অথবা, ব্যক্তির সামাজিকীকরণে পরিবার, বিদ্যালয়, খেলার সাথী ও কৃষ্টির ভূমিকা বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ সমাজের বসবাস উপযোগী উপাদানে পরিণত হওয়াকে সামাজিকীকরণ বলা হয়ে থাকে। সামাজিকীকরণ সমাজজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। এটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলে, তাই এটিকে Life long process বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়া মানুষের ব্যক্তিত্বকে সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে। মূলত সামাজিকীকরণ একটি সামাজিক শিক্ষণ প্রক্রিয়া। Biological organism হিসেবে মানুষ এই পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু সে তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে। মানুষ তার জীবনের প্রতিটি স্তরে স্ব- স্ব সমাজ ও সংস্কৃতির Habits, Values, Norms beliefs ইত্যাদি আত্মস্থ করে সেই সমাজের সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে নিজের Adaptation সাধন করে। মানব শিশুর এই যে জীবনব্যাপী শিক্ষণ প্রক্রিয়া, একেই সামাজিকীকরণ বলা হয়ে থাকে।
ব্যক্তির সামাজিকীকরণঃ নিম্নে ব্যক্তির সামাজিকীকরণে পরিবার, বিদ্যালয়, খেলার সাথী ও কৃষ্টির ভূমিকা আলোচনা করা হলোঃ
ব্যক্তির সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকাঃ সমাজবিজ্ঞান Cooley-এর মতে, “Family is the only primary group and all others are secondary group.” পরিবার ব্যক্তির সামাজিকীকরণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবারে শিশুর জন্ম এবং পরিবারেই সে প্রতিপালিত হয়। সুতরাং ইন্দ্রিয়সর্বস্ব শিশুটিকে সমাজ অনুমোদিত ধারায় গড়ে তোলার দায়িত্ব সর্বপ্রথম পরিবারের ওপর বর্তায়। অর্থাৎ শিশুর মনন ও আচরণকে প্রভাবিত করার সুযোগ পরিবারই প্রথম লাভ করে থাকে। পরিবারেই শিশু প্রথম তার আবেগীয় বন্ধন রচনা করে, ভাষা শেখে, সংস্কৃতি রীতি, মূল্যবোধ আয়ত্মীকরণের [Internalization শিক্ষাগ্রহণ করে। তা ছাড়া, শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশেও পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা শিশুর পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
পরিবারের সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্বরূপ হলো এই যে, পরিবার কোনো না কোনো সামাজিক কাঠামোর মধ্যে অবস্থিত। আর প্রতিটি পরিবারে বৃহত্তর সমাজকাঠামোর প্রতিফলন ঘটে থাকে। ফলে জন্মলগ্ন থেকে শিশু তার উপসংস্কৃতির বিভিন্ন ধরন যেমন- শ্রেণি, বর্ণ, স্বজাত্যবোধ, ধর্ম এলাকা প্রভৃতি সম্বন্ধে ধারণা অর্জন মধ্যে করে, যার প্রত্যেকটি তার পরবর্তী সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পিতা-মাতার সামাজিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে শিশুর মূল্যবোধ ও প্রত্যাশা নির্ণীত হয়ে থাকে। পরিবারের ঐতিহ্য ও সামাজিক অবস্থান কতটা প্রভাব ফেলে শিশুর ওপর তা আমরা দেখতে পাই, হিন্দু পরিবারের বিভিন্ন বর্ণপ্রথার মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুদের গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করলে। পরিবারস্থ লোকজনের সঙ্গে স্নেহ ও ভালোবাসার সম্পর্ক থাকায় তাদের পক্ষে শিশুকে প্রভাবিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ। দৈহিক এবং মানসিক প্রয়োজন চরিতার্থ করার জন্য শিশু নানাভাবে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। উপর্যুক্ত আলোচনায় আমরা বুঝতে পারি যে, সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত পরিবারই সামাজিকীকরণের ভিত্তি রচনা করে। যদিও বর্তমানে সর্বাধুনিক সমাজে সামাজিকীকরণের এ কাজটি সম্পন্ন করছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি Child care home অথবা Day care centre. তবুও পরিবারের গুরুত্ব কমে যায়নি।
(২) ব্যক্তির সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকাঃ পরিবারের মধ্যদিয়ে শিশুর যে সামাজিকীকরণ আরম্ভ হয়, বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সে ধারার অবিচ্ছিন্নতা বজায় থাকে। শিশু যখন প্রথম বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে তার দীক্ষিতকরণ শুরু হয়। বিদ্যালয় হচ্ছে সমাজ দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত সামাজিকীকরণের একটি মাধ্যম, যেখানে শিশু বিশেষ দক্ষতা ও মূল্যবোধ অর্জন করে। এর মাধ্যমে পরিবারের সীমিত গণ্ডি ছেড়ে বৃহত্তর সমাজ প্রচলিত জীবনধারার সঙ্গে শিশুর পরিচয় ঘটে। তার সহপাঠীরা বিভিন্ন পরিবারের সদস্যা। কাজেই বৃহত্তর পটভূমিকায় সে সমাজের মূল্যবোধ, ভাবাদর্শ, সমাজ অনুমোদিত আচার-আচরণ এবং নিষিদ্ধ কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত হবার সুযোগ পায়। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, শিক্ষকের কথাবার্তা, আদেশ-উপদেশ এবং আচার-ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই শিশুর মনে গভীর রেখাপাত করে। বিদ্যালয় শুধু একাডেমিক শিক্ষাই দেয় না বরং অন্যান্য কার্যক্রম যেমন ক্রীড়ার আয়োজন, কোন সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমেও সামাজিকীকরণের শিক্ষা দিয়ে থাকে। এখান থেকেই শিশু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা অর্জন করে। আধুনিককালে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে এমন অনেক মূল্যবোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চার করার চেষ্টা করা হয়, যা সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। এ জন্যই বর্তমানে শিক্ষাকে বিশেষ প্রয়োজনীয় সংযোগকারী শক্তি Interactive Force হিসেবে গণ্য করা হয়।
(৩) ব্যক্তির সামাজিকীকরণে খেলার সাথীর ভূমিকাঃ শিশুরা যখন বড় হতে থাকে তখন তারা সমবয়সী বন্ধুদের সাথে বেশি সময় কাটায়। সমবয়সীদের বয়স, স্বার্থ, জীবন ইতিহাস সাধারণত একই রকম হয়ে থাকে। সমবয়সীদের প্রভাব বাড়তে থাকায় মাতা-পিতার প্রভাব কমে আসে। আমেরিকার বিদ্যালয়গামী শিশুরা তাদের সমবয়সীদের সাথে বেশি সময় কাটায় এবং তাদের অনেকেই এ ধরনের সময় কাটানো পছন্দ করে। সমবয়সীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে অনিচ্ছাকৃত এবং সুচিন্তিত নয়- এ ধরনের সামাজিকীকরণের মধ্যে ফেলে দেয়। এখানে শিশু তার সমকক্ষতার ভিত্তিতে তার পছন্দমতো সঙ্গীদের বেছে নিতে পারে এবং সম্পর্ক স্থাপন করে। পরিবার বা বিদ্যালয়ে যেসব সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল, শিশু এখানে তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে এবং তাতে করে তারা উক্ত প্রতিষ্ঠান দু’টি কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ম অমান্য করতে উৎসাহি হতে পারে এবং পৃথক স্বকীয়তা ও ভূমিকা প্রদর্শন করতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রে সমাজ অনুমোদিত হয় না। বয়ঃসন্ধিকালে সমবয়সীদের প্রভাব চরমভাবে দেখা যায়। তখনই এই তরুণরা নিজেদের রুচি, পোশাক, প্রতিক ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিজেদের মতো করে স্বতন্ত্র উপসংস্কৃতি গড়ে তোলে। সমবয়সীদের মূল্যবোধের প্রতি যে ভালো মনোভাব পোষণ করে, তাকে তারা পছন্দ করে। পক্ষান্তরে বিরূপ মনোভাব পোষণ করলে তাকে তারা তিরস্কৃত করে বা দল থেকে বাদ দেয়।
(৪) ব্যক্তির সামাজিকীকরণে কৃষ্টির ভূমিকাঃ কৃষ্টি ও সংস্কৃতি শব্দটি অনেকসময় একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। স্বাভাবিক অর্থে আমাদের সমাজের আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, নিয়ম-কানুন, রীতিনীতি, প্রথা, বিধি-নিষেধ, কৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কৃষ্টি ব্যক্তির সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি তার নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, শিশু যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সেই পরিবারের পরস্পরিক অবস্থার সাথে যুক্ত হয়ে নিজের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে। ব্যক্তির এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে খেলার সাথী, পরিবার, বিদ্যালয়, স্বীয় সমাজের সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক আলোচনায় এটা বলা যায় যে, ব্যক্তির সামাজিকীকরণে উপর্যুক্ত মাধ্যমগুলো খুবই কার্যকর। এই মাধ্যম ব্যতিত ব্যক্তির সামাজিকীকরণ কখনই সম্ভব হতো না।
Leave a comment