ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ও রম্যরচনার মিল :
-
(i) ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ও রম্যরচনা লেখকের ব্যক্তিগত মেজাজটি বড়ো হয়ে দেখা দেয়।
-
(ii) ব্যক্তিক মনের ভাবনা রাজি উভয় সাহিত্য প্রকরণের মূল বৈশিষ্ট্য।
-
(iii) ব্যক্তিগত প্রবন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-তত্ত্ব উপকরণ উপাদানাদি এবং যুক্তি-তর্ক বিশ্লেষণ যেমন থাকে তেমন রম্যরচনাতেও-এর কিছু কিছু থাকে।
ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ও রম্যরচনার অমিল :
(i) রম্য রচনা অবিমিশ্রভাবে এক ধরনের লঘু রচনা যা সুচারু পরিমার্জিত, সুললিত, গদ্য সমন্বিত, যা গম্ভীর বিষয় বর্জিত এবং জীবনে কৌতুক কর অনুভবের পরিচয়মূলক। অন্যদিকে ব্যক্তিগত প্রবন্ধে ব্যক্তিক মনের হৃদয়াবেগ বড়ো হলেও প্রবন্ধ সুলভ যুক্তিনিষ্ঠা, ভাবনার নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা ও মননশীলতাই বড়ো কথা হয়। তা কৌতুককর অনুভবের বিপরীত মেরুর।
(ii) রম্যরচনার বিষয়বস্তুর কেন্দ্রে থাকে সহজ ও মজাদার বিষয় প্রতীতি। এ ক্ষেত্রে রচনাকে একই সাথে রমণীয় ও মজাদার করা হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রবন্ধে এরূপ কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এখানে তথ্য ও তত্ত্বের যুক্তি শৃঙ্খলায় সাজানো বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিকে সৌন্দর্য চেতনা ও রসানুভূতিতে জারিত করা যায়।
(iii) রম্যরচনা ছাঁদ হয় পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিচার-বিশ্লেষণ থেকে দূরবর্তী এক লঘুচালের রীতি। রম্যরচনার নির্মাণ রীতিতে কোথাও থাকে খানিক গল্পের আভাস, আবার কোথাও থাকে একটু কাব্যের মাধুর্য, আবার হয়তো কোথাও-বা হাস্য পরিহাস ও কৌতুকের আলিঙ্গন।
ব্যক্তিগত প্রবন্ধ লঘুচালের দাবিকে উপেক্ষা করতেই পারে। এখানে ব্যক্তি প্রাবন্ধিকের নানা ভাবনা, নানা রং অনেকটা নানা ফুলের মালা গাঁথার মতো করে রচিত হয়। তবে এটি অবশ্যই বিচার-বিশ্লেষণমূলক, গল্প বা কাব্যের আভাস তাতে থাকে না।
(iv) রম্যরচনা সহজ ও নানা বাহারি ভাবের সমবায়ে সৃষ্ট এক সাহিত্য মাধ্যম। যার কোনো স্থির নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না। জাগতিক যে-কোনো বিষয় অবলম্বনে প্রগলভতা ও চাপল্যের বৈঠকি চালে এ জাতীয় রচনা সার্থকতা লাভ করে।
অপরদিকে ব্যক্তিগত প্রবন্ধ অবশ্যরূপে গুরুগম্ভীর ভাবের রূপায়ণ করে। এ জাতীয় প্রবন্ধ জাগতিক যে-কোনো বিষয়কে অবলম্বন করলেও তা ব্যক্তির মৌলিক সৃজন শীলতাকেই গুরুত্ব দেয়। ফলে ভাষা ও বিষয় প্রগলভতা কিংবা চাপল্য থেকে শত যোজন দূরে অবস্থান করে।
আসলে ব্যক্তিগত প্রবন্ধ এবং রম্যরচনা ব্যক্তি সাপেক্ষে রচনা হলেও এই দুই সাহিত্য মাধ্যম সদর্থে দুটি সমান্তরাল ধারা। একের সঙ্গে অন্যের মেলেনা। ব্যক্তিগত প্রবন্ধ সদা সর্বদা ভারি বা পণ্ডিতি সুর বিশিষ্ট। আর রম্যরচনা সহজ বা ঘরোয়া সদর্থে বলতে হয় ব্যক্তিগত প্রবন্ধের সঙ্গে রম্যরচনার সম্পর্কটি দূরবর্তী। যদিও ব্যক্তিগত প্রবন্ধ কী রম্যরচনার উদ্দেশ্য থাকে সহৃদয়হৃদয়সংবাদী হওয়া। এই প্রেক্ষিতে মনে রাখতে হবে কখনো কখনো ব্যক্তিগত প্রবন্ধ রমণীয় রচনা হতে পারে। কিন্তু রম্যরচনা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ হতে পারেনা। বাংলা সাহিত্য থেকে দুটি উদাহরণ নিয়ে এই দুই সাহিত্য প্রকরণের পার্থক্যকে স্পষ্ট করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ ব্যক্তিগত প্রবন্ধের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। গ্রন্থটির রচনাগত সার্থকতার নির্দেশে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য ছিল—এর মূল্য “বিষয়বস্তুর গৌরবে নয়, রচনার রস সম্ভোগে”। এ গ্রন্থের অধিকাংশ রচনার বিষয় অপেক্ষা বিষয়ীর গৌরবই লক্ষণীয়। ‘পাগল’, ‘বাজে কথা’, ‘নববর্ষা’, ‘কেকার ধ্বনি’, ‘পরনিন্দা’, ‘বসন্ত যাপন’, ‘রুদ্ধগৃহে’, ‘পথ প্রান্তে’, ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’, ‘আষাঢ়’ প্রবন্ধে বিষয়গত গাম্ভীর্যের পরিবর্তে প্রকাশ শৈলীর সৌন্দর্যে আত্মগত চিন্তার চমৎকার প্রতিফলন ঘটেছে। যার ফলে পাঠক এতে অনায়াসে লেখকের মন স্পর্শ করতে পারেন, হাত ধরতে পারেন। উদাহরণ হিসাবে ‘বাজে কথা’র উদ্ধৃতি গ্রহণ করা যায়। যথা—
- (i) “অন্য খরচের চেয়ে বাজে খরচেই মানুষকে যথার্থ চেনা যায়। কারণ মানুষ ব্যয় করে বাঁধা নিয়মানুসারে অপব্যয় করে নিজের খেয়ালে।”
- (ii) “যেমনি বাজে খরচ তেমনি বাজে কথা। বাজে কথাতেই মানুষ আপনাকে ধরা দেয়। উপদেশের কথা যে রাস্তা দিয়া চলে, মনুর আমল হইতে তাহা বাঁধা। কাজের কথা যে পথে আপনার সোপান টানিয়া আনে, সে পথ কেজো সম্প্রদায়ের পায়ে পায়ে তৃণ পুষ্প শূন্য বিহিত হইয়া গেছে। বাজে কথা নিজের মতো করিয়াই বলিতে হয়।”
অপরদিকে রম্যরচনার উদাহরণ হিসাবে বুদ্ধদেব বসুর ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি গ্রন্থটিকে দৃষ্ঠান্ত রূপে গ্রহণ করা যায়। এর বিষয়সূচি উল্লেখ করলেই বোঝা যায় এটি রম্যরচনার গোত্র অর্জনে সক্ষম। পুরানা পল্টন, ক্লাইভ স্ট্রিটে চাঁদ, কলকাতার ছাদ, বাথরুম, রূপ ও স্বরূপ মৃত্যু, জল্পনা, পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, সরস্বতী, ভূতের ভয়। উদাহরণ হিসাবে পুরানা পল্টন এবং বাথরুম থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যায়—
- (i) পুরানা পল্টন—“অনেকদিন আগে যে মেয়েকে ভালোবাসতাম, হঠাৎ কেউ যেন আমার সামনে তার নাম উচ্চারণ করল। এককালে যে নিতান্ত আপন ছিল তার নাম আজ কানে ঠেকছে নতুন।” (পুরানা পল্টন)
- (ii) “আমার রচনা যদি বাথরুম সাহিত্য হয় তাহলেই প্রমাণ হল তার কিছু মূল্য আছে। পৃথিবীর লেখা যত সাহিত্য নামের যোগ্য সবই বাথরুম সাহিত্য। তা আপনি হাতে তুলে নিতে পারেন, চোখ বুলিয়ে যেতে পারেন তার উপর, দুলাইন লিখে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন—তার বেশি পারেন না! বাথরুম হচ্ছে সেই পবিত্র অবরুদ্ধ মন্দির, মানুষ সেখানে নগ্ন আর মুক্ত আর নিঃসঙ্গ—সমস্ত সাহিত্যের উৎস সেখানে।”
গ্রন্থ দুটির পারস্পরিক তুলনায় দেখা যাবে ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে রয়েছে লঘু চাপল্যের কারবার—কৌতুকের আবহ। কিন্তু ‘বিচিত্র প্রবন্ধে’ ভাববার কথা, অবকাশের কথা, বাজে কথা, জীবনের অন্তঃস্থিত কিছু উপলব্ধির কথা—নিজের সঙ্গে বলা কথার মতন—পাঠকের মুখোমুখি প্রাবন্ধিক করেছেন। এ কারণেই প্রথমটি রম্যরচনা, দ্বিতীয়টি ব্যক্তিগত প্রবন্ধ।
Leave a comment