ণতা, শিষ্টাচার, শৃঙ্খলা, সৌজন্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলি হচ্ছে মূল্যবোধের উপাদান। মূল্যবোধ মানুষকে তার কর্মকাণ্ডের ভালো-মন্দ দিক অনুধাবন করতে সহায়তা করে।
অন্যদিকে ব্যবসায়িক মূল্যবোধ বলতে এমন একটি মানদণ্ডকে বোঝায় যার ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়িক রীতিনীতি, চিন্তা-চেতনা, ধ্যানধারণা তথ্য ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে।
নিম্নে মূল্যবোধ ও ব্যবসায় মূল্যবোধ সম্পর্কে দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতামত তুলে ধরা হলো:
সমাজ বিজ্ঞানী এ. আর উইলিয়াম এর মতে,
“মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধানর মানদণ্ড যার মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণ, রীতিনীতি ও কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং সমাজের মানুষের কর্মকান্ডের ভালোমন্দ বিচার করা হয়”।
মূল্যবোধ সম্পর্কে M. Rokeach এর মতে,
“মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের মৌলিক দৃঢ় বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের মাধ্যমে কোনো বিষয় সম্পর্কে ব্যক্তিগত বা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার সৃষ্টি হয়। মূল্যবোধ কতিপয় বিবেচনামূলক উপাদানের সমষ্টি যার মধ্যে কোনো ব্যক্তির কোনো বিষয় সম্পর্কিত ধারণা প্রতিফলিত হয়।”
আজকের দিনে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত সে বিচারের মানদণ্ডে মূল্যবোধে পরিবর্তন এসেছে। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড কেবল অর্থ উপার্জনের জন্যই নয়, সামাজিক কল্যাণের দিকটিও বিশেষভাবে বিবেচনা করছে।
কাজেই আমরা বলতে পারি, সততা, ন্যায়পরায়নতা, আত্মপ্রত্যয়, বিশ্বাস, রীতিনীতি ইত্যাদি ব্যবসায়িক মূল্যবোধের উপাদান হিসেবে কাজ করে।
ব্যবসায়িক মূল্যবোধ কোনো ব্যবসায়ীকে সৎ, ন্যায়বান, আচারনিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। যে জাতি বা সমাজ ব্যবসায়িক মূল্যবোধ যতো উন্নত সে জাতি বা সমাজ অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ততো উন্নত হয়ে থাকে।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, কোনো জাতি বা সমাজের সামগ্রিক ব্যবসায়িক আচার-আচরণ, রীতি নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা ও কার্যক্রমের সামগ্রিক আবস্থাকে ব্যবসায় মূল্যবোধ বলে।
ব্যবসায় নৈতিকতা কাকে বলে :-
বস্তুত ব্যবসায় কার্য কতগুলো ন্যায়-নীতির আলোকে পরিচালনা করতে হয়, যার দ্বারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মী, শেয়ার হোল্ডার বা বিনিয়োগকারী, সরবরাহকারী ও পাওনাদার, ক্রেতা ও পৃষ্ঠপোষক সকলেরই কল্যাণ সাধিত হয় ও তাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়।
ব্যবসায়ীকে কোন অবৈধ অন্যায় ও নীতিবিবর্জিত কাজ, যেমন-পণ্যে ভেজাল দেওয়া, অন্যায্যভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা, কর্মরত শ্রমিক কর্মীদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করা, সরকারকে আয়কর প্রদান না করা, বিনিয়োগকারীদের ঠিকভাবে লভ্যাংশ প্রদান থেকে বিরত থাকা, এলাকার পরিবেশগত ক্ষতিসাধন করা ইত্যাদি অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়।
অর্থাৎ একজন ব্যবসায়ীকে তার ব্যবসায়ের পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে কর্ম সম্পাদনের সময় এর ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিবেচনা করতে হয়। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এসব রীতিনীতির অনুসরণ করে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করাকেই ব্যবসায় নৈতিকতা বলা যায়।
নৈতিকতা মানুষকে সৎ ও সঠিক কাজের পথ প্রদর্শন করে, মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। ব্যবসায়ের কার্যক্রমে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আচার-নিষ্ঠা ইত্যাদি ব্যবসায়িক নৈতিকতার ভিত্তি।
যেসব সামাজিক কিংবা আইনগত রীতিনীতি অনুসরণ করে ব্যবসায়ীকে তার ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় তাকে ব্যবসায় নৈতিকতা বলে।
সুতরাং যেসব নিয়মকানুন, রীতিনীতি ও অনুশাসন দ্বারা ব্যবসায়-বাণিজ্য গঠিত পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে ব্যবসায় নৈতিকতা বলা যায়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ন্যায়-নীতি ও মানবিক বোধ, যেমন- ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা, বিশ্বস্ততা, ধর্মী-সামাজিক ও আইনগত রীতিনীতি এবং শৃঙ্খলা অনুসরণ করে ব্যবসায় কার্যক্রম গঠন, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ করাকে ব্যবসায় নৈতিকতা বলে।
ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুরুত্ব :-
অধিক মুনাফা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অসম প্রতিযোগিতা, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন, বা অন্য কোন কারণেই হোক ব্যবসায় অনৈতিক কার্যকলাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতা উল্টালে ব্যবসায় সংক্রান্ত অনেক নেতিবাচক খবর ও চিত্র চোখে পড়ে। মরা মুরগী কেনা-বেচা, খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল, নিম্নমানের পণ্য তৈরি বা বিক্রয়, ওজনে কম, ফরমালিনযুক্ত মাছ ও ফলমূল, পণ্য দ্রব্যের গুণাগুণ সম্পর্কে মিথ্যা ও অতিরিক্ত তথ্য দান, নির্মাণ কাজে নিম্নমানের দ্রব্য ব্যবহার, ঔষধে ভেজাল, চলাচলের অযোগ্য যানবাহনের রাস্তায় অবাধ চলাচল, এমন অসংখ্য ব্যবসায়ে অনৈতিক কার্যকলাপের উদাহরণ দেয়া যায়।
এসব অনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিক্রয়া ভয়াবহ। ভেজাল ঔষধ খেয়ে অনেক শিশু মারা গেছে এবং অনেক শিশু অসুস্থ হচ্ছে। ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ নানা রকম ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের এসব অনৈতিক কার্যকলাপ রোধ না করা গেলে রোগাক্রান্ত মানুষদের একটি অসুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে। যার ফল হবে ভয়ানক।
নিম্নোক্ত কারণে ব্যবসায়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুরুত্ত্ব অপরিসীম।
১. সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ট সৃষ্টি মানুষ। ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে আয় একটি বৈধ ও সম্মানজনক কর্ম। অনৈতিক কার্যকলাপ ও অনৈতিক আচরণ মানুষের কাছ থেকে কাম্য নয়।
২. বর্তমানে ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ কঠিন ও জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যার প্রতিক্রিয়াও ভয়াবহ। একমাত্র ব্যবসায় নৈতিকতাবোধ এই ভয়াবহ পরিণতি হতে রক্ষা করতে পারে।
৩. ঔষধপত্রে ভেজালের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাড়ায়। ঔষধ প্রস্তুতকারকদের নৈতিক আচরণই এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে।
৪. অনৈতিক কার্যাবলির মাধ্যমে ব্যবসায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হলেও এর পরিণাম কখনও ভাল হয় না। অনেক ব্যবসায় প্রথমে ভালো ফলাফল করেও অনৈতিক কার্যকলাপে নিয়োজিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে।
৫. অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যবসায়ীকে সবাই ঘৃণা করে। সমাজের সম্মান ও শ্রদ্ধা পেতে হলে ব্যবসায় নৈতিক আচরণ বা সতা পথ অবলম্বনের বিকল্প নেই।
৬. ব্যবসায় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের ভাল-মন্দ, কল্যাণ দেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ব্যবসায়ের মূল লক্ষ্য মুনাফা অর্জন হলেও সামাজিক দায়িত্ব পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একাজে অবহেলা বা অনীহা ব্যবসায়ের জন্য মঙ্গলময় নয়। যে ব্যবসায়ে মূল্যবোধ নেই সে ব্যবসায় ঝুঁকিপূর
Leave a comment