অথবা, ব্যক্তিত্ব বিকাশে এরিকসনের মনোসামাজিক তত্ত্ব বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ আমরা প্রতিনিয়ত ব্যক্তিত্ব শব্দটির মুখোমুখি হই। প্রায়ই আমরা বলি, ‘অমুকের ব্যক্তিত্ব চমৎকার’। এই বাক্য দ্বারা ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু ব্যক্তিত্বের মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ব্যক্তির আচরণের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের একটি সামগ্রিক রূপ। যেমন ব্যক্তির দোষ, গুণ, সামর্থ্য, চেহারা, বিশ্বাস, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, আবেগ ইত্যাদি। এককথায় ব্যক্তির সারসত্তাই হলো ব্যক্তিত্ব।
এরিকসনের গবেষণালব্ধ বিষয়সমূহঃ এরিকসনের গবেষণালব্ধ বিষয়সমূহ নিম্নে প্রদান করা হলো-
শিশুর ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বনাম লজ্জা ও সন্দেহঃ দ্বিতীয় পর্যায়ে শিশুর বয়স যখন ১ থেকে ২ বছরের মধ্যে শিশু তখন কথা বলতে শিখে এমনকি হাঁটতে শিখে। অর্থাৎ এ সময়ে শিশু পৃথিবী সম্পর্কে অধিক জ্ঞান লাভ করে। শিশু এ সময় নিকটস্থ অনেকের সাথে কথা বলতে শিখে। এ সময়ে পিতা-মাতা সন্তানদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিশেষ নজর দেন এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, যা শিশুকে সামাজিকীকরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
(২) বিশ্বাস বনাম অবিশ্বাসঃ শিশুর জন্মাবস্থার পর থেকেই শৈশবকাল শুরু হয়। এর কিছুদিন পর যখন শিশুকে কোলে নেওয়া যায় এবং ভালোভাবে ধরা ও আদর করা যায় এমনি সময়ে তারা তাদের জন্য কি পরিমাণ মৌলিক প্রয়োজনীয়তা সে সম্পর্কে অনুভব করতে শিখে। অর্থাৎ শৈশবকালের ওপর পরবর্তীতে বিকাশ লাভ করার এক লক্ষণ লক্ষ্য করা যায়।
(৩) শিশুর প্রারম্ভিকতা বনাম অপরাধ প্রবণতাঃ এরিকসন তার ব্যাখ্যায় ব্যক্তিত্ব বিকাশের তৃতীয় পর্যায় হিসেবে শিশুর বয়স ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যের সময়কে বুঝিয়েছেন। এ পর্যায়ে শিশুর সঞ্চালন প্রক্রিয়া শুরু হয়। কৌতূহল, কল্পনা এবং স্ত্রী-পুরুষ ভেদাভেদ সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। এ সময়ে শিশু নতুনত্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। যার ফলে শিশু অভিজ্ঞতা অর্জন করে কিভাবে নতুন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে। যা শিশুর ভবিষ্যৎ চলার পথকে সহজ করে।
(৪) শিশুর অধ্যবসায় বনাম হীনতাঃ শিশুর অধ্যয়নকালীন প্রাথমিক পর্যায় হলো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সময়ে শিশু নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ হয়। যেমনঃ বই-পুস্তক অধ্যয়ন এবং শ্রেণিকক্ষের দায়িত্ব সম্পর্কে শিশু কিছুটা জানতে শিখে। এ সময় শিশু শিক্ষকদের ও বড়দের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ সময় তারা প্রকৃত জীবনের ভূমিকা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। যে উদ্দেশ্য শিশুকে তার ভবিষ্যৎ চলার পথ প্রশস্ত করে দেয়। তবে এ পর্যায়ে শিশু দূষণীয় কাজের সাথেও জড়িত হয়। এ খারাপ পথ শিশুকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। তাই সবার উচিত এ পর্যায়ে শিশুকে সঠিক পথে পরিচালিত করা।
পরিচিতি বনাম সম্প্রসারণ ভূমিকাঃ এরিকসন তার ব্যাখ্যায় ৩ পর্যায়কে মানুষের জীবনের একটি দিক নির্ধারণী সময়সীমা বলে উল্লেখ করেছেন। এ পর্যায়ের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে বিবাহের পূর্বে প্রেম নিবেদন, রঙিন স্বপ্ন দেখা, বিবাহ এবং বিভিন্ন ধরনের আন্তরিকতার মহড়া। এ সময় ব্যক্তি খোলাখুলিভাবে বিশ্বস্ত স্বামী অনুসন্ধান করেন। যারা এ সময় স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এসব পন্থা অনুসরণ করে না, পরিণামে তাদের মধ্যে দেখা দেয় বিচ্ছেদ। অনেকক্ষেত্রে যদি বন্ধুত্ব ও স্বতন্ত্রীকরণের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তবে সম্পর্ক হয় সাময়িক ও ভঙ্গুর।
প্রজননতা বনাম নিশ্চলতাঃ এরিকসন এ পর্যায়ে মানবসমাজের একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের মূল্যবান বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। এরিকসন এ পর্যায়ে মধ্যম বয়সের নর-নারীদের কথা বলেছেন। এ সময় মানুষ ব্যস্ত থাকে নিজ নিজ কর্মে এবং সন্তান-সন্তুতি প্রতিপালনে। এ সময় তাদের লক্ষ্য থাকে কিভাবে তাদের যোগ্যতানুযায়ি উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। এ ছাড়া এ সময়ে নর-নারীরা সফলতার সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করেন।
পূর্ণতা বনাম নৈরাশ্যঃ এরিকসন এ পর্যায়কে মানবজীবনের শেষ স্তর বলে চিহ্নিত করেছেন। এ সময়ে ব্যক্তি ব্যস্ত থাকেন কীভাবে বৃদ্ধকাল অতিবাহিত হয় তা নিয়ে। এ ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তি সন্তুষ্টি অর্জন করে এবং নিজেকে সফল মনে করে তাহলে এর পরিণাম হয় পূর্ণ সফল। আর যদি এটা সম্ভবপর না হয় তাহলে ব্যক্তির জীবন নিরাশায় ডুবে যায়।
সমালোচনাঃ পৃথিবীতে খুব কম তত্ত্বই আছে যেগুলো সমালোচনার ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ সমালোচনা ব্যতীত তত্ত্ব খুঁজেই পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে এরিকসনের মনোসামাজিক তত্ত্বও ব্যতিক্রম কিছু নয়। সমালোচকরা মনে করেন, তিনি অনেক ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট তত্ত্ব উপস্থাপন করতে পারেননি। আর এ তত্ত্ব উপস্থাপন না করতে পারাই হলো এই তত্ত্বের ব্যর্থতা।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, মনোবিজ্ঞানী এরিকসন একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মনোসামাজিক তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন। ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে তার মনোসামাজিক তত্ত্ব বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সমালোচনা সত্ত্বেও মনোসামাজিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এটা অনেক তাত্ত্বিকগণই মনে করেন। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন এই তত্ত্ব প্রদানের মাধ্যমে।
Leave a comment