সুকান্ত লিখেছিলেন—’আমি যে জনতার কবি হতে চাই, জনতাবাদ দিলে আমার চলবে কী করে?’ সত্যই তো, যে কবি জনগণের আনন্দে আনন্দিত হন আর দুঃখ-যন্ত্রণায় ব্যথিত হন তিনি কি কখনো মুমূর্যু জনতার দুরবস্থা দেখে নিরুত্তর থাকতে পারেন? তাঁকে তো গাইতেই হয় তিমির হননের গান।

‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের ‘বোধন’ কবিতায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যে তিমির হননের মস্ত্র উচ্চারণ করলেন তা সবার্থে তিমির বিদারী মহাজীবনেরই মহামন্ত্র।

কবিতার পশ্চাৎ-পটে রয়েছে ৪৩-এর মন্বন্তর। রয়েছে এই কালো দিন থেকে উদ্ধারের তথা মুক্তির এক বার্তা। কবি ‘আকাল’ (১৩৫১)-এর ‘কথামুখ’-এ কবি ৪৩-এর দিনগুলি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন—’তেরোশো পঞ্চাশ কেবল ইতিহাসের একটা সাল নয়, নিজেই একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস। সে ইতিহাস একটা দেশ শ্মশান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, ঘর ভাঙা গ্রাম ছাড়ার ইতিহাস, দোরে দোরে কান্না আর পথে-পথে মৃত্যুর ইতিহাস, আমাদের অক্ষমতার ইতিহাস। এই অবক্ষয়ের ইতিহাস রচনার সূত্রপাত ১৯১৪-এর প্রথম মহাযুদ্ধের কাল থেকে। এরপর ১৯৩৯-এর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই অবক্ষয়ের ইতিহাস ঘনকালো অন্ধকারের কালো অক্ষরে লিখিত হয়। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে— ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাঙ্গালীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক জগতে প্রচণ্ড বিপর্যয় আনিয়া দিল। এই বিপর্যয় শেষপর্যন্ত সাধারণ শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষগুলিকে দুর্ভিক্ষের মাঝখানে দাঁড় করালো। সুকান্তের ভাষায়—

“আমাদের দেশেতে আজ মরে লোক অনাহারে,

এসেছি তাদের তরে মহামানবের দ্বারে।

লাখে লাখে তারা আজ পথের দুধারে থেকে, 

মৃত্যু দলিত শবে পথকে ফেলেছে ঢেকে।”

‘বোধন’ কবিতায় এই পঞ্চাশের মন্বন্তরের ও ৪২-এর প্রাকৃতি দুর্যোগ তথা ঝড়বৃষ্টি ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মর্মান্তিক দাবীকে কাব্যদেহে স্থান দিয়েছেন। শুধু স্থানই দেননি, বরং দুর্দিন কাটিয়ে মহামানবের জিয়নমন্ত্রকে আত্মিকরণ করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

গদ্যে-পদ্যে মিলিতভাবে [চমপু কবিতার আঙ্গিকে] রচিত ‘বোধন’ কবিতার প্রথমেই ‘মহামানব’ কে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ মহামানব রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ লেখা’র মহামানব। ও মহামানব ধ্বংসের অশ্রুজাত কল্যাণের পূর্ণ মূর্তি। আনন্দ বাগচীর মতে—‘এই মহাপুরুষের চেহারা সঠিক কি রকম আমাদের জানা ছিল না। কোন্ সূতিকাগারে, কোন নিদারুণ লাঞ্ছনার মধ্যে এই মহামানব ভূমিষ্ট হতে যাচ্ছেন তখন কি আর ঘুণাক্ষরেও জানতাম? দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগিয়ে যে মহামানব আসবে; ফুটপাত বস্তী কুঁড়েঘর তারই তোরণদ্বার–দারিদ্র্য আর অন্ধকার চিরদিনই তার শুশ্রষায় ন্যস্ত, রক্তক্ষয়-হতাশা-অবিশ্বাস তারই প্রসব বেদনা—সেই যে অযোনি সম্ভুত মহাপ্রকাশ তারই অন্য নাম নতুন কাল, তখন কে জানতো! গ্রামে-নগরে বন্দরে লক্ষ লক্ষ বহতা মানুষ, মানুষের বিন্দু বিন্দু নীহারিকা সমবেত হয়ে সেই মহামানবের জন্ম। সুকান্তর কবিতায় তারই অকাল বোধন হয়েছে?

কবিতার সূচনায় অক্ষয় মহাপুরুষের উদ্দেশ্যে কবির প্রার্থনা শোনা যায় এই ভাষায়—

‘হে, মহামানব, একবার এসো ফিরে

শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,

এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার ;

লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।

যেখানে মৃত্যুর রাজত্ব, যেখানে অন্ধকারের রাজত্ব সেখানে ‘পিতার মতো’ তিনি উপস্থিত। মড়ক-মন্বন্তর-দুযোর্গ-এর উত্তাল সমুদ্রে হাল ধরেন এই পুরুষ—পাড়ের ঠিকানা চিহ্ন জানান দেন এই পুরুষ। এই পুরুষোত্তমের বোধনেই এ কবিতার পথ চলা। আসলে যুদ্ধ মন্বন্তর—দুর্যোগের দিনগুলি থেকে আলোকময় দিনের আকাঙ্ক্ষায়, সুস্থ মানবসমাজ গড়ে তোলার জন্যই কবির এহেন অকাল বোধন,—এ যেন অসুর নাশিনীর অকালবোধন।

মানুষের শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নজরুল বিদ্রোহী; মানবতার অবনয়নে বিদ্রোহী সুকান্ত। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এ কবি সমবেত জনসাধারণকে মহামানবের উজ্জীবন বাণী শুনিয়ে দ্বিতীয় স্তবকের ঘুমিয়ে থাকা জনগণকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। যেখানে গ্রাম-শহর জুড়ে চলেছে মৃত্যুর মহামিছিল, যেখানে আকাশ-বাতাস-সবুজ মাটিতে নীরবে মৃত্যু ঘাঁটি গেড়েছে, যেখানে—’ঘন ঘন বন্যার আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল, যেখানে ভাঙা ঘর-ফাঁকা ভিটে-সেখানে জীবনদায়ী সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ ছাড়া কেইবা পারে দুস্থ যাত্রীগণকে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিতে ? তাই কবির আহ্বান—

‘এখানে চরম দুখে কেটেছে পর্বনাশের খাল,

ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,

হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।

—এই শুকনো পাতা রূপী মেহনতী মানুষরা মহামানবের বিপ্লব মন্ত্রকে পাথেয় করেই পুঁজিপুতি—শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে—এ আশা রাখেন স্বয়ং কবি। তবুও কবির বিস্ময়—

“…তবু আজো বিস্ময় আমার-

ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস

তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ।

যারা ধূর্ত প্রবঞ্চক, যারা মুনাফাবাদ—যে পুঁজিপতি সমাজ খেটে খাওয়া মানুষের মুখের গ্রাস কেড়েছে তাদের অপরাধের ক্ষমা করে প্রকান্তরে জনগণ তাদেরই সর্বনাশ করছে। এই সর্বনাশ থেকে রক্ষার একমাত্র পথ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-রুখে দাঁড়ানো। সুতরাং যারা শস্য চুরি করে গুপ্ত কক্ষতে গুদামজাত করে জনগণকে মন্বন্তরের মুখে দাঁড় করিয়েছে—এই মানবতার শত্রুদের কাছে হাত পাতা নয় বরং ছিনিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। কেননা কবি মনে করেন—

‘লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে

তুমি যে পেতেছে হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে 

অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিষ্ফল 

তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল।

তাই তো ‘শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি/তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি নিয়ে কাছে ডাকে—/কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে।—এই দুর্বিপাক থেকে মুক্তি পেতে ক্ষুধার্ত মানুষের ‘দৃপ্ত মুঠি’ উত্তলনের সময় এসেছে। শ্রেণি শত্রুকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সমবেত সংগ্রামের মধ্যদিয়েই সাম্যবাদী শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে বলে কবি মনে করেন। কবি বিদ্রোহের অগ্নিবাণী উচ্চারণ করেন এই ভাষায়—

‘লোভের মাথায় পদাঘাত হানো-

আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো?

দৈত্যরাজের যত অনুচর

মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর ;

মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ-

হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ।

কর্মে-কথায় কৃষাণ-মজুরের জীবনের শরিক কবি সুকান্ত এরপর জেহাদী হয়ে উঠেছেন। মালিক, মজুতদারদের নিকটে তিনি মৃত মানুষের হিসাব চাইছেন উচ্চকণ্ঠে—

‘শোন্ রে মালিক, শোন্ রে মজুতদার ! 

তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়-

হিসাব কি দিবি তার??

আজ হিসাব নেবার দিন এসেছে। ‘জনগণকে যারা জোঁক-সম শোষে’, যারা নিজেদের স্বার্থের কারণে ক্ষুধার রাজ্য তৈরি করে তাদেরকে তো হিসেব দিতেই হবে মানুষের কাছে। নইলে ধ্বংস তাদের অবশ্যম্ভাবী। স্বয়ং কবির ব্যক্তি জীবনেও এদের নখরাঘাত পড়েছে। তাই এক ছাতার নীচে দণ্ডায়ন প্রতিবাদী জনতার সঙ্গে কবিও সামিল হয়ে কুচক্রকারীদের বিরুদ্ধে বিনাশবাণী উচ্চারণ করেছেন—

‘প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,

ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,

সে কথা কি আমি জীবনে মরণে

কখনো ভুলতে পারি ?

আদিম হিংস্ৰ মানবিকতার যদি আমি কেউ হই

স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের

চিতা আমি তুলবই?’

রবীন্দ্রনাথও একই রকমভাবে অহঃসর্বস্ব ধ্বংস লোলুপ স্বার্থপর মানুষদের বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। আসলে সত্যদ্রষ্ট। কবিমাত্রই এ সত্য জানেন—সত্যের, মানবতার জয় অবধারিত। তাই ‘বহুশত যুগ পরে/ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে’ নৃতত্ত্ববিদ্ যখন শোষক মালিক, মজুতদাদের হাড়ে মানবত্বের ছাপ পাবেন না তখন তাদের মনেও প্রশ্ন জাগবে—’তেরশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার/ মানুষ ছিল কি ? ‘তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস’ যারা কেড়ে খেয়েছে সেই অমানুষ শ্রেণির জীবনাকালে তাই পতনের কালো মেঘ সমাচ্ছন্ন—’দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়। এখনই উঠে দাঁড়াতে হবে। প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা দু-হাতে এখনই বাজাতে হবে। মহাজীবনের কাছে প্রার্থনা করতে হবে—

‘হে জীবন, হে যুগ সন্ধিকালের চেতনা

আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বান্দুিত দুর্দমনীয় শক্তি,

প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের

তুষার-গলানো উত্তাপ।

এই ‘তুষার গলানো উত্তাপ’ নিয়ে ‘মৃত্যুর বিভীষিকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করলে মানবজাতিক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে ডুবতে হবে। তাই কবির বাণী—

‘শোষক আর শাসনের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে

একত্রিত হোক আমাদের সংহতি।

শুধু সংকল্প নয়, শাসকের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামই আজ প্রয়োজন। আর তা যদি না হয় তাহলে একথা স্পষ্ট—

…..বুঝবো তুমি তো মানুষ নও 

গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও। 

ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নিজল 

দেয়নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল 

পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই 

ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।