ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ঊনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাজগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তৎকালীন ব্যাপক সরকারী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্ভব হয়। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্যের সমর্থকগণ ধনতন্ত্রের প্রসারের জন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী তত্ত্ব প্রচার করেন। ক্রমশ তত্ত্বটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক ও সামাজিক মতবাদে পরিণত হয়।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়:
এই মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে, রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি যত বেশি সীমিত করা যাবে রাষ্ট্র ও সমাজের পক্ষে ততই মঙ্গল। ব্যক্তির কল্যাণ ও স্বাধীনতার স্বার্থে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি বা হস্তক্ষেপের সীমানা সংক্ষিপ্ত ও সীমাবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা নৈরাজ্যবাদীদের মত রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিলুপ্তির কথা বলেন না। তাঁরা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সংক্ষিপ্ত ও সীমিত রাখার পক্ষপাতী। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা হয় না। এই মতবাদে সক্রিয় রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা হয়। তাঁরা রাষ্ট্রকে ত্রুটিপূর্ণ, অনিষ্টকর অথচ প্রয়োজনীয় (necessary evil) প্রতিষ্ঠান হিসাবে মনে করেন। তাঁরা রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে অতিমাত্রায় সংকুচিত করে কেবল ব্যক্তির জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান, আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করা প্রভৃতি নেতিবাচক দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান। অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাষ্ট্র হবে মূলত পুলিশী রাষ্ট্র (Police State)। তাঁদের বিশ্বাস রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃতি ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থী। গার্ণার বলেছেন: “The individualistic doctrine regards all restraint qua restraint as an evil, and every extension of the power of the State as involving a corresponding diminution of individual liberty.” শান্তিপূর্ণ নিরুপদ্রব জীবনের নিশ্চয়তা প্রদানের দ্বারা ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সর্বাধিক ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল কথা।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের স্বাচ্ছন্দ্য নীতি:
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা রাষ্ট্রের পরিবর্তে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও কার্যকলাপ সর্বক্ষেত্রে প্রসারিত করার পক্ষপাতী। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী তত্ত্বের কেন্দ্রীয় বিষয় হল ব্যক্তি। এই মতবাদে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকারকে সম্প্রসারিত করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকুচিত করার কথা বলা হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের মতে প্রত্যেকে নিজের শুভাশুভ ও স্বার্থ সর্বাপেক্ষা ভাল বোঝে। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের মঙ্গলের জন্য প্রচেষ্টার স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য দেওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্রের ভূমিকা এক্ষেত্রে একবারে অনাবশ্যক। আর্থনীতিক ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণশূন্য অবাধ প্রতিযোগিতা থাকা বাঞ্ছনীয়। সেইজন্য এই তত্ত্ব অবাধ নীতি বা স্বাচ্ছন্দ্য নীতি (Laissez Faire Theory) হিসাবেও সুপরিচিত। এ হল অবাধে ও স্বাধীনভাবে যে যার ইচ্ছা ও উদ্যোগ অনুসারে পরিচালিত হওয়ার মতাদর্শ। Laissez Faire’ হল একটি ফরাসী শব্দ। অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী অর্থনীতিবিদরা অবাধ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এই ধারণার প্রবর্তন করেন। এর অর্থ হল ব্যক্তির অবাধ স্বাধীনতা।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত। এই কারণে সামাজিক, রাজনীতিক এবং আর্থনীতিক দিক থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে ব্যাখ্যা করা দরকার।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সামাজিক দিক:
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ব্যক্তির যৌথ সত্তার কথা বলা হয় না। এই মতবাদ অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তিকে একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে দেখা হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে এক বিশেষ সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়। এই সমাজে ব্যক্তিমাত্রেই স্ব স্ব বুদ্ধি-বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হবে। সমাজ গঠিত হয় ব্যক্তিকে নিয়ে। অতএব ব্যক্তির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপর সামাজিক সুখ সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। ব্যক্তির কল্যাণ সাধিত হলে সামাজিক মঙ্গল সুনিশ্চিত হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুসারে ব্যক্তিমাত্রেই স্বীয় সুখ সমৃদ্ধির প্রকৃত নির্ধারক। তাই ব্যক্তির যুক্তি ও বিবেচনাবোধের উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখা দরকার। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে অনিয়ন্ত্রিত ও অবাধ ব্যক্তিসত্তার উপর জোর দেওয়া হয়। এই মতবাদে রাষ্ট্রের উপর ব্যক্তির সত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকারের প্রতিষ্ঠা। তার জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপহীন ব্যক্তিসত্তা। তাই রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের এলাকা বা কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে সীমিত করার কথা বলা হয়।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের রাজনীতিক দিক:
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের রাজনীতিক দিকটিও ব্যাখ্যা করা দরকার। এই মতবাদ অনুসারে ব্যক্তির উপর থেকে বাধা-নিষেধের অপসারণই হল স্বাধীনতা। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে। তাই ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য নাগরিকদের কাজকর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যত কম হস্তক্ষেপ করে তত ভাল। ব্যক্তির স্বাধীনতার স্বার্থে সহায়ক অবস্থা সৃষ্টি করাই হল রাষ্ট্রের একমাত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে নেতিবাচক। রাষ্ট্র কেবল ব্যক্তি-স্বাধীনতার বাধাগুলিই দূর করবে। ব্যক্তির জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান, বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ এবং আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তি শৃঙ্খলা সংরক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্রের কার্যাবলী সীমাবদ্ধ থাকবে। সুতরাং রাজনীতিক বিচারেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রাষ্ট্রের কার্যাবলীকে সীমিত করার পক্ষপাতী।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আর্থনীতিক দিক:
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আর্থনীতিক ভাষ্যটিও তাৎপর্যপূর্ণ। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সব রকম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিরোধী। এই মতবাদ যে-কোন রকম পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার বিরোধী। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে বলা হয় যে আর্থনীতিক পরিকল্পনা ব্যক্তিগত উৎসাহ-উদ্যোগকে ক্ষুণ্ন করে, উৎপাদন ব্যবস্থায় যান্ত্রিকতার সৃষ্টি করে এবং বৈচিত্র্যকে বিলুপ্ত করে। এই মতবাদ অনুসারে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একমাত্র দায়িত্ব হল উৎপাদন ব্যবস্থার সহায়ক অবস্থা সৃষ্টি করা। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিগত উদ্যোগে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য অবাধ অবস্থা গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা। অর্থাৎ এই মতবাদ আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা-উদ্যোগকে স্বীকার ও সমর্থন করে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার প্রাচীন উৎস: প্রাচীনকালে গ্রীসের সিনিক ও স্টোইক দার্শনিকগণের লেখায় এবং মধ্যযুগে খ্রীষ্টীয় দর্শনে এবং রেঁনেসার (Renaissance) মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল ব্যক্তি মানুষের চূড়ান্ত বিকাশের উপর জোর দিয়েছেন। ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করার দাবিকে সোফিস্টরা স্বীকার করেছেন। রেঁনেসা নতুন সমাজের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ব্যক্তিত্বের অভিষেকের আয়োজন করে। সমকালীন ইউরোপের রাষ্ট্রচিন্তায় ব্যক্তিসত্তাকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে স্বীকার করা হয় এবং ব্যক্তিসত্তার উপর জোর দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অবদানও অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খলকে ছিন্ন করা হয় এবং বিবেকের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিসত্তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর অবস্থা: অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। জনগণের আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। তারফলে ব্যক্তির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার ধারণা পরিপুষ্ট হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধ্যান-ধারণার পরিপোষক হিসাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর আরও কতকগুলি ঘটনা ও মতাদর্শের উল্লেখ করা দরকার। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ফরাসী বিপ্লব প্রসূত ধ্যান-ধারণা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনাকে শক্তিশালী করে। এ ক্ষেত্রে সহায়ক মতাদর্শ হিসাবে স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব, হিতবাদ ও সামাজিক চুক্তি মতবাদের কথা বলা যায়। চুক্তিবাদী ইংরেজ দার্শনিক হব্স (Thomas Hobbes) এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হল শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর একজন চুক্তিবাদী ইংরাজ দার্শনিক জন লক্ (John Locke)-এর রাজনীতিক তত্ত্ব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিধির উপর সীমা আরোপ করে। এই সময় ইংল্যাণ্ডে ব্যক্তি-স্বাধীনতার দাবি সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে ব্যক্তি-স্বাধীনতার পক্ষে তত্ত্বগত ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় রাষ্ট্রের কাজকর্মের ক্ষেত্রকে সীমিত করার জন্য অবাধ বাণিজ্যের নীতি (Laissez-faire) এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সৃষ্টি হয়।
ঊনিশ শতকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের গৌরবময় শতাব্দী বা সুবর্ণ যুগ হল ঊনবিংশ শতাব্দী। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদও বলা হয়। এই শতাব্দীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অভাবনীয় অগ্রগতি ও সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে। ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। তাই এই মতাদর্শ ঊনবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা হিসাবে পরিচিত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যাণ্ড: ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যাণ্ডে বেশ কিছু ঘটনা ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশের উপযোগী ও সহায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সমকালীন ইংল্যাণ্ডের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক পরিস্থিতি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উপযুক্ত ও উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এ প্রসঙ্গে ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসের কতকগুলি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ঘটনাগুলি হল শিল্পবিপ্লব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় বিকাশ, উৎপাদন শক্তি ও কারিগরী কলাকৌশলের আশাতিরিক্ত উন্নয়ন, বৃহদায়তনবিশিষ্ট বিভিন্ন শিল্প-কারখানার প্রতিষ্ঠা ও প্রসার প্রভৃতি। এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে সাবেকী সামস্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয়। এবং এই অবস্থায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্ভব: মানব জাতি ও মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে প্রত্যেক সমাজেই একটি প্রাধান্যকারী শ্রেণী থাকে। এই শ্রেণীর নিজস্ব শ্রেণী-স্বার্থ থাকে। এবং এই শ্রেণী স্বার্থের সহায়ক একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ থাকে। প্রাধান্যকারী শ্রেণীর এই মতাদর্শ সমকালীন সমাজব্যবস্থায় প্রাধান্য বিস্তার করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্প-বিপ্লব প্রসূত নতুন পরিস্থিতিতে প্রচলিত মতাদর্শ অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়। সমকালীন ইংল্যাণ্ডে বুর্জোয়া শ্রেণী প্রাধান্যকারী শ্রেণী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই বুর্জোয়া শ্রেণী তার নিজস্ব শ্রেণী-স্বার্থ রক্ষার জন্য নতুন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বুর্জোয়া শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক কর্তৃত্ব কায়েম করার উপযোগী মতাদর্শ হিসাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আবির্ভাব ঘটে। এই সময়কার ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা হিসাবে বেহাম, জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বার্ট স্পেনসার, সিজউইক, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ দার্শনিক ও চিন্তাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে আদর্শবাদী ইংরাজ দার্শনিক টমাস হিল গ্রীণের নামও করা হয়।
বেন্থাম ও জেমস মিল: বেন্থাম ও জেমস মিল হিতবাদের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। তবে ব্যক্তির ইচ্ছা ও যুক্তিবাদীর উপর এই হিতবাদ প্রতিষ্ঠিত। এই দুই চিন্তাবিদের মতানুসারে ব্যক্তিই হল সরকারের কার্যাবলীর প্রধান বিচারক। ব্যক্তি তার প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বা উপযোগিতার বিচারে সরকারের আইনানুগ অনুজ্ঞা বা নীতিসমূহ বিচার-বিবেচনা করে দেখবে। এবং তদনুসারে সরকারী নীতি বা অনুজ্ঞা মান্য করার বা বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বেন্থাম ও জেমস মিলের আরও অভিমত হল যে ব্যক্তির উপর কোন সিদ্ধান্ত সরকার জোর করে চাপিয়ে দিতে পারে না। ব্যক্তির মতামত ও অভিপ্রায়কে সরকার অগ্রাহ্য করতে পারে না।
জে. এস. মিল: মূলত জন স্টুয়ার্ট মিল [John Stuart Mill (1806-1878)]-এর হাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বলিষ্ঠ রূপ ধারণ করে। জে. এস. মিল ছিলেন ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এক একনিষ্ঠ প্রবক্তা। আবার অনেকের মতে তিনিই হলেন আলোচ্য মতবাদের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। মিলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বক্তব্য ব্যক্ত হয়েছে তাঁর দু’টি কালজয়ী গ্রন্থের মাধ্যমে। এই দু’টি গ্রন্থ হল On Liberty এবং Representative Government। সমালোচকদের মতানুসারে এ দু’টি গ্রন্থ হল ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বাদের প্রতীক গ্রন্থ। ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠ বক্তব্য On Liberty গ্রন্থে বর্তমান। তাঁর Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে ওয়েপার (Wayper) এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, On Liberty, হল চিন্তা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার সপক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।
জে. এস. মিলের উপর হিতবাদী বোম ও জেমস মিলের প্রভাব সুস্পষ্ট। তবে হেগেল বা রুশোর ‘সমষ্টিগত ইচ্ছাতত্ত্ব’কে তিনি সমর্থন করেননি। বস্তুত এই দুই দার্শনিকের রাষ্ট্রচিত্তার তিনি বিরোধী ছিলেন। কারণ এঁদের মতাদর্শের মধ্যে মিল ব্যক্তির বিশেষ মর্যাদা খুঁজে পাননি।
ব্যক্তির সুখানুসন্ধান: মিলের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য হল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সম্পাদন ও তার প্রসার সাধন। ব্যক্তির সুখানুসন্ধানের পথের বাধাগুলিকে দূর করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ব্যক্তিকে সুখী করার এই দায়িত্ব রাষ্ট্র যদি পালন না করতে পারে তা হলে অন্য কোন সংগঠনকে এই দায়িত্ব দিতে হবে। যাবতীয় রাজনীতিক প্রশ্নের বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মিল ব্যক্তির সুখ ও অসুখ এই দু’টি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মিলের উপর হিতবাদ বা উপযোগবাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। মিলের মতে ব্যক্তির সুখলাভের বড় উপাদান হল স্বাধীনতা। এই কারণে তিনি ব্যক্তির আচরণের পূর্ণ স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা: মিল মতপ্রকাশের চরম স্বাধীনতার উপর জোর দিয়েছেন। নিজস্ব মতামত গঠন ও প্রকাশের স্বাধীনতা সকলেরই আছে। মিল চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর থেকে সকল বাধা অপসারণের কথা বলেছেন। প্রতিবাদী বা প্রতিরোধী মতামতকে যাতে রুদ্ধ করা না হয় সে বিষয়ে মিল সতর্ক করে দিয়েছেন। সংখ্যালঘুর মতপ্রকাশের পথেও সরকার বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। তা হলে ব্যক্তির সুখানুসন্ধানে হস্তক্ষেপ করা হবে।
ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক ও পরকেন্দ্রিক কার্যাবলী: মিল তাঁর ‘স্বাধীনতা’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে, রাষ্ট্র একমাত্র অপরের অনিষ্ট সাধন থেকে নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রেই ব্যক্তির উপর বলপ্রয়োগ করতে পারে। মিলের মতে নিজের উপর নিজের দেহ ও মনের উপর প্রত্যেক ব্যক্তি হল সার্বভৌম। মিল তাঁর On Liberty শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Over himself, over his own body and mind the individual is sovereign,” ব্যক্তিমাত্রেই হল তার শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক চিন্তার অভিভাবক হিসাবে কর্তৃত্বসম্পন্ন। ব্যক্তির নিজস্ব বিচার-বিবেচনা অনুসারে স্বীয় কল্যাণ সাধনের প্রয়াসের মধ্যেই যথার্থ স্বাধীনতা বর্তমান। মিলের মতে ব্যক্তিত্বের বিকাশ হল ব্যক্তির কল্যাণসাধনের অপরিহার্য শর্ত। ব্যক্তিত্ব বিকাশের উদ্দেশ্যে ব্যক্তির কার্যাবলীর ক্ষেত্র সম্পর্কেও মিল আলোচনা করেছেন। তিনি ব্যক্তির কার্যাবলীকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। ব্যক্তির কার্যকলাপের এই দু’টি ভাগ হল: ‘আত্মকেন্দ্রিক কার্যাবলী’ (Self regar-ding activities) এবং ‘পরকেন্দ্রিক কার্যাবলী’ (other regarding activities)। চিন্তা, মতপ্রকাশ এবং বিবেকের, নৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা হল আত্মকেন্দ্রিক। ব্যক্তির এই সমস্ত কাজকর্মের সঙ্গে অপরের অধিকার বা স্বার্থের কোন সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্র ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। ব্যক্তির কার্যকলাপের যে অংশ অপরের অধিকার ও স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তা হল পরকেন্দ্রিক কার্যাবলী। ব্যক্তির পরকেন্দ্রিক কার্যাবলীতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে। অর্থাৎ অপরের অনিষ্ট সাধন থেকে ব্যক্তিকে বিরত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র ব্যক্তির উপর বলপ্রয়োগ করতে পারে। অপরের স্বার্থ ও অধিকারে আঘাত না করা পর্যন্ত ব্যক্তির কাজকর্মের উপর বাধা-নিষেধ আরোপ করা যায় না। স্ববিবেচনা অনুসারে পরিচালিত হওয়ার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তিরই আছে। মিলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সম্পর্কে জোড় (C.E. M. Joad)-এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য। জোডের মতানুসারে মিলের ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল কথা হল : ‘অপরের বিষয়ে আঘাত না করা পর্যন্ত, কোন ব্যক্তির কাজকর্মে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না’।
Leave a comment