ব্যক্তিগত পত্র রচনার কতিপয় শর্ত বা নিয়ম
ব্যক্তিগত পত্র রচনা-পদ্ধতিতে কিছুটা স্বাধীনতা থাকলেও প্রায় সব ধরনের পত্রেই রীতি-পদ্ধতি একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। তবে বিচক্ষণ ও প্রতিভাবান লেখকেরা সবক্ষেত্রেই কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় উপস্থাপন করতে পারেন। কিন্তু পত্র রচনার ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত কাঠামাে মেনে নিয়েই সবাই পত্র রচনা করে থাকেন। প্রচলিত কাঠামােতে চিঠিপত্রে সাধারণত ছয়টি অংশ রয়েছে। সেগুলাে হলাে一
১. মঙ্গলােচ্চারণ বা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ ।
২. ঠিকানা ও তারিখ।
৩. সম্বােধন।
৪. মূলপত্র।
৫. পত্র লেখকের নিবেদন ও স্বাক্ষর।
৬. শিরােনাম (প্রেরক ও প্রাপকের নাম-ঠিকানা সংবলিত এবং ডাকটিকিটযুক্ত খাম)। প্রেরকের নাম-ঠিকানা ও প্রাপকের নাম-ঠিকানা চিঠিপত্রের খামের গায়ে লেখা বাধ্যতামূলক।
১। মঙ্গলােচ্চারণ বা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ :
আমাদের দেশের লােকদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কারের প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। তারা কাজ শুরু করার সময় সৃষ্টিকর্তা অথবা নিজ ধর্মের প্রশংসা করতে আগ্রহী । চিঠিপত্র লেখার ক্ষেত্রে বিষয়টি লক্ষ করা যায়।
বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ পত্রের মঙ্গলােচ্চারণ অংশে বিভিন্ন ভাব প্রকাশ করে থাকে এবং বিশ্বাস করে যে, তার দ্বারা কোনাে না কোনাে মঙ্গল সাধন সম্ভব। যেমনㅡ
মুসলিম রীতিতে : ইয়া-রব, এলাহি ভরসা, আল্লাহ ভরসা।
হিন্দু রীতিতে : শ্রীশ্রী হরি সহায়, শ্রীশ্রী দুর্গা সহায় ।
বৌদ্ধ রীতিতে : বুদ্ধং সরনং গচ্ছামি।
খ্রিষ্টান রীতিতে : ঈশ্বর মঙ্গলময় (God is good)।
উল্লেখ্য যে, পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই অংশকে অপরিহার্য বিবেচনা করা হয় না। কারণ আধুনিক মানুষ দিনের পর দিন বিশ্বাস অপেক্ষা যুক্তির ওপর বেশি নির্ভর করে; মঙ্গলেচ্চিারণকে একটা সংস্কার হিসেবে মনে করে। আধুনিক শিক্ষিত সমাজ এ। অংশটিকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে পত্র লেখে। তাই এ অংশকে পত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা না করলেও হবে।
✱ প্রারম্ভিক সম্ভাষণ
শ্রদ্ধাভাজন পুরুষ : শ্রদ্ধাভাজনেষু, শ্রদ্ধাস্পদেষ্ণু, পরম পুরুষ শ্রদ্ধাস্পদ, মান্যবর, মান্যবরেষু, মাননীয়, মাননীয়েষু ইত্যাদি।
শ্রদ্ধাভাজন মহিলা : শ্রদ্ধেয়া, শ্রদ্ধাস্পদাসু, মাননীয়া, মাননীয়াসু, ইত্যাদি।
সম্রান্ত ব্যক্তি : মান্যবর, সুধী, সৌম্য ইত্যাদি।
বন্ধু (পুরুষ) : প্রিয়, সুপ্রিয়, প্রিয় বন্ধু, বন্ধুবরেষু, প্রিয়বরেষু, প্রিয়বর, বন্ধুবর, সুহৃদবরেষু,
প্রীতিভাজনেষু ইত্যাদি।
বন্ধু (মহিলা) : প্রিয়তমা, সুচরিতাসু, প্রীতিনিলয়াসু, সুহৃদয়াসু, প্রীতিভাজনীয়াসু ইত্যাদি।
বয়ঃকনিষ্ঠ ছেলে: স্নেহের, স্নেহভাজনেষু, কল্যাণীয়, কল্যাণীয়েষু, স্নেহাস্পদেষু, প্রীতিভাজনেষু ইত্যাদি।
বয়ঃকনিষ্ঠ মেয়ে: বয়ঃকনিষ্ঠ স্নেহের, স্নেহভাজনীয়া, কল্যাণীয়া, কল্যাণীয়াসু, স্নেহভাজনীয়াসু ইত্যাদি।
✱বিদায় সম্ভাষণ
প্রাপক শ্রদ্ধাভাজন (পত্র লেখক পুরুষ) : বিনীত, গুণমুগ্ধ, স্নেহধন্য, স্নেহাকাতক্ষী, প্রীত্যৰ্থী, প্রীতিধন্য, প্রণত ইত্যাদি।
প্রাপক শ্রদ্ধাভাজন (পত্র লেখক মহিলা) : বিনীতা, গুণমুগ্ধা, স্নেহধন্যা, প্রণতা, সেবিকা, প্রীতিধন্যা, প্রীতিস্নিগ্ধা ইত্যাদি।
প্রাপক অনাত্মীয় সম্মানীয়া লােক (লেখক পুরুষ) : বিনীত, নিবেদক, বিনয়াবনত, সম্মানীয় ভবদীয় ইত্যাদি।
প্রাপক অনাত্মীয় সম্মানীয়া লােক (পত্র লেখক মহিলা) : প্রতিধন্যা, প্রীতিমুগ্ধা, অভিন্নহৃদয় |
প্রাপক প্রিয়ভাজন/ বন্ধু (পত্র লেখক মহিলা) : প্রীতিধন্য, প্রীতিমুগ্ধ, আপনারই, তােমারই ইত্যাদি।
প্রাপক প্রিয়ভাজন/ বন্ধু ((পত্র লেখক মহিলা) : প্রীতিধন্যা, প্রতিমুগ্ধা ইত্যাদি।
প্রাপক বয়সে ছােট : শুভার্থী, শুভাকাঙ্ক্ষী, আশীর্বাদক / আশীর্বাদিকা, শুভানুধ্যায়িনী ইত্যাদি। ]
২। ঠিকানা ও তারিখ :
চিঠির ঠিকানা ও তারিখ চিঠিপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চিঠিটি কত তারিখে এবং কোথা থেকে লেখা হলাে তার স্পষ্ট উল্লেখ থাকা প্রয়ােজন। কারণ চিঠির মধ্যে নানা ধরনের নির্দেশ বা অনুরােধ থাকতে পারে এবং তার সঙ্গে স্থানকাল-পাত্রের একটি সম্বন্ধ থাকা অযৌক্তিক কিছু নয়। তাছাড়া ভবিষ্যতে কোনাে কারণে চিঠিটির স্থান ও কাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হয়ে দেখা দিতে পারে। প্রত্যেক পত্রেরই একটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে, কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।
৩। সম্বােধন :
‘সখােধন’ পত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পত্রের ক্ষেত্রে তার বৈচিত্র্য এত বেশি যে, সে বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে । সতর্ক না হলে নানা রকম বিভ্রাট ঘটতে পারে। যেহেতু একজন ব্যক্তি বিভিন্ন প্রকার লােকের সঙ্গে পত্রালাপ করতে পারেন, সেহেতু এ সমােধনের রূপ-রীতি বহু প্রকার । লেখকের কাছ থেকে প্রাপকের জন্য কীরূপ মর্যাদা প্রত্যাশিত তার ওপরই নির্ভর করে সমােধনের রূপ-রীতি। পুরুষ-মহিলাভেদে এবং ধর্মভেদেও এর পরিবর্তন ঘটতে পারে। যেমনㅡ
ক. নিকট আত্মীয় গুরুজনকে – শ্রদ্ধেয় পাকজনাবেষু (মুসলিম), শ্রীচরণ কমলেষু (হিন্দু)। আধুনিক যুগে সরাসার আর, আম্মু, দাদু, কাকা এ ধরনের সহজ সমােন প্রচলিত রয়েছে।
খ. কনিষ্ঠ নিকট আত্মীয়কে – দোয়াবর, দোয়াবরেষু (মুসলিম), স্নেহবরেষু, কল্যাণীয়েষু (হিন্দু)। আধুনিক যুগে নাম উল্লেখ করে সম্বােধন প্রচলিত রয়েছে।
গ. শ্রদ্ধাভাজন অপরিচিত ব্যক্তিদের – মাননীয় মহাশয়, শ্রদ্ধেয় জনাব।
ঘ. কোনাে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে – মহাশয়, জনাব, প্রিয় মহােদয় ।
ঙ. বন্ধুকে – প্রিয়, সুপ্রিয়, বন্ধুবরেষু, প্রিয়বরেষু ইত্যাদি।
৪। মূলপত্র :
পত্রের বক্তব্য বিষয় এই অংশে থাকবে। এরও তিনটি অংশ আমরা বিবেচনা করতে পারি । প্রথম অংশ প্রাথমিক বক্তব্য বা সূচনা, দ্বিতীয় অংশ মূল বক্তব্য বিষয় এবং তৃতীয় অংশ সমাপনী বক্তব্য । প্রথম ও শেষ অংশ প্রায় ক্ষেত্রেই প্রথাসিদ্ধ, তবে মূল বক্তব্যের তারতম্য অনুযায়ী এর কিছু ব্যতিক্রম ঘটতে পারে। প্রাপকের সঙ্গে প্রেরকের সম্পর্কের ওপরও এ প্রথাসিদ্ধতার একটি সম্পর্ক বিদ্যমান।
৫। পত্র লেখকের নিবেদন ও স্বাক্ষর :
স্বাক্ষরের আগে পত্র লেখক নিমরূপ বিনয় প্রকাশ করে থাকেন। নানা অবস্থায় এর কিছুটা ব্যতিক্রম হয়। যেমন—
ক. গুরুজনদের প্রতি – (ইতি) আপনার স্নেহের, আপনার গুণমুগ্ধ, আপনার স্নেহধন্য ইত্যাদি।
খ. কনিষ্ঠদের প্রতি – (ইতি) আশীর্বাদক, তােমার মঙ্গল প্রত্যাশী ইত্যাদি।
গ. বন্ধু-বান্ধবীদের প্রতি – (ইতি) তােমারই প্রীতিসিক্ত, প্রীতিমুগ্ধ, প্রীতিধন্য ইত্যাদি।
ঘ. দরখাস্ত বা আবেদনপত্রে – (নিবেদক) আপনার বিশ্বস্ত, আপনার অনুগত।
চিঠিপত্র শেষে পত্রলেখকের স্বাক্ষর থাকা বাঞ্ছনীয়। স্বাক্ষরবিহীন পত্র কোনাে গুরুত্বই বহন করে না। অপরের দ্বারা পত্র লিখিয়ে নিলেও স্বাক্ষর নিজের হাতে করতে হয় ।
৬। শিরােনাম :
পত্র লেখার পর পত্রখানি খামে ভরে খামের ওপরের দিকে ডানপাশে ডাকটিকিট লাগাতে হয়। খামের মাঝামাঝি ডানপাশে প্রাপকের নাম, ঠিকানা এবং বামপাশে প্রেরকের নাম, ঠিকানা লিখতে হয়। পত্র বিষয়ক শেষ কথা : পত্র লেখার পূর্বশর্তগুলাে আলােচনা সাপেক্ষে অপর একটি প্রশ্ন থেকে যায়, পত্রের ভাষা কী ধরনের হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের নির্দেশ হলাে বিষয়ের গুরুত্ব অনুযায়ী ভাষার গুরুত্ব নির্ধারণ করা। সাধারণ রচনা সম্পর্কিত এ বক্তব্য পত্রের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। তবে সাধারণত আমাদের ব্যাবহারিক জীবনের চিঠিপত্রের ভাষা সহজবােধ্য ও সরল হবে এটিই কাম্য। আমাদের ইদানীংকার শিক্ষিত ভদ্রলােকদের মুখের ভাষা হলাে চলিত ভাষা। তাই চলিত ভাষায় চিঠিপত্র লেখাই সবচেয়ে সময়ােপযােগী হবে।
ব্যক্তিগত পত্র রচনার উদাহরণ
✱ মাদকাসক্তির কুফল জানিয়ে ছোট ভাইকে একটি উপদেশ মূলক পত্র লেখ।
৫/২, মিরপুর-১০, ঢাকা।
২০ মার্চ ২০১৭
স্নেহের সৃজন
আমার স্নেহাশিস নিও। আশা করি, ভালাে আছ। তােমার ভালাে থাকাটাই আমার কামনা।
গতকাল মায়ের চিঠি পেলাম। চিঠিতে বাড়ির খোঁজখবর জানতে পারলাম। তবে একটি খবর আমাকে খুবই চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তা হলাে, তুমি নাকি কিছুদিন যাবৎ অসৎ ছেলেদের সাথে মিশে ধূমপান করছ। মা লিখেছেন, তিনি নাকি অন্য কারাে কাছ থেকে শুনেছেন। তাই ব্যাপারটা সত্য না মিথ্যা তা তুমিই ভালাে জানাে । যদি তা সত্য হয়, তবে খুবই দুঃখজনক। আমার পক্ষ থেকে তােমার জন্য সাবধান বাণী এই যে, যতদূর এগিয়েছ, সেখানেই থেমে যাও। ওপথ খুবই অন্ধকার, ভয়ংকর আর জীবনগ্রাসী। যারা নেশাগ্রস্ত হয় তাদের অনেকেই মনে করে তা তাদের অভ্যাসে পরিণত হবে না। তারা খেলাচ্ছলে মাদকদ্রব্য সেবন করছে। কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, তা একদিন তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। মাদকদ্রব্য গ্রহণের এ অভ্যাস মানবজীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে। মাদকাসক্তি মানুষের স্নায়ুকে দুর্বল ও অকার্যকর করে দেয়। এর ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তি লােপ পেতে থাকে। মাদকাসক্তি মানুষকে অন্ধকার পথে নিয়ে যায়। মাদকাসক্ত লােকেরা মাদকদ্রব্য সংগ্রহের জন্য চুরি, ডাকাতি, খুন, ছিনতাই প্রভৃতি অপকর্মে লিপ্ত হয়। মাদকাসক্তি শুরুর দিকে সাধারণ নেশা থাকলেও এর সর্বশেষ পরিণতি অনিবার্য মৃত্যু। মাদকাসক্তদের কারণে তার পরিবার ও সমাজ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমার পরামর্শ হচ্ছে, তুমি যদি ওপথে পা বাড়িয়ে থাকো তবে দেরি না করে এখনই ফিরে এসাে । নিজের পড়াশুনার প্রতি মনােযােগী হও। নিজেকে ভালােভাবে গড়ে তুলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখাে। তােমার মঙ্গল কামনায় শেষ করছি।
তােমার বড়াে ভাই
সৌমিত্র
Leave a comment