বৌদ্ধ ধর্মমত :
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ধর্ম আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী সাড়া জাগানো নামটি হল বৌদ্ধধর্ম। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ বা গৌতম ‘সত্য জ্ঞান’ বা ‘বোধ’ লাভ করার পর এই মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। তাই এটি ‘বৌদ্ধধর্ম’ নামে অভিহিত হয়। তবে গৌতমের আবির্ভাব, নির্বাণ, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে কিছু সংশয় ও বিতর্ক আছে। এর মূল কারণ গৌতমের জীবন কাহিনী সম্পর্কে তথ্য নিষ্ঠ বা সমকালীন উপাদানের অভাব। সমকালীন উপাদানের মধ্যে সুত্তনিপাত গ্রন্থের দুটি কবিতা এবং কয়েকটি প্রাচীন ‘সুক্ত’ পাওয়া যায়। স্বভাবতই গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরবর্তীকালের রচনাবলীর ওপর নির্ভর করতে হয়। এই জাতীয় রচনাবলীর মধ্যে সিংহলীয় ইতিবৃত্ত ‘মহাবংশ’ ও ‘দীপবংশ’, জাতক কাহিনী এবং কিছু পরবর্তীকালের রচিত ‘ললিত বিস্তার’ ও ‘বুদ্ধচরিত’ উল্লেখ্য। তবে এই সকল উপাদান থেকে বুদ্ধের জীবনধারা সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করা যায় না। এই কারণে ঐতিহাসিক এ. এল. ব্যাসাম (A. L.. Basham) বলেছেন যে, তাঁর জীবন নয়, পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীরা এই জীবন সম্পর্কে কি বিশ্বাস করতেন, সেটাই আমাদের আলোচ্য হতে পারে। অনুরূপভাবে বুদ্ধদেব কি বলেছেন তা না ভেবে, তাঁর শিষ্যরা বৌদ্ধদর্শন সম্পর্কে কি বিশ্বাস করতেন, সেটিই আলোচনা করা সহজ। এক্ষেত্রেও পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। রীজ ডেভিডস (Rhys Davids), ওল্ডেনবার্গ (H. Oldenberg ) প্রমুখ মনে করেন যে, পালি বৌদ্ধশাস্ত্রের বক্তব্যই বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য। অন্যদিকে শেরবাটস্কি, ভ্যালে পুসা (Valle Paussin) প্রমুখ সংস্কৃত বৌদ্ধশাস্ত্র এবং তাদের চৈনিক ও তিব্বতীয় অনুবাদকে বেশী নির্ভরযোগ্য মনে করেন।
বর্তমান নেপালের অন্তর্গত তরাই অঞ্চলে কপিলাবস্তু অঞ্চলের শাক্য উপজাতির নেতা শুদ্ধোধন ও কোলিয় উপজাতিভুক্ত মায়াদেবী (মহামায়া) সন্তান ছিলেন সিদ্ধার্থ। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দে (মতান্তরে ৫৬৬ অব্দে) তিনি জন্ম নেন। জন্মের সাতদিন পরে তিনি মাতৃহীন হন এবং বিমাতা ও মাতৃস্বসা মহাপ্রজাবতী গৌতমীর কাছে পালিত হন। তাই তাঁর অপর নাম গৌতম। ক্ষত্রিয় রীতি অনুযায়ী তিনি বাল্যকালে ও কৈশোরে সাধারণ শিক্ষা, অস্ত্রবিদ্যা, রথচালনা, শরীরচর্চা ইত্যাদি নানা বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেন। যশোধরা বা গোপা নাম্নী এক মহিলার সাথে তাঁর বিবাহ হয়। ঊনত্রিশ বছর বয়সে তাঁর একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। পুত্রের নাম ছিল রাহুল। স্ত্রী-পুত্রের মায়া কিংবা রাজ্যের ভোগবিলাস কোন কিছুই তাঁকে সংসারবন্ধনে আটকে রাখতে পারেনি। বাস্তব জগতের দুঃখকষ্ট তাঁকে দ্রুত সংসারবিমুখ করে তোলে। কথিত আছে যে, চারটি বিশেষ দৃশ্য তাঁর মনে গভীর অনুতাপ ও বৈরাগ্য সৃষ্টি করেছিল। এগুলি হল এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি, একটি মৃতদেহ এবং এক মায়ামোহ মুক্ত আনন্দপ্রাণ সন্ন্যাসী। প্রথম তিনটি দৃশ্য তাঁর মনে অনুতাপের সঞ্চার করে। কিন্তু চতুর্থ দশ্যটি তাঁকে বৈরাগ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুজনিত পীড়ার কারণ অনুসন্ধানে জন্য সিদ্ধার্থ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে জরা, ব্যাধি, মৃত্যুর হাত থেকে মানুষের মুক্তি নাই। তাই সন্ন্যাসীর ব্রত নিয়ে এই সকল পীড়ার হাত থেকে মানুষের মুক্তির পথ অনুসন্ধান করাকেই তিনি ‘কর্তব্য’ বলে গ্রহণ করেন। পুত্র রাহুলের জন্মগ্রহণের রাতেই সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন। এই ঘটনা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে ‘মহাভিনিষ্ক্রমণ’ নামে খ্যাত।
গৃহত্যাগ করার পর গৌতম সন্ন্যাসীর বেশে নানা স্থান পরিভ্রমণ করে জ্ঞানের অনুসন্ধান চালান। বৈশালীতে এসে আঢ়ার কালাম ও উদ্রক রামপুত্রকের কাছে আধ্যাত্মিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু এই অনুসঙ্গেও তিনি মুক্তির পথ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। শাস্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞান ও আত্মসংযম মুক্তির পথ অনুসন্ধানের পক্ষে যথেষ্ট নয় বলেই তাঁর মনে হয়। অতঃপর তিনি সন্ন্যাসীর সঙ্গ ত্যাগ করে পাঁচজন তপস্বীর সাথে যোগ দেন। এই পঞ্চতাপস সেই সময় কঠোর কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে সত্যানুসন্ধানের কাছে ব্রতী ছিলেন। গৌতম দীর্ঘ ছয় বছর এঁদের সাথে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে সত্যের অনুসন্ধান চালান। এই সময় তিনি একটি চলমান কঙ্কালে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে উপবাস, অনাহার ইত্যাদি কৃচ্ছসাধনের পথে মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। ফলে এই পথও তিনি বর্জন করেন। এরপর তিনি একদা নিরগুনানদীর তীরে এক বট বৃক্ষের নিচে বসে বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হন। এইভাবে ঊনপঞ্চাশ দিন গৌতম ধ্যানমগ্ন থাকার পর ‘দিব্যজ্ঞান’ বা ‘বোধিলাভ’ করেন। এখন থেকে তিনি ‘বুদ্ধ’ (জ্ঞানী), ‘তথাগত’ (পরম সত্যের সাথে পরিচিত) ইত্যাদি নামে পরিচিত হন। আরো সাত সপ্তাহ তিনি ঐ বৃক্ষের তলায় বসে থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান সম্পর্কে আত্মবিশ্লেষণ করেন। এইভাবে জরা-ব্যধি-মৃত্যু এই ত্রিতাপ দুঃখ থেকে তিনি নির্বাণ বা মুক্তিলাভের পথ খুঁজে পান। বুদ্ধের নামানুসারে ঐ স্থানটি ‘বুদ্ধগয়া’ নামে এবং ঐ বৃক্ষটি ‘বোধিদ্রুম’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
পরম সত্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর এই জ্ঞান তিনি প্রচার করবেন কিনা সে বিষয়ে বুদ্ধের সংশয় ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি পরম জ্ঞানপ্রচারের সিদ্ধান্ত নেন এবং আজীবন ধর্মপ্রচারকের ব্রত পালন করে যান। প্রথমে গৌতমবুদ্ধ বারাণসীর নিকটে ‘মৃগদাব’ নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে আগেকার পাঁচজন সঙ্গীর কাছে সর্বপ্রথম তাঁর লব্ধ জ্ঞান প্রচার করেন। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এই ঘটনা ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন’ নামে খ্যাত। এরপর নানাস্থানে উপস্থিত হয়ে তিনি ধর্মপ্রচার চালাতে থাকেন। অল্পকালের মধ্যে গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে বহু মানুষ গৌতমবুদ্ধের অনুগামীতে পরিণত হন। এদের মধ্যে যেমন ছিলেন জ্ঞানীতি, রাজপুরুষ, তেমনি ছিলেন দীন-দরিদ্র অতি সাধারণ মানুষ। গৌতমবুদ্ধের প্রথম দিকের প্রখ্যাত শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন সুপণ্ডিত সারিপুত্র, মৌদ্গলায়ন, ধনী বণিক অনাথপিণ্ডক, রাজপুরুষ বিম্বিসার, অজাতশত্রু প্রমুখ। তিনি কপিলাবস্তুতে এসে পিতা, মাতা, স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের সদস্যদেরও নিজ ধর্মে দীক্ষিত করেন। বুদ্ধের জীবিতকালে বারাণসী, রাজগৃহ, উরুবিশ্ব, নালন্দা, মগধ, কোশল প্রভৃতি স্থানে তাঁর ধর্মমত বহুল প্রচারিত হয়েছিল। কোশলরাজ প্রসেনজিৎ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি দীর্ঘকাল কোশলের অন্তর্গত শ্রাবস্তী (রাজধানী) নগরে অবস্থান করে নিজ মতপ্রচার করেছিলেন।
সমস্ত স্তরের মানুষ যাতে তাঁর বাণী উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় সেজন্য সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ‘প্রাকৃত’ ভাষায় বুদ্ধ নিজ বক্তব্য প্রচার করেন। সত্যজ্ঞান প্রচারের উদ্দেশ্য তিনি গয়া, রাজগৃহ, কলিপাবস্তু, শ্রাবস্তী হয়ে রাজগৃহে যান। রাজগৃহে অসুস্থ হলে জীবক কুমার ভৃত্যের চিকিৎসায় সুস্থ হন। তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগে কোশলরাজ বিছুড়ভ কর্তৃক শাক্যরাজ্য ধ্বংস হলে তিনি গভীর মর্মাহত হন। তবুও ধর্মপ্রচার অব্যাহত রাখেন। তাঁর শেষ শিষ্য ছিলেন পাবা অঞ্চলের জনৈক কামার চুন্দ। এখানেই তিনি তীব্র পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। এইভাবে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর মানুষের মাঝে অহিংসা ও মুক্তির বাণী প্রচার করে আনুমানিক ৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গোরক্ষপুর জেলার কুশীনগরে তিনি দেহত্যাগ করেন। এই ঘটনাকে বৌদ্ধ ইতিহাসে ‘মহাপরিনির্বাণ’ নামে স্মরণ করা হয়।
শোক, ব্যাধি, জরা, মৃত্যু ইত্যাদি নিত্য-পীড়া থেকে মানুষকে মুক্ত করাই ছিল গৌতমবুদ্ধের লক্ষ্য। এই কারণে তাঁর মতবাদে গভীর দার্শনিক জটিলতা নেই। জগৎ নিত্য বা অনিত্য, দেহ ও আত্মার সম্পর্ক কি ইত্যাদি জটিল দর্শনতত্ত্বের আলোচনায় বুদ্ধ কোনরূপ আগ্রহ দেখাননি। তাঁর মতে, তীরবিদ্ধ মানুষের শুশ্রুাটাই প্রধান ও প্রাথমিক কর্তব্য। তীর কোথা থেকে এল ইত্যাদি জানা নিষ্প্রয়োজন। সম্ভবত, এই কারণে নির্বাণলাভের পর আত্মার কি গতি হয় সে প্রসঙ্গে তিনি নীরব থেকেছেন। বাস্তববাদী সংস্কারক গৌতমবুদ্ধের পরম জ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয় হল মানুষের দুঃখকষ্টের অবসানের পথনির্দেশ। নবলব্ধ ‘বোধি’র আলোকে চারটি সত্য তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়েছিল। এই চারটি সত্য হল- (১) এ পৃথিবী দুঃখময়; (২) কামনা-বাসনা-আসক্তি ইত্যাদি দুঃখের উৎস (সমুদয়); (৩) কামনা-বাসনার নিবৃত্তি, দুঃখের অবসান ঘটায় (নিরোধ) এবং (৪) আসক্তি ও কামনা-বাসনা থেকে নিবৃত্তিলাভের জন্য নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করতে হয় (মার্গ)। এগুলি বৌদ্ধদর্শনে ‘আর্যসত্য’ (চত্বারি আর্যসত্যানি’) নামে পরিচিত।
দুঃখের কারণ উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে গৌতমবুদ্ধ সেই দুঃখযন্ত্রণার নিরসনের পথও অনুসন্ধান করেছেন। বুদ্ধের মতে, দুঃখ হল সর্বব্যাপক। আপাতভাবে যেখানে সুখের অস্তিত্ব দেখা যায়, গভীরভাবে দেখলে সেখানেও দুঃখের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাবে। তাঁর মতে, জন্মই হল দুঃখদুর্দশার মূল কারণ এবং জন্মের কারণ হল পার্থিব বিষয়ের প্রতি জীবের তৃয়া বা আসক্তি। এবং তৃয়া বা আসক্তির প্রধান কারণ হল অজ্ঞানতা। সুতরাং বৌদ্ধদর্শন অনুসারে একমাত্র জ্ঞানই জীবকে দুঃখদুর্দশার হাত থেকে বাঁচাতে পারে। এই দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের জন্য বুদ্ধ আটটি পথ অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলিই ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ নামে পরিচিত। এই আটটি পথ বা মার্গ হল-সৎ-বাক্য, সৎ-কর্ম, সৎ-জীবিকা, সৎ-চেষ্টা, সৎ-চেতনা, সৎ-সংকল্প ও সং-দৃষ্টি। এই আটটি মার্গের প্রথম তিনটির অনুশীলন দৈহিক সংযম এবং পরের তিনটির অনুশীলন মানসিক সংযম দান করে এবং শেষ দুটি মার্গ বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায়।
ঐতিহাসিক ধর্মানন্দ কোশাম্বী অষ্টাঙ্গিক মার্গের সামাজিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে এগুলিকে গৌতমবুদ্ধের ‘সমাজচেতনার প্রকাশ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, সমকালীন সামাজিক অস্থিরতা ও বৈষম্যের প্রেক্ষিতে সামাজিক শান্তি ও সাম্য আনার জন্য গৌতমবুদ্ধ এই সৎপথগুলি অনুসরণের কথা প্রচার করেছিলেন। দূরদর্শী এই সংস্কারক অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনের মাধ্যমে একই সাথে সামাজিক সাম্য ও দুঃখকষ্টের গ্রাস থেকে মানুষকে মুক্তির পথনির্দেশ করেছেন। প্রতিটি মার্গের সাথে ‘সৎ শব্দটি যুক্ত করে তিনি অন্যায় বা নীতি বিবর্জিত আচরণ থেকে মানুষকে সতত নিবৃত্ত রাখতে প্রয়াসী হয়েছেন। যেমন সৎ-বাক্য পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে। সৎ-দৃষ্টির মাধ্যমে লোভ, হিংসা, ঈর্যা ইত্যাদি ক্ষতিকারক ও অনৈতিক আচরণ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখে সামাজিক শান্তি, প্রগতি ও ভালবাসার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। সৎ-উপায়ে এবং সমাজের ক্ষতি না করে জীবনযাপনের পথে মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য তিনি ‘সৎ-জীবিকা’র বিধান দিয়েছেন। তাঁর সৎ সংকল্পের দুটি লক্ষ্য ছিল। একদিকে অপরের ক্ষতি করে নিজের সম্পদ ও শক্তি বৃদ্ধি না করা। এবং অন্যদিকে অন্যকে ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের মাধ্যমে পারস্পরিক সুখ ও শান্তি বৃদ্ধি করা। সার্বিক বিচারে আটটি মার্গই ছিল বাসনা নিবৃত্তিমূলক। কারণ বুদ্ধের সত্যজ্ঞানের কেন্দ্রেই ছিল বাসনার নিবৃত্তি দ্বারা দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি অর্জন করা। তাঁর সৎ চিন্তার লক্ষ্য হল মানুষের অস্থির চিত্তবৃিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং আসক্তি, মোহ, মায়া ইত্যাদি দুঃখের আধারগুলিকে দূরে থাকার জন্য মানসিক শক্তি অর্জন করা ইত্যাদি।
বৌদ্ধদর্শনে ‘শীল’, ‘চিত্ত’ ও ‘প্রজ্ঞা’—এই তিনটি অনুশীলনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ‘শীল’ অর্থে নৈতিক শুদ্ধতাকে বোঝানো হয়েছে। ‘বিনয়-পিটকে’ বলা হয়েছে যে, শীল বা নৈতিক শুদ্ধতা মেনে চললে সত্যিকার ব্রহ্মচর্য অর্জন করা যায়। ‘সুত্ত’ পিটক ও অভিধম্মপিটকে ‘চিত্ত’ বিষয়টির উল্লেখ আছে। ‘চিত্ত’ অনুশীলন দ্বারা গভীর মনসংযোগ ও যথার্থ জ্ঞান অর্জন করা যায়। ধ্যানাভ্যাসের জন্য এই জ্ঞান ও মনসংযোগ প্রয়োজন। ‘প্রজ্ঞা’ হল বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা বা পরম সত্য উপলব্ধির কাজে সাহায্য করে। অষ্টাঙ্গিক মার্গের যথার্থ অনুশীলনের জন্য ‘শীল-চিত্ত-প্রজ্ঞা অনুশীলন আবশ্যিক।
ঈশ্বর আছেন বা নেই—এ বিষয়ে বুদ্ধ কিছুই বলেন নি। তাই অনেকে তাঁকে নাস্তিক বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু এমন ধারণা ঠিক নয়। তিনি আস্তিক্যবাদ প্রচার করেন নি, এটুকুই বলা যায়, সম্ভবত বেদ নিন্দুক হিসেবে বুদ্ধের ওপর নাস্তিক শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করা হয়েছিল। পরে তা ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস ধারণার সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। বুদ্ধের মতে, নির্বাণ লাভ করাই জীবের চরম কাম্য। তিনি মনে করতেন যে, মানুষ নিজ কর্মবলেই নির্বাণ লাভ করতে সক্ষম। বৈদান্তিক যাকে বলে ‘ব্রষ্মজ্ঞান’, বৈষুব মতে যা হল ‘সালোক্যমুক্তি’, যোগীর কাছে যা ‘কৈবল্যমুক্তি’ বুদ্ধ তাকেই বলেছেন নির্বাণ। সমাধি বলতে যেমন মৃত্যু বোঝায় না, তেমনি নির্বাণ অর্থ মৃত্যু নয়। নির্বাণ লাভ করে জীবন পুনঃর্জন্ম ও দুঃখকষ্টের হাত থেকে মুক্তিলাভ করে। তবে নির্বাণলাভের পর প্রাপ্ত নির্বাণের কি গতি হয়, এ প্রশ্নের উত্তর বুদ্ধ দেননি। ড. রাধাকৃয়ন-এর মতে, এ বিষয়ে গৌতমবুদ্ধের নীরবতা থেকে অনুমান করা যায় যে, নির্বাণলাভের পর আত্মার অস্তিত্ব থাকে না। আবার এমনও হতে পারে যে নির্বাণলাভের পর আত্মার অবস্থা অবর্ণনীয় হয় বলেই বুদ্ধদেব এ প্রসঙ্গে নির্বাক ছিলেন। বৌদ্ধদর্শনে নির্বাণের সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অরিয় পরিয়েসন সুত্ত’-তে বলা হয়েছে যে, নির্বাণ হল জরামুক্ত (অজর), ব্যাধিমুক্ত (অব্যাধি), মৃত্যুহীন (অমৃত), দুঃখ-শোক থেকে মুক্ত (অশোক), অপবিত্রতা থেকে মুক্ত (অসংশ্লিষ্ট), অতুলনীয় (অনুত্তর) এবং এটিই মানুষের চরম লক্ষ্য (যোগক্ষেম)। অর্থাৎ নির্বাণ হল পার্থিব আসক্তি, শোক, দুঃখ থেকে মুক্তি। জন্মচক্রের বন্ধন থেকে আত্মার মুক্তি কামনায় জীবের দীর্ঘ প্রয়াসের চূড়ান্ত পুরস্কার।
বৌদ্ধধর্ম ছিল মূলত সংঘভিত্তিক জীবনচর্চা। সংঘের নিয়মাবলী তৈরির ক্ষেত্রে বুদ্ধ সমকালীন কৌম গণতন্ত্রগুলির নিয়মাবলী গ্রহণ করেছিলেন। বিনয়পিটক থেকে জানা যায় যে, গৌতমবুদ্ধ তাঁর অনুগামী ভিক্ষু ও সন্ন্যাসী (শ্রমণ)-দের নিরাপত্তা ও নিশ্চিত্তে ধর্মপালন ক্রিয়া অনুশীলনের জন্য সংঘ গঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন। বুদ্ধের অনুরাগী নৃপতি, শ্রেষ্ঠী বা বণিকদের অর্থানুকুল্যে এই সকল সংঘ স্থাপিত হয়েছিল। সংঘজীবনের রীতি-নীতিও তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। বিলাস-বৈভব বর্জিত জীবনযাপন ছিল আবশ্যিক। বৌদ্ধসংঘে প্রবেশের প্রাথমিক অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘প্রবজ্যা। আট বছর বয়স না হলে প্রবজ্যা নেওয়া যায় না। একটি ছোট্ট, অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘প্রবজ্যা’ নিতে হয়। প্রবজ্যার পর নবাগত ব্যক্তি শ্রমণ উপাধি পান। এই সময়ে বুদ্ধনির্দেশিত পথে শিক্ষাগ্রহণ, ধ্যানাভ্যাস ও আত্মপ্রস্তুতির অনুশীলন করতে হয়। অন্তত বারবছর গুরুর (ভিক্ষু) নিকটে থেকে শ্রমণকে এই সকল বিষয় চর্চা করতে হয়। অতঃপর কুড়ি বছর বয়সে একজন সফল শ্রমণ পুনদীক্ষার মাধ্যমে ‘ভিক্ষু’ জীবনে প্রকাশ করতে পারেন (উপসম্পদা)। ভিক্ষুদের দশটি ‘শীল’, বা আচরণ পালন করতে হত। এগুলি হল—হত্যা, চুরি, ব্যভিচার, অসত্য ভাষণ, বৈকালিক আহার, নৃত্য-গীত উপভোগ, মাল্যচন্দন ও সুগন্ধি ব্যবহার, সুখশয্যা গ্রহণ, মহার্ঘ অলংকার পরিধান ইত্যাদি পরিহার করা। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি শীল গৃহী বৌদ্ধদের মেনে চলা বাধ্যতামূলক। বৌদ্ধ শ্রমণদের নিত্যকর্মের মধ্যে অন্যতম হল কায়িক শ্রমদ্বারা সংঘ-গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ভিক্ষা গ্রহণ, অধ্যয়ন, ধ্যানাভ্যাস ইত্যাদি। ভিক্ষুগণ শিষ্যদের শিক্ষাদান, ধর্মদর্শন ব্যাখ্যা, পুস্তক প্রণয়ন এবং দেশে-বিদেশে পরিভ্রমণ করে বুদ্ধের বাণী প্রচার ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকেন। অনুগামী ভক্তদের দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটানো ভিক্ষু বা গুরুদের অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। সংঘজীবনের নিয়মাবলী লঙ্ঘন করলে সংঘবাসীকে শাস্তিদানের ব্যবস্থা আছে। একে বলা হয় প্রতিমোক্ষ। মাতা গৌতমীর অনুরোধক্রমে বুদ্ধ-নারীদেরও সংঘজীবন গ্রহণের অনুমোদন দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মে সংঘজীবনের গুরুত্ব এতটাই যে, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণেচ্ছু ব্যক্তিকে বুদ্ধ ও ধর্মের পাশাপাশি সংঘকে অনুসরণেরও শপথ নিতে হত।
‘বিনয়পিটকে’ উল্লেখিত সংঘজীবনের নীতি-নিদের্শিকা বিশ্লেষণ করলে এর গণতান্ত্রিক চরিত্র অনুধাবন করা যায়। বুদ্ধদেব সংঘ পরিচালনার জন্য কোন প্রতিনিধি মনোনীত করেননি। তিনি বলেছিলেন, কোন একটি নির্দিষ্ট বিহারের (সংঘ) অধিবাসীরাই তাদের পরিচালক নির্বাচন করবেন। গোপন ভোটদানের মাধ্যমে সন্ন্যাসীরা কার্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন উপসমিতি গঠনের অধিকারী। এই উপসমিতিগুলির ন্যূনতম সদস্যসংখ্যাও তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, আবার বিশেষ ক্ষেত্রে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিধান দিয়েছেন। প্রতিমাসে অন্তত দু’বার সভায় সমবেত হয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ সবাইকে দেওয়া হত। ড. রোমিলা থাপারের মতে, বৌদ্ধবিহারগুলির পরিচালন ব্যবস্থার সাথে গণরাজ্যের গণসভার কাজের মিল লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক বিপ্লবের দিক থেকেও সংঘগুলির গুরুত্ব স্মরণীয়। বৌদ্ধমঠ প্রতিষ্ঠার ফলে শিক্ষার প্রচার বৃদ্ধি পায়। সমাজের সবশ্রেণীর মধ্যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী গ্রহণের ফলে সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষার প্রসার ঘটে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যধর্মে নারীদের নানা বিধি নিষেধের মধ্যে জীবনধারণ করতে হত। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম ভিক্ষুণীগ্রহণ ও নারীদের সংঘ জীবনযাপনের সুযোগ আসায় স্ত্রী-স্বাধীনতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বুদ্ধ একদিকে যেমন ভোগবিলাসের বিরোধি ছিলেন, তেমনি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনেরও বিরোধী ছিলেন। ভোগবাদ মানুষকে অসৎ ও অলস করে। আবার কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন দেহ-মনের পীড়ার কারণ হয়। তাই তিনি ‘মধ্যপন্থা’ (মঝঝিম পন্থা) অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। এই কারণে বৌদ্ধ ধর্মাচরণ সাধারণ গৃহী মানুষের পক্ষেও সহজসাধ্য হয়েছে। সম্ভবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনকে প্রদত্ত উপদেশাবলী দ্বারা বুদ্ধ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘হে অর্জুন, অতি ভোজনকারী, উপবাসশীল, অধিক জাগরণশীল বা অতিশয় নিদ্রালু ব্যক্তি যোগী হতে পারে না’।
বৌদ্ধধর্মের রুপান্তর :
গৌতমবুদ্ধের দেহাবসানের পর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে মতভেদ দানা বাঁধতে থাকে। আদর্শগত মতভেদ দূর করা এবং সর্বজনীন আচরণবিধি তৈরি করার লক্ষ্যে চারটি বৌদ্ধ সংগীতি (মহাসম্মেলন) আহ্বান করা হয়েছিল। বুদ্ধ-পরবর্তী বৌদ্ধধর্মের রূপান্তরের ক্ষেত্রে এই মহাসংগীতিগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্য অনুসারে বুদ্ধের পরিনির্বানের অল্পকাল পরে মগধের রাজা অজাতশত্রুর উদ্যোগে রাজগৃহে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়েছিল (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ)। বুদ্ধের বিশিষ্ট শিষ্য মহাকাশ্যপ বুদ্ধের বাণীসমূহ সংকলন করার উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। মহাকাশ্যপ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আনন্দ ও উপালি এখানে যথাক্রমে ‘ধর্ম’ ও ‘বিনয়’ বিষয়ে বুদ্ধের বাণীগুলি আবৃত্তি করেন। এইভাবে ‘সুওপিটক’ ও ‘বিনয়পিটক’ সংকলন শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ এই ঘটনা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলেও প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতির ঐতিহাসিকতা বিষয়ে সংশয়ের কারণ নেই।
প্রথম বৌদ্ধ সংগীতির পরবর্তী একশতক বৌদ্ধ সংঘে কোনও বিরোধ প্রকট হয়নি। ভিক্ষুদের মধ্যে ছোটখাটো মতভেদ থাকলেও, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছিল। বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পর মগধের রাজা কালাশোকের আমলে বৈশালীতে ‘দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতি’ আহ্বান করা হয়েছিল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৬ অব্দ)। এই অধিবেশনে পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী (ভিক্ষু) দের মধ্যে মতভেদ প্রকট হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলীয় ভিক্ষুরা বাস করতেন মূলত বৈশালী ও পাটলিপুত্রে। অন্যদিকে পশ্চিমাঞলীয়দের বাসস্থান ছিল কৌশাম্বী ও অবত্তী অঞ্চলে। এঁদের মতভেদের কারণ ছিল মূলত বিনয় বা ভিক্ষুদের বিহার জীবনে পালনীয় দশটি নিয়ম সম্পর্কে। পূর্বাঞ্চলীয় ভিক্ষুরা দশটি নিয়ম মানতেন, যা গোঁড়ামি মুক্ত। যেমন, লবণ সঞ্চয় করে রাখা, সূর্যাস্তের পর আহার গ্রহণ করা, মূল্যবান ধাতু (সোনা, রূপা) গ্রহণ করা ইত্যাদি। পশ্চিমাঞ্চলীয়রা ‘স্থবিরবাদী’ নামে পরিচিত হন। এইভাবে বৌদ্ধসংঘে ভাঙনের সূচনা হয়েছিল যা ক্রমে আরো ছোট ছোট অংশে ভেঙে পড়েছিল। স্থবিরবাদীরা পালি ভাষায় ‘থেরবাদী’ নামে অভিহিত হতেন। পরবর্তী সময়ে থেরবাদীরা এগারোটি সম্প্রদায়ে এবং মহাসংঘিকরা সাতটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছিলেন। এরা ছিলেন হীনযান পন্থী। এই আঠারোটি সম্প্রদায়ই বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্বকে মান্যতা দিতেন। এই হীনযানীদের প্রাধান্য ছিল ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার), শ্রীলঙ্কা (সিংহল) ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে।
থেরবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা ‘সর্বাস্তিবাদ’। তিব্বতী ঐতিহ্য মতে এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাহুল ভদ্র। সর্বাস্তিবাদীদের মূলকথা ‘সর্বম অস্তি’, শুধু বর্তমান নয়, অতীত ও ভবিষ্যতেরও অস্তিত্ব নিশ্চিত বলেই এঁরা বিশ্বাস করতেন। সম্রাট কনিষ্ক এই মতের সমর্থক ছিলেন। বৌদ্ধ সংঘের দ্বিতীয় অধিবেশনেই ‘মহাসংঘিক’ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল। ঐতিহ্য অনুসারে এর প্রতিষ্ঠাতা মহাকাশ্যপ। তত্ত্বগতভাবে থেরবাদীদের থেকে মহাসংঘিকদের তিনটি বিষয়ে মত পার্থক্য ছিল। যেমন- (১) তাঁরা বুদ্ধকে দেবতার আসনে বসান। (২) ‘বুদ্ধ’ লোকত্তর একটি চরিত্র। অর্থাৎ বুদ্ধরূপে যিনি পরিচিত তিনি প্রকৃত বা আদি বুদ্ধ নন এবং (৩) তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, ‘অর্হৎ’ (যোগ্য) হওয়া জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ অর্হৎ অর্জন করতে পারলে জীবনচক্র থেকে মুক্তি আসে এবং ‘নির্বাণ’ লাভ করা যায়। ‘মহাসংঘিকদের শাখাগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পূর্বশৈল, অপর শৈল, উত্তর শৈল, চৈত্যক ইত্যাদি। নাগার্জুর্নিকোণ্ড ও অমরাবতী লেখ থেকে এদের কথা জানা যায়। বুদ্ধত্ব এবং অর্হৎদের সম্পর্কে এই শাখাগুলি মহাসংঘিকদের অনুরূপ বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন। তবে দুটি দর্শনতত্ত্বে এঁরা মহাসংঘিকদের তুলনায় অগ্রণী ছিলেন। এঁরা বিশ্বাস করতেন যে, বুদ্ধের মতই বোধিসত্বদেরও লোকোত্তর মনে করতেন। এছাড়া এঁদের কাছে মনের পবিত্রতা হল একটি সহজাত বৃত্তি। কেবল অপবিত্র বস্তুর সংস্পর্শে এলে মন অপবিত্র হতে পারে।
সম্রাট অশোক ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের কাজেও সক্রিয় পদক্ষেপ নেন। বিভিন্ন শিলালেখর মাধ্যমে বৌদ্ধ দর্শন প্রচার এবং দেশে-বিদেশে দূত প্রেরণ করে বৌদ্ধদর্শনকে জনপ্রিয় করার ব্যবস্থা করেন। এই সময় বৌদ্ধ ধর্মে নানা সম্প্রদায়ের উদ্ভব, প্রতি সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র ‘পিটক’ (ধর্মগ্রন্থ), বুদ্ধের উপদেশ ও দর্শনতত্ত্ব সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী দাবী ইত্যাদি অশোককে বিব্রত করেছিল। এমতাবস্থায় বুদ্ধের অনুগামী হিসেবে অশোক তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি আহ্বানের উদ্যোগ নেন। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৫১ অব্দে পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মোঙ্গলিপুত্ত তিস্স এখানে সভাপতিত্ব করেন। এটি ছিল কার্যত স্থবির বা থের বাদীদের সম্মেলন। কারণ এখানে অন্যান্য বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে আমন্ত্রণ করা হয়নি। এই সম্মেলনে নয় মাস ধরে থেরবাদী ত্রিপিটক সংকলন করা হয়। অ-থেরবাদী মতবাদকে ভ্রান্ত বলে সমালোচনা করা হয়। মোগলিপুত্ত থেরবাদীকেই যথার্থ বৌদ্ধ মতবাদ বলে ব্যাখ্যা করেন। তাই এটিকে সাধারণ বৌদ্ধ সম্মেলন না বলে একটি বিশেষ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সমাবেশ বলা সংগত। তাছাড়া এই সম্মেলনের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কেও সংশয় আছে। কারণ অশোকের কোনো অনুশাসন বা চৈনিক লেখকদের রচনায় এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
মৌর্য শাসনের অবসানের পরবর্তী কিছু সময় বৌদ্ধধর্ম রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত ছিল। শুঙ্গ ও কাল্ববংশ ব্রাহ্মণ্যবাদী ছিলেন। কিন্তু বিরতির পর কুষাণ শাসকদের আমলে পুনরায় বৌদ্ধধর্ম রাজ সমর্থন পেতে থাকে। সম্রাট কনিষ্ক বৌদ্ধধর্মের ভেদাভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে চতুর্থ বৌদ্ধ-মহাসংগীতে আহ্বান করেছিলেন বলে মনে করা হয়। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে কাশ্মীরের কুণ্ডলবনবিহারের (মতান্তরে জলন্ধরের কুবনবিহার অঞ্চলে) এই সম্মেলন বসে ছিল। এখানে কণিষ্ক সকল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভিক্ষুদের আহ্বান জানান। (কণিষ্কের ধর্মগুরু পার্শ্ব এখানে সভাপতিত্ব করেন।) তিব্বতী বিবরণ মতে পাঁচশত অহৎ সহ পার্শ্ব এবং পাচশত বোধিসত্ত্ব সহ বসুমিত্র চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এখানে থেরবাদী ও মহাসংঘিক আঠারো সম্প্রদায়কেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ত্রিপিটক (বিনয়, সূত্র ও অভিধর্ম)-এর অনুলিখিত অংশগুলি সংকলন করা হয়।
আদি বৌদ্ধধর্মতত্ত্ব হীনযানবাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। হীনযান থেকে মহাযানবাদের উদ্ভব একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরিণতি। থেরবাদ, সর্বাস্তিবাদ, মহাসংঘিক ইত্যাদি শাখা-প্রশাখার উৎপত্তি ধীরে ধীরে মহাযানবাদকেও একটা প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে সক্ষম হয়। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে মহাযানবাদতত্ত্ব স্পষ্ট অবয়ব লাভ করে। লেখমালার সাক্ষ্যে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে মহাযানবাদের উদ্ভবের কাল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। বিশিষ্ট মহাযানবাদী দার্শনিক নাগার্জুন খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়। তাছাড়া মহাযানবাদী দর্শনতত্ত্ব যেমন জাগতিক বস্তুর অনস্তিত্ব (ধর্মশূন্যতা), আত্মার অনস্তিত্ব (পুদ্গল শূন্যতা), অসংখ্য বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের ধারণা ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থ ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এই বিচারে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষ ও খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের গোড়ায় মহাযানবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল ধরে নেওয়া যেতে পারে।
হীনযান মতবাদের মধ্যেই মহাযানবাদের বীজ নিহিত ছিল। মহাসংঘিকদের একটি শাখা বোধিসত্ত্বের ধারণা পুষ্ট করেছিল। এরা মনে করেন যে, শীল বা সদগুণ অনুশীলন দ্বারা যে কোনো ব্যক্তি, গৃহস্থ্য বা সন্ন্যাসী বোধিসত্ত্ব গুণ অর্জন করতে সক্ষম। মহাযানবাদের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ‘পারমিতা’র উৎস এখান থেকে খোঁজা যেতে পারে। সম্রাট অশোক তাঁর অনুশাসনগুলিতে যে ধর্ম (ধর্ম্ম) প্রচার করেন সেখানে সদাচরণ বা নৈতিকতার (শীল) ওপর সর্বাধিক জোর দিয়েছেন। নৈতিকতার অনুশীলন সকল মানুষের পক্ষেই সম্ভব এবং এর দ্বারা সবাই বোধিসত্ত্বের গুণ অর্জন করতে পারেন। বলা যায় বৌদ্ধধর্মকে জনমুখী করার জন্য মহাযানবাদের উদ্ভব অনিবার্য হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধ যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন তা ছিল মূলত সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীদের পক্ষে অনুসরণের উপযোগী। বৌদ্ধধর্ম অনুসরণের জন্য জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে সংঘের আশ্রয় গ্রহণ করা ছিল বাধ্যতামূলক। এ কারণে অনেকেই সংসার বন্ধন ছিন্ন করেছিলেন। সম্ভবত এ জন্য গৌতমবুদ্ধের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি অসংখ্য পত্নী ও মাতাকে যথাক্রমে স্বামী ও পুত্রহারা করেছেন। গৃহীদের পক্ষে কঠোর অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করা ছিল সাধ্যের অতীত। এমতাবস্থায় তুলনায় সহজসাধ্য ‘পারমিতার’ আদর্শ পালনের কথা বলে মহাযানীরা গৃহীদের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ ও অনুসরণের পথ খুলে দেন। পারমিতার সংখ্যা প্রথম ছিল ছয়টি, পরে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় দশটি। এগুলি হল, দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য, ধ্যান, প্রজ্ঞা, উপায়কৌশল্য, প্রণিধান (সংকল্প), বল ও জ্ঞান। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, সমকালে প্রচারিত বৈষুব, শৈব প্রভৃতি ধর্মে ভক্তি ও পূজার বিশেষ স্থান ছিল। সাধারণ মানুষের সেই অভ্যাস ও আবেগকে স্পর্শ করার জন্যও মহাযানবাদের প্রচার গুরুত্ব পায়। এখানে বুদ্ধকে দেবতার আসনে বসিয়ে এবং বোধিসত্ত্বদের ‘অবতার’-এর পর্যায়ভুক্ত করে বৌদ্ধধর্মকে সাধারণ মানুষের ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে খ্রিস্টধর্মে মতের সাথে প্যাগান ধর্মমতগুলির আপোষের দৃষ্টান্ত হিসেবে লক্ষণীয়। বলা যায়, হীনযান মতবাদের মধ্যেই মহাযান মতবাদের বীজ নিহিত ছিল। কালক্রমে উভয় মতবাদের মধ্যে ব্যবধানগুলি স্পষ্ট হতে থাকে।
মহাযানবাদের মতে, বুদ্ধ সর্বোচ্চ দেবতা, যিনি অনন্ত, যাঁর লয় নেই, তিনি পরম সত্য এবং সকলের বর্ণনার অতীত। তাঁরা বুদ্ধের ত্রিকায়তত্ত্ব প্রচার করেন। এগুলি হল-ধর্ম-কায়, সম্ভোগ-কায় এবং রূপ-কায়। ধর্ম-কায় হল বুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ যেখানে তিনি অনন্ত, নিরাকার চিরন্তন। সম্ভোগ-কায়ের ক্ষেত্রে বুদ্ধ দেবতার বৈশিষ্ট্যসহ মহাপুরুষের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেন। কেবল আধ্যাত্মজ্ঞান সম্পন্ন উচ্চমার্গের ভক্তরা জন্ম জন্ম সাধনা দ্বারা এই রূপ প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন। তবে সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনায় বুদ্ধ মাঝে মাঝে মানব রূপ ধারণ করে মানুষের গৃহে আবির্ভূত হন। মহাযানীদের মতে, গৌতমবুদ্ধ আসলে দেবতা বুদ্ধের বস্তুগত দেহ ধারণ। জীব ও জগতের মঙ্গল করার জন্য তাঁর এই রূপ-কায় গ্রহণ। কিন্তু হীনযানে স্বর্গ ও ঈশ্বরের ধারণা বাতিল করা হয়েছে।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল বোধিসত্ত্বের ধারণা। ‘পারমিতা’ অনুশীলন দ্বারা সকল বুদ্ধ ভক্তই বোধিচিত্তের যথার্থ বিকাশ ঘটিয়ে বোধিসত্ত্ব হতে সক্ষম। বোধিসত্ত্ব ধারণার সাথে ‘অবতার’ তত্ত্বের সাদৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু হীনযান ‘পারমিতার’ গুরুত্ব স্বীকার করলেও বোধিসত্ত্বের ধারণা বর্জন করেছে। হীনযানে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য হল বুদ্ধ এক এবং অতুলনীয়। অন্য কেউ বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারে না। মহাযানবাদের এই উদারতা অন্য ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। হীনযানের মূল আদর্শ হল অহত্যান, যেখানে ব্যক্তিগত প্রয়াসে ব্যক্তির মুক্তি অর্জনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মহাযানবাদে বুদ্ধযান গুরুত্ব পায়। এখানে মনে করা হয় যে, কেবল ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠা নয়, বিশুদ্ধ বুদ্ধভক্তি দ্বারা মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
বৌদ্ধসাহিত্য:
বৌদ্ধদের ধর্মীয় সাহিত্য মূলত পালি ভাষায় রচিত। এছাড়া সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষাতেও কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে। এগুলি প্রধানত তিব্বতী ও চিনা অনুবাদের আকারে পাওয়া গেছে। বৌদ্ধ শাস্ত্র গ্রন্থের সামগ্রিক নাম ‘ত্রিপিটক’ যা তিনটি পিটক-এর সমাহার। এই তিনটি পিটক হল বিনয় পিটক, সুত্ত পিটক এবং অভিধর্ম (অভিধর্ম্ম) পিটক। বিনয় পিটকের বিষয়বস্তু হল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালনীয় নিয়মবিধি, কর্তব্যকর্ম, আচার-আচরণ ইত্যাদি। সুত্ত পিটকে সংকলিত হয়েছে ধর্মীয় তত্ত্ব। জগত ও জীবন সম্পর্কে উদ্ভাবিত মহাসত্য। অভিধর্ম পিটকের বিষয় বস্তু দার্শনিক তত্ত্বসমূহ।
বিনয় পিটকের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলি হল—(১) সুত্ত বিভগ, (২) খণ্ডক এবং (৩) পরিবার। সুত্ত বিভঙ্গ দু’ভাগে বিভক্ত—মহাবিভঙ্গ এবং ভিক্ষুণী বিভঙ্গ। খন্দকের দু’টি ভাগ—মহাবগ্ন ও চুন্নুবগ্ন। এর মধ্যে আছে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের জীবনযাপন প্রণালী, যেমন—তাদের আহার-বিহার, পোষাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়ক নিয়মাবলী। ‘পরিবার’ অংশে পূর্বলিখিত ভাগগুলির সারসংক্ষেপ ও সুচীপত্র স্থান পেয়েছে।
মুক্ত পিটক পাঁচ ভাগে বিভক্ত—(১) দীর্ঘ নিকায় (২) মঝঝিম নিকায় (৩) সংযুক্ত নিকায়, (৪) অত্তর নিকায় এবং (৫) ক্ষুদ্দক নিকায়। ‘দীঘ নিকায়ে’ দীর্ঘকায় ৩৪টি সুত্ত সংকলিত আছে। প্রতিটির বিষয়বস্তু স্বতন্ত্র। বৌদ্ধ দর্শনের গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব, জগৎ সংসারের ও মহাকাশের সৃষ্টি রহস্য, বিশ্বের ক্রম বিবর্তন, নিধান, সন্ন্যাস, আত্মার অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব, মনসংযোগ ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা আছে। মহা পরিনির্বাণ সূত্তে গৌতম বুদ্ধের শেষ জীবনের বিবরণ আছে। মঝঝিম নিকায়ে মাঝারি ধরনের আকারে ১৫২টি মুক্ত পরিবেশিত হয়েছে। সংযুক্ত নিকায় অংশে পরস্পর সম্পর্কিত সুত্তগুলির আলোচনা আছে। এদের সংখ্যা ৫৬টি। ‘অঙ্গুত্তর’ ও ‘খুদ্দক নিকায়ে পূর্ববর্তী তিনটি নিকায়ের বিষয়গুলি পুনরালোচিত হয়েছে। তবে ধর্মতত্ত্ব বিশ্লেষণ পূর্ববর্তী নিকায়গুলির মাঝে হুবহু এক নয়।
অভিধর্ম পিটক-এর অন্তর্গত গ্রন্থের সংখ্যা সাতটি—(১) ধম্মসঙ্গনি; (২) বিভস, (৩) ধাতুকথা; (৪) পুগ্গল পঞত্তি; (৫) কথাবন্ধু: (৬) যমক ও (৭) পট্ঠান। এই পিটকের আলোচনায় গভীর দর্শন তত্ত্বের জটিল উপস্থাপনা আছে। পালি-ত্রিপিটক বলতে এই গ্রন্থগুলিকে বোঝায়। এদের রচনাকাল অনুমান সাপেক্ষ বিষয়। ড. ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, বিনয় পিটকের বেশীরভাগ অংশ এবং সুত্ত পিটকের প্রথম চারটি নিকায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দের আগেই রচিত হয়েছিল। অন্যান্যগুলি সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে লেখা হয়েছে।
ত্রিপিটক ছাড়াও পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধধর্মেগ্রন্থের অন্যতম কয়েকটি হল ‘মিলিন্দ-পঞহো’, মহাচ্ছ্বান-এর ‘নেত্তিপকরণ, পেতকোপদেশ, বুদ্ধঘোষ ধর্মপাল রচিত ত্রিপিটকের অন্তর্গত গ্রন্থাবলীর টীকাসমূহ প্রভৃতি। ‘মিলিন্দ পঞহো’ (মিলিন্দ পন্হো) এর অর্থ ‘মিলিন্দের প্রশ্ন”। এই মিলিন্দ সম্ভবত ছিলেন ইন্দোগ্রীক রাজা প্রথম মিনান্দার। এর রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষে বা খ্রিষ্টীয় শতকে গোড়ায়। গ্রীক রাজা মিনান্দার বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এই ধর্মমত সম্পর্কে বৌদ্ধ পণ্ডিত নাগসেনকে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। নাগসেন তাদের উত্তর দিয়েছেন। মিলিন্দ পঞহো গ্রন্থটি মিনান্দার ও নাগসেনের প্রশ্নোত্তরের আকারে রচিত হয়েছে। লিটভিনস্কি (B. A. Litvinoski)-এর মতে, মিলিন্দ পेহো গ্রন্থ প্রমাণ করে যে মিনান্দার বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সম্ভবত ভিক্ষু নাগসেন ছিলেন তাঁর দীক্ষাগুরু। প্রথম মিনান্দরের মুদ্রায় ‘চক্রচিহ্ন’ পাওয়া যায়। এই সকল মুদ্রা থেকে অনুমিত হয় যে মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল। খুব সম্ভবত হিন্দুকুশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ‘চক্ৰচিহ্ন’ সমন্বিত মিনান্দারের মুদ্রাগুলি প্রচলিত ছিল। মিলিন্দ-পঞ্চহো গ্রন্থের বিবরণ মতে, বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী রাজা মিলিন্দের রাজধানী ছিল সাগল। বর্তমানে এই স্থানকে পাকিস্তানের অন্তর্গত সিয়ালকোট বলে শনাক্ত করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক রিজ ডেভিস কিছুটা ভিন্নসুরে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। ‘The question of King Milind (1925) গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে, মিলিন্দ পঞহো গ্রন্থের বিবরণ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি রাজা মিনান্দারের আকর্ষণ বা আন্তরিকতার আভাস পাওয়া সম্ভব। তবে তিনি মনে করেন যে, এই গ্রন্থের ভিত্তিতে রাজা মিলিন্দকে গ্রীকরাজা প্রথম মিনান্দার বা দ্বিতীয় মিনান্দারের সাথে সনাক্ত করা গেলেও, এই গ্রন্থের রচনাকালকে কোনো ভাবেই খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে নির্দিষ্ট করা যায় না। রচনাকাল সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও মিলিন্দ পঞহো গ্রন্থটি বৌদ্ধধর্মের সর্বজনীন আকর্ষণ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট আভাস দেয়। মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা সম্পর্কেও মিলিন্দ পঞহো গ্রন্থটি এক প্রামাণ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত।
সংস্কৃত ভাষায় রচিত বা মিশ্র সংস্কৃত ভাষায় লেখা ধর্মগ্রন্থগুলির অস্তিত্ব প্রায় নেই। তবে চিনা ও তিব্বতী ভাষায় সেগুলির কিছু অনুবাদ গ্রন্থ পাওয়া গেছে। মূলত মহাযান বাদীদের ধর্মগ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল। এছাড়া হীনযানীদের সর্বাস্তিবাদী শাখার কিছু কিছু গ্রন্থ সংস্কৃতে লেখা। বিশুদ্ধ বা মিশ্র সংস্কৃতে রচিত গ্রন্থগুলির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল—মহাবস্তু, বুদ্ধচরিত, সৌন্দরানন্দ, জাতকমালা, অবদান ইত্যাদি। সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাযান সূত্র সমূহের অন্যতম হল ‘বৈপুল্য সূত্র’। এর অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল—’অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞা পারমিতা’, ‘ললিত বিস্তর’, ‘লঙ্কাবতার’, ‘সমাধিরাজ’, ‘অন্তব্যুহ’, ‘দশ ভূমীশ্বর’ ইত্যাদি। মহাযান সাহিত্যে ‘অবদান’ গ্রন্থগুলি। গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘দিব্যবদান’, ‘অবদান শতক’, ‘অবদান কল্পলতা’ ইত্যাদি।
Leave a comment