রাদারফোর্ড তার পরমাণু মডেলে যে প্রস্তাবনাগুলো দেন, তার কিছু ত্রুটি বিদ্যমান আছে। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের ত্রুটিগুলো দূর করার জন্য 1913 খ্রিস্টাব্দে নীলস বোর তার বিখ্যাত হাইড্রোজেন পরমাণু মডেল প্রতিষ্ঠিত করেন। বোরের পরমাণু মডেলটি ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ও আইনস্টাইনের বিকিরণ সম্পর্কিত কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।

বোর পরমাণু মডেলের স্বীকার্য গুলি নিম্নরূপঃ

১. স্থির কক্ষপথের ধারণাঃ পরমাণুতে নিউক্লিয়াসের চারপাশে কতগুলো অনুমোদিত স্থির কক্ষপথ রয়েছে। ইলেকট্রনসমূহ এই স্থির কক্ষপথেই নিউক্লিয়াসের চারদিকে পরিভ্রমণ করে। প্রতিটি কক্ষপথ গুলো নির্দিষ্ট শক্তির হয়ে থাকে। ইলেকট্রন যতক্ষণ একটি স্থির কক্ষপথে অবস্থান করে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করবে না। এ কক্ষপথ গুলোকে শক্তিস্তর বা স্থির কক্ষপথ বা অরবিট বলে। শক্তিস্তরগুলোকে ‘n’ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। n= 1 হলে প্রথম শক্তিস্তর, n = 2 হলে দ্বিতীয় শক্তিস্তর, n = 3 হলে তৃতীয় শক্তিস্তর ইত্যাদি হবে।

২. কৌণিক ভরবেগের ধারণাঃ প্রতিটি নির্দিষ্ট শক্তির স্থির কক্ষপথে আবর্তনরত ইলেকট্রন গুলির কৌণিক ভরবেগ h / 2π এর অখন্ড গুণিতক। অর্থাৎ এখানে n = 1, 2, 3……  ইত্যাদি পূর্ণ সংখ্যা হবে, কিন্তু কোন ভগ্নাংশ হবে না।                        n = প্রধান শক্তিস্তর, h = প্লাংক ধ্রুবক, এর মান 6.626×10-³⁴ Js , m = ইলেকট্রনের ভর, v = ইলেকট্রনের রৈখিক বেগ, r = বৃত্তাকার কক্ষপথের ব্যাসার্ধ।

৩. বর্ণালির ধারণাঃ পরমাণুতে একটি ইলেকট্রন এক শক্তিস্তর হতে অন্য শক্তিস্তরে যদি স্থানান্তরিত হয় তবে শক্তির শোষণ বা বিকিরণ হয়। এখন পরমাণুকে যদি আমরা বাহির থেকে শক্তি সরবরাহ করি, তবে নিম্ন শক্তিস্তরের ইলেকট্রনগুলি শক্তি শোষণ করে উচ্চ শক্তিস্তরে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ শক্তির শোষণ ঘটে। আবার, পরমাণুতে শক্তির সরবরাহ বন্ধ করলে ইলেকট্রন যে শক্তি শোষণ করে উচ্চ শক্তিস্তরে স্থানান্তরিত হয়েছিল, ঠিক ঐ একই পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে নিম্ন শক্তিস্তরে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শক্তির বিকিরণ ঘটে এবং বর্ণালীর সৃষ্টি হয়। এই বিকিরিত বর্ণালীর শক্তি E = hv  যা তড়িৎ চুম্বকীয় বর্ণালী হিসাবে নির্গত হয়।



বোর পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতাঃ

১. বোরের পরমাণু মডেল এক ইলেকট্রন বিশিষ্ট হাইড্রোজেন (H) বা আয়নসমূহ ( He+ ,  Li²+,  Be³+ ইত্যাদি ) ক্ষেত্রে বর্ণালীর ব্যাখ্যা করা গেলেও একাধিক ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমানুর বর্ণালীর ব্যাখ্যা করতে পারে না।

 ২. ভারী পরমাণুর ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুর্ণয়মান ইলেকট্রনগুলোর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বোরের পরমাণু মডেলে এই কক্ষপথ গুলোকে বৃত্তাকার ধরা হয়েছে।

৩. উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে ইলেকট্রন ধাপান্তরের সময় বোর পরমাণু মডেল অনুসারে বর্ণালীতে একটি রেখা  সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বর্ণালী মাপক যন্ত্রের সাহায্যে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটি বর্ণালী রেখার পরিবর্তে একাধিক সূক্ষ্ম বর্ণালী রেখা পাওয়া যায়। বোর মডেল এই সূক্ষ্ম বর্ণালী রেখার উৎপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি। 

৪. পরমাণুতে চুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে বর্ণালী রেখাগুলো একাধিক সূক্ষ্ম রেখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে একে জীম্যান প্রভাব বলে। আবার, পরমাণুতে তড়িৎক্ষেত্রের প্রভাবে বর্ণালী রেখাগুলো একাধিক সূক্ষ্ম রেখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে একে স্টার্ক প্রভাব বলে। এ মডেল জীম্যান প্রভাব ও স্টার্ক প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারে না।

৫. বোরের পরমাণু মডেল হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির পরিপন্থী। হাইজেনবার্গের নীতি অনুসারে পরমাণুতে একটি ইলেকট্রনের অবস্থান ও ভরবেগ একই সঙ্গে নির্ণয় করা যায় না। এখানে ইলেকট্রনের কণা ও তরঙ্গ ধর্ম উভয় বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বোর ইলেকট্রনকে শুধু কণা রূপে গণ্য করায়, তার মতে একই সময়ে ইলেকট্রনের অবস্থান ও ভরবেগ নির্ণয় করা সম্ভব।

৬. পরমাণুর প্রকৃত কাঠামো ত্রিমাত্রিক। কিন্তু বোরের মতবাদ অনুসারে পরমাণুর কাঠামো হলো দ্বিমাত্রিক।

৭. বোর পরমাণু মডেল থেকে বর্ণালী রেখার তীব্রতা ব্যাখ্যা করা যায় না।

৮. বোর মডেলে ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ  mvr= nh / 2π এই মানের সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি।

বোর তত্ত্বের সাফল্যঃ

১. বোর তত্ত্ব অনুসারে ইলেকট্রন যখন কোন একটা নির্দিষ্ট স্থির শক্তিস্তরে অবস্থান করে তখন ইলেকট্রনটি কোন শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে না। যার জন্য ইলেকট্রনটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। অর্থাৎ এ তত্ত্ব অনুসারে পরমাণুর স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করা যায়।

২. বোর তত্ত্বের সাহায্যে পরমাণুতে বর্ণালীর ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।

৩. বোর পরমাণু মডেলের সাহায্যে পরমাণুতে বিভিন্ন স্থির কক্ষপথের ব্যাসার্ধ ও কক্ষপথের শক্তি নির্ণয় করা যায়।

৪. বোর পরমাণু মডেল থেকে প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যার ধারণা পাওয়া যায়।

৫. বোর তত্ত্ব হতে ইলেকট্রন একটি শক্তিস্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে স্থানান্তরিত হলে কি পরিমান শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করবে তা গণনা করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ বিভিন্ন শক্তিস্তরে আবর্তনশীল ইলেকট্রনের শক্তির পরিমাণ গণনা করা সম্ভব।

৬. বোর তত্ত্ব থেকে নির্ণীত রিডবার্গ ধ্রুবকের মান 109679 cm-¹ এবং পরীক্ষালব্ধভাবে নির্ণীত রিডবার্গ ধ্রুবকের মান 109678 cm-¹ যা সমান।



রাদারফোর্ড ও বোর পরমাণু মডেলের তুলনাঃ 

১. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে আবর্তনশীল ইলেকট্রনের কক্ষপথের আকার সম্পর্কে কোন ধারণা দেওয়া হয়নি। অপরদিকে, বোরের পরমাণু মডেলে নির্দিষ্ট কিছু স্থির কক্ষপথের ধারণা দেওয়া হয়েছে।

২. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল অনুসারে পরমাণু সুস্থিত নয়। এ মডেল অনুসারে পরমাণুর স্থায়িত্ব হচ্ছে ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস ও ঋনাত্বক চার্জ যুক্ত ইলেকট্রনের মধ্যে স্থির বৈদ্যুতিক কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী আকর্ষণ বল যা পরস্পর সমান। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে নিউক্লিয়াসের চারপাশে আবর্তনশীল ইলেকট্রন ক্রমাগত শক্তি বিকিরণ করার কারণে আবর্তন চক্র ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসে পতিত হয়।                       কিন্তু বোরের পরমাণু মডেল অনুসারে পরমাণু স্থায়ী। কারণ, ইলেকট্রন সমূহ একটি নিদিষ্ট স্থির কক্ষপথে অবস্থানকালে কোন শক্তি বিকিরণ বা শোষণ করে না। যার কারণে ইলেকট্রনটি নিউক্লিয়াসে পতিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকেনা।

৩. আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষা রাদারফোর্ডে পরমাণু মডেলের মূল ভিত্তি। কিন্তু ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ও আইনস্টাইনের আলোক সম্পর্কিত কোয়ান্টাম তত্ত্ব হচ্ছে বোর পরমাণু মডেলের মূল ভিত্তি।

৪. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল সৌরজগতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু বোরের পরমাণু মডেলে এরূপ তুলনা করা হয়নি।

৫. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে বর্ণালী সম্পর্কে কোন ধারণা দেওয়া হয়নি। কিন্তু বোরের পরমাণু মডেলে বর্ণালী সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে।

৬. বোর পরমাণু মডেল হতে শক্তিস্তরের ব্যাসার্ধ ও বিভিন্ন শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের শক্তি নির্ণয় করা সম্ভব। কিন্তু রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল দ্বারা এরূপ সম্ভব হয় না।