জ্ঞানদাসের কাব্যানুভুতি ও ভাবাবেগের উৎস—“রাধাভাবদ্যুতিসুবলিততনু” শ্রীচৈতন্য। এই প্রেমাবতারের “অরূপ মূর্তিখানি” অবলম্বন করেই জ্ঞানদাসের শ্রীরাধার রূপমূর্তি অভিমূর্ত হয়েছে। তার সম্পর্কে সাহিত্যের ইতিহাসে শুধু এইটুকু তথ্য পাওয়া যায়, ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে আনুমানিক ১৫৩০ খ্রীস্টাব্দে বর্ধমান জেলার কাঁদড়া গ্রামে এক ব্রাহ্মণ বংশে কবির জন্ম হয়। নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’ নামক বৈষ্ণব শাস্ত্র ইতিহাসের কোষগ্রন্থে (অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে রচিত) জ্ঞানদাসের ‘মৃদঙ্গবাদক’ রূপে উল্লেখ (২২/৩৭৪৯) আছে। তিনি নিত্যানন্দ মহাপ্রভুকে সম্ভবতঃ দেখেছিলেন। ড. বিমানবিহারী মজুমদার জ্ঞানদাস ও তাহার পদাবলী’ (১৯৬৫) গ্রন্থে বলেছেন “ জ্ঞানদাসের পদে প্রত্যক্ষদর্শীর পরিচয় পাওয়া যায়। জ্ঞানদাসের নিত্যানন্দের ভাববর্ণনার পদগুলি দেখিয়া মনে হয়, কবি যেন নিজ চোখে দেখিয়া এগুলি লিখিতেছেন।” জ্ঞানদাস নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবা দেবীর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন এবং নিত্যানন্দ শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। খেতুড়ীর বৈষ্ণব সম্মেলনে কবি উপস্থিত ছিলেন।

জ্ঞানদাসকে ঘিরে চণ্ডীদাস সমস্যার মত কোন জটিলতা আপাতভাবে না দেখা গেলেও ভবিষ্যতে এই ধরনের আশঙ্কা আছে। কারণ ‘পদকল্পতরু’ (গোকুলানন্দ সেন বা বৈষ্ণব দাস সংগৃহীত অষ্টাদশ শতকের সংকলন গ্রন্থ) গ্রন্থে জ্ঞানদাসের নামে পদ আছে ১৮৬টি। এর মধ্যে ১০৫টি আছে ব্রজবুলিতে লেখা। এছাড়া ‘যশোদার বাৎসল্যরস’ নামে জ্ঞানদাসের লেখা একটি পালাগানেরও সন্ধান পাওয়া গেছে।

আবার শ্রদ্ধেয় হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে, জ্ঞানদাসের রচিত পদের সংখ্যা অন্ততঃ ৪০০-র কম হবে না। কিন্তু জ্ঞানদাসের লেখা প্রাচীন ও প্রামাণিক পদগুলির তুলনায় পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত অনেক পদে ভণিতা-ব্যবহারে পার্থক্য চোখে পড়ে; যেমন প্রামাণ্য পদগুলিতে রাধাকৃষ্ণলীলা বর্ণনার সঙ্গে একীভূত হয়ে কবির আত্মপ্রকাশ— “জ্ঞানদাস কহে সখি স্থির হৈয়া থাক দেখি” অথবা “অঙ্গ অবশ ভেল লাজ ভয় মান গেল জ্ঞানদাস ভাবিতে লাগিল”। কিন্তু পরবর্তীকালে পালাকারের মতো নিছক বিচ্ছিন্নভাবে ভণিতায় বলা হয়েছে—“জ্ঞানদাস কন”। খুব সম্ভবত, এই কারণেই শ্রদ্ধেয় শ্রীমুখোপাধ্যায়ও স্বীকার করেছেন “এই পালাপুঁথিটি পদাবলী সাহিত্যের জ্ঞানদাসের রচিত কিনা, তাহা অভ্যন্তরীণ প্রমাণের সাহায্যে নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না।”

জ্ঞানদাসের কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “জ্ঞানদাসের কবিতা যখন শুনলুম তখন এই কথাটি বার বার মনে এল, এ যে আধুনিক! আধুনিক বলতে আমি এই কালেরই বিশেষ ছাঁদের জিনিস বল্‌চিনে। এসব কবিতা চিরকালই আধুনিক … পুরাতনের মধ্যে চিরন্তনকে দেখে চমকে উঠি। যারা নজীর সৃষ্টি করে, নজীর অনুসরণ করে না, তারাই আধুনিক, চিরকালের আধুনিক” (দ্রষ্টব্য : ‘দাদৃ’, ক্ষিতিমোহন সেন, ১৩৪০ বঙ্গাব্দ, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ২)। অথচ সমকালের বৈষ্ণব সমাজ ও সাহিত্যে জ্ঞানদাসের কবিরূপে গুরুত্ব তেমনভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল বলে মনে হয় না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ‘ভক্তিরত্নাকর’ নামক বৈষ্ণব সম্পর্কিত ইতিহাস গ্রন্থে “জ্ঞানদাসের নামের উদাসীন উল্লেখ ঘটেছে মাত্র একবার, তাও মৃদঙ্গবাদক হিসেবে” (দ্রষ্টব্য : ‘বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য’ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮১)। খুব সম্ভবত, জ্ঞানদাস নিত্যানন্দ শাখাভুক্ত হওয়ার ফলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হয়েছিলেন।

জ্ঞানদাস ও চণ্ডীদাসের মধ্যে তুলনা :

জ্ঞানদাসের শিল্প-সাধনায় চণ্ডীদাসের আত্মলীন ভাবব্যাকুলতা অনুপস্থিত, গোবিন্দদাসের হীরক-কাঠিন্যও বিরলদৃষ্ট। কিন্তু লাবণ্যকে অনায়াস বন্ধনে বেঁধে “নিত্যকালের রতনকণ্ঠহার” রচনার গৌরব নিঃসন্দেহে তাঁর প্রাপ্য। অনাকাঙ্ক্ষার ঘৃতপ্রদীপ জ্বেলে তাঁর রাধা অদ্ভরতমকে দেখলেও তিনি চণ্ডীদাসের রাধার মত যৌবনে যোগিনী নন—“রাঙ্গাবাস”-এর চেয়ে নীলাম্বরী শাড়ীর দিকে তার রাধার পক্ষপাত বেশি

“তুয়া অনুরাগে হাম পড়ি নীল শাড়ি

তুয়া অনুরাগে হাম পীতাম্বর ধরি ।।”

অবশ্য মাঝে মাঝে পীত-কৌশেয় বসনা রাধার অস্তরে বাহিরেও লেগেছে গৈরিক স্পর্শের জন্য ব্যাকুলতা, এক পরম কাম্যের পদধ্বনির তপস্যায় কণ্ঠেও শোনা গেছে দূরাগত অসীমের রহস্য-ব্যঞ্জনা।

কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাবের উচ্চগ্রামে সুর বেঁধে চণ্ডীদাসের রাধা যেখানে সুখদুঃখাতীত অতীন্দ্রিয় লোকে উন্নীত, চলমান বিশ্বের ধূলি মালিন্যের মাঝে ঘর বেঁধে জ্ঞানদাসের রাধা সেখানে লৌকিক মানবীতে রূপান্তরিত। যে বর্ণন-প্রাঞ্জলতা ও স্বভাবোক্তি অলঙ্কারের দ্বারা চণ্ডীদাসের পদ আপন স্বভাবে আপনি বিকশিত, জ্ঞানদাসের কবিতারও তাই ধ্রুব আকর্ষণ। তাই পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ ও নিবেদনের পদে জ্ঞানদাস অদ্বিতীয় না হোন, নিঃসন্দেহে অতৃতীয়।

“দেইখা আইলাম তারে সই দেইখা আইলাম তারে।

এক অঙ্গে এত রূপ নয়নে না ধরে ।”

—পূর্বরাগের উদ্বেগ-আকুলতা এখানে ভাষায় ঈশিত্ব কিম্বা অলঙ্কারের বিচিত্র চিত্রাল্পনা ছাড়াও অপূর্ব বর্ণগরিমায় হয়েছে “সর্বজন- হৃদয়- সংবেদ্য।”

“রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল ॥”

—পূর্বরাগের অন্তগূঢ় বেদনা এখানে সহজ ভাষায় আশ্চর্য হৃদয়গ্রাহী। রাধার চোখদুটি যে শ্যামল যৌবনশোভায় মুগ্ধবিবশ, স্বভাবোক্তি অলঙ্কারের সাহায্যে সুন্দরভাবে তা রেখাঙ্কিত।

চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের পদে আনন্দ ও উল্লাস বিলুপ্ত। কস্তুরী-ধূপের মত নিজেকে জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ করে দেওয়াই তাঁর রাধার চরিত্রধর্ম। তাই যৌবনের প্রাণোচ্ছল ছবি নয়, ধ্যানহারা তপস্বিনীর মূর্তিই সেখানে প্রোজ্জ্বল। সেই যে কোন একদিন শুভ প্রত্যুষে শ্যাম নাম তাঁর “কানের ভিতর দিয়ে” মরমে প্রবেশ করেছিল সেই থেকে সমাহিত যোগিনী মূর্তিতে সেই নাম জপ করাই হয়েছে তার একমাত্র সাধনা। রাধার প্রাণ এখানে শুধু প্রেমার্থিকা নয়, যেন পরমার্থিকার প্রাণ। কিন্তু জ্ঞানদাসের পদে আনন্দের সঙ্গে বেদনার রাখীবন্ধন। সাধ্বয়ন্তী প্রেমিকা রাধা এখানে কখনও সলজ্জ সন্ত্রাসের স্পর্শে শিহরিত, কখনো কৃষ্ণের স্পর্শলাভের জন্য আকাঙ্ক্ষিত। চণ্ডীদাস বিরহের কবি, জ্ঞানদাস মাধুর্যের। চণ্ডীদাস গভীরতম প্রাণবেদনার গীতিকার, জ্ঞানদাস ঐ একই প্রাণবেদনার সার্থক চিত্রকর। একজন স্বভাব-শিল্পী, অপরজন মণ্ডন-শিল্পী।

চণ্ডীদাসের অনেক কবিতাই জ্ঞানদাসের নামে চলে গিয়েছে একথা হয়ত অজানা নয়, তবু শুধু ঐতিহাসিকভাবেই যে এই যুগ্মোবস্থান ঘটেছে তা নয়, কবি-স্বভাব বিশ্লেষণেও। দেখা যায় এই দুই কবির মধ্যে আপাতসাদৃশ্য তুচ্ছ করবার মতো নয়। দুজনেরই কবিতায় সহজ স্বতঃস্ফূর্তি ও দেশজ অনুষঙ্গের ব্যবহার আছে, আছে অনেকক্ষেত্রে রাধা চরিত্রের রমণে-বাচনে কথায়-আচরণে পরস্পরের মধ্যে সাদৃশ্য। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে, সম্পূর্ণভাবে নয়। সেক্ষেত্রে মনোভঙ্গীর পার্থক্যও অল্প নয়।

চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য রোমান্টিকরূপে পরিচিত কবি জ্ঞানদাসের মধ্যে প্রথমোক্তজনের বেদনাময় অভিজ্ঞতা সংরাগে পরিণত হয়েছে। চণ্ডীদাসের “দেশে দেশে ভরমিব যোগিনী হইয়া” এবং জ্ঞানদাসের “পরিয়া অরুণবাস যোগিনী হইব”—– উভয় উচ্চারণের মধ্যে প্রথমটি ব্যাকুল, শেষোক্তটি বাসনা রঙিন। চণ্ডীদাসের যেখানে ধ্বনি “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো/আকুল করিল মোর প্রাণ” সেখানে

“হৃদয় পশিল রূপ পিঞ্জর কাটিয়া

জ্ঞানদাসের মনে রহিল জাগিয়া”।

পূর্বরাগের কবি চণ্ডীদাসের কবিতায় যেখানে নিরুত্তাপ নম্র দীপশিখা দেখা যায়, আক্ষেপানুরাগের কবি জ্ঞানদাসের কবিতায় সেখানে মৃন্ময় দীপাধারটি চোখে পড়ে। চণ্ডীদাসের সমস্ত কবিতার মধ্যে একটি আত্মস্থ আনুপূর্বিকতা রয়েছে। জ্ঞানদাসের কবিতায় দুঃখ ও আনন্দের এক একটি চকিত অভিজ্ঞতা তীব্র ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গভীর হতাশ্বাসের পাশাপাশি সুদীপ্ত বিশ্বাসের কবিতার সংখ্যাও তার কম নয়। কবি জ্ঞানদাস হলাহলের অতল সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, কখনও আবার সপার্ষদ চৈতন্যদেবের অভিসারের উদ্ভাসিত ছবি মনে মনে এনে বলেছেন—

“ররাব, মুরজ, বীণা সুমেলি করিয়া।

বৃন্দাবনে প্রবেশিল জয় জয় দিয়া।”

আধুনিক কালের লিরিক কবিতায় চেতনায় যেন পর পর দুটি মুহূর্তে সম্পূর্ণ বিপরীতবোধ ফুটে উঠতে পারে, জ্ঞানদাসের কবিতায় তার তুলনীয় উদাহরণ খুব কম পাওয়া যাবে না। সুতরাং একথা মনে করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই যে, চণ্ডীদাসের কবিতাকে অনুসরণ করেই তিনি মৌলিকতা খুঁজে পেয়েছিলেন।

রাধাভাবের তন্ময়তায় জ্ঞানদাস গভীরতর, চণ্ডীদাস গভীরতম। চণ্ডীদাসের নায়িকা ভাবের উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত। তিনি নিজেকে দেখতে, দেখাতে ভালবাসেন না, শুনতে শোনাতে যেন বেশি ভালবাসেন, সমস্ত জগৎকে তিনি শ্রবণে পরিণত করেন। (নামের নেশা থেকেই নাম-সঙ্কীর্তন, নির্জন থেকেই জনাকীর্ণ হয়ে ওঠার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নিৰ্গুণ মরমী হিন্দি কবিদের ‘সাখী’ ও ‘শব্দ’, সুফীদের ‘কুদরৎ’ আর ‘হিকমৎ’ বা ‘ফনা’ এবং ‘সমা’ প্রভৃতি চেতনার স্পন্দন ও তাকে উত্তরণ স্তরের নানা প্রতিশব্দের সাহায্যে, যেমন ‘সমা’ শব্দের অর্থ ‘শ্রবণ’। সুন্দর ধ্বনি শুনলেই ঈশ্বরের দিকে যাওয়া যাবে এই হলো তাৎপর্য)। কিন্তু জ্ঞানদাসের রাধা চণ্ডীদাসের নায়িকার মতো যৌবনে যোগিনী নন, নিজেকে শ্যাম-অনুরাগে রঙিন করে দেখতেই তাঁর ঝোক বেশি—

“তুয়া অনুরাগের হাম পড়ি নীল শাড়ি। 

তুয়া অনুরাগে হাম পীতাম্বর ধরি ৷৷”

প্রকৃতপক্ষে চণ্ডীদাসের নায়িকার সঙ্গে জ্ঞানদাসের রাধার চরম পার্থক্য সম্ভবত এই শ্যাম-অনুরাগের একাত্মবোধে। তাঁর শ্যাম আর শ্রীমতী দুই দেহ, কিন্তু অদ্বৈত সম্পর্কে একীভূত : “একই পরাণ দেহ ভিন ভিন”। তাই তাঁর রাধা নিঃসঙ্কোচে বলেন— “কি দিব কি দিব মনে করি আমি যে ধন তোমারে দিব সেই ধন তুমি ৷৷” সেখানে চণ্ডীদাসের রাধা বলেন—

“তোমার চরণে    আমার পরাণে

বাঁধিল প্রেমের ফাসী।

সব সমর্পিয়া     এক মন ইয়া

নিশ্চয় হইলাম দাসী ।”

এখানে অনুভব করা যায়, একজনের কাব্যে আমিত্ব বিলুপ্ত, আর একজনের পদ ‘আমিত্বের’ শঙ্কিত অভিমানে স্পন্দিত। পাঠকমনকে একজন মুগ্ধ করেন, আর একজন বিস্মিত করেন।

যৌবনের বনে মন হারিয়ে যাবার পর থেকেই রাধার একমাত্র অবলম্বন হল যমুনার ঘাট। ঘরে যাওয়ার অতি চেনা পথ, তবু তা যেন অনিঃশেষিত

“ঘর যাইতে পথ মোর হৈল অফুরাণ। 

অন্তরে বিদরে হিয়া না জানি কি করে প্রাণ॥”

অর্থালঙ্কারের ব্যঞ্জনা-সমৃদ্ধ রোমান্টিক রহস্যঘন এই বাণী ‘বহুযুগের ওপার হতে’ যোগক্ষেম রবীন্দ্র কণ্ঠে সঙ্গীতায়িত হয়েছে।

জ্ঞানদাসের একটি বৈশিষ্ট্য, বর্ণনীয় বিষয়ের উপযোগী পরিবেশ রচনা করে অপরূপ চিত্রাল্পনার সৃষ্টি। স্বপ্নদর্শনের পূর্বরাগের পদে ধ্বনিত

“রজনী শাঙন ঘন    ঘন দেয়া গরজন,

রিমি ঝিমি শবদে বরিষে।

পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে,    বিগলিত চীর অঙ্গে

নিন্দ যাই মনের হরিষে।।”

এমন ঘনঘোর বরষায় রাধা মনের স্বগতোক্তি যেন—

“আমিও একাকী, তুমিও একাকী, আজি এ বাদল রাতে। 

নিদ্‌ নাহি আঁখি পাতে।” (অতুলপ্রসাদ)

শব্দ ঝঙ্কার ও ধ্বন্যাত্মক শব্দের জলতরঙ্গে জ্ঞানদাসের পদ এখানে চণ্ডীদাসের অপেক্ষা অধিক শিল্পসুষম। পূর্বরাগের হৃদয়-ভেদী আকুতি অনাড়ম্বর ভাষায় দুষ্প্রাপ্য মনোহর

“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ।”

অন্তরের পরশের জন্য এই যে “Eternal Yearning”, এই আবেশ-বিহ্বলতা বিশ্বসাহিত্যেও সুলভ নয়। এই তীব্র আকর্ষণের পরই শ্যাম-পদে রাধার গৌর-তনু সমর্পণের তর্পণ অনুষ্ঠিত

“শ্যাম রাঙ্গা পায় এ তনু সঁপেছি তিল তুলসী জল দিয়া।”

মিলন এবং আক্ষেপানুরাগের পদে জ্ঞানদাসের শিল্প-কীর্তির অমৃত-সৌধ নির্মিত। মিলনের সুর বাজাতে গিয়ে চণ্ডীদাসের একতারা যেন ‘সায়াহ্ন সমীরণের দীর্ঘশ্বাসে’ ভারাক্রান্ত। উভয়ের মধ্যে তর-তমের পার্থক্য দূরতিক্রম্য। স্বভাবের তন্ময়তার জ্ঞানদাস গভীরতর, চণ্ডীদাস গভীরতম। জ্ঞানদাসের পদ থেকে বিবাহের ম্লান ধ্বনি উত্থিত হলেও তা চণ্ডীদাসের মত সকরুণ হয়ে বাজেনি। তাঁর শ্যাম আর শ্রীমতী, দুই দেহ, অদ্বৈত সম্পর্কে একীভূত। তাই তাঁর রাধা নিঃসঙ্কোচে বলেন

“তোমার গরবে গরবিনী হাম রূপসী তোমার রূপে।

হেন মনে করি ও দুটি চরণ সদা নিয়া রাখি বুকে।”

অথবা –

“কি দিব কি দিব মনে করি আমি। 

যে ধন তোমারে দিব সেই ধন তুমি ।।”

আত্মক্ষোভহীন বেদনা-সিক্ত আক্ষেপের ম্লানছায়া বিষমালঙ্কারের মাধ্যমে অপরিসীম ভাব-সুষমায় জ্ঞানদাসের এই পদে মণ্ডিত

“সুখের লাগিয়া    এ ঘর বাঁধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল। 

অমিয়া সাগরে     সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল ॥”

প্রেমের এই অতুলনীয় বেদ-বাণী কাব্যের সনাতন রসসিঞ্চনে পুষ্ট নয়—তা হৃদয়মূল থেকে উদ্ভিন্ন আনন্দ-বেদনার যুগ্মবৃত্তে প্রস্ফুটিত অনবদ্য ভাব-কুসুম।

প্রেমের পরিণতি পরস্পর আত্মনিবেদনে, প্রেম-সাধনার সিদ্ধিও অদ্বৈতসিদ্ধি নিবেদনের পদরচনায় জ্ঞানদাস ও চণ্ডীদাস দুজনেই সার্থকতার সীমা-স্বর্গে উন্নীত। তবু এখানে বিদ্যাপতির মত প্রণয়স্মিত জীবনের উচ্ছ্বসিত আনন্দ নেই, নেই চণ্ডীদাসের মতো ‘দুঃখের বরষায় চক্ষের জল’। জ্ঞানদাসের রাধা শুধু নিরাভরণভাবে বলেন—

“হিয়ার হৈতে বাহির হৈয়া 

কিরূপে আছিলা তুমি।”

অতি তুচ্ছ দুচারটি কথা। এ যেন গোষ্পদে আকাশের ছায়া, বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের অভিব্যঞ্জনা। তারপর হৃদয়ের উপরিভাগের চাঞ্চল্যের যে তলদেশে প্রেমের উদ্ভব, সেই অতল স্পর্শ থেকে আশ্চর্য সুষমায় উচ্চারিত শ্রীরাধার কণ্ঠস্বর

“অন্যের আছয়ে অনেক জনা আমার কেবল তুমি।”

চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের ‘বংশীশিক্ষা ও নৃত্য পর্যায়ে কতকগুলি পদ বিধৃত।‌ চণ্ডীদাসের প্রসিদ্ধ পদ যেন স্তোকবাক্যে মহাপ্রভুর আগমনী গান

“আজু কে গো মুরলী বাজায়

এত কভু নহে শ্যাম রায়”

অন্যদিকে জ্ঞানদাসের রাধা শ্যামের কাছে প্রশ্নাকুল উক্তি

“কোন্ রন্ধ্রেতে শ্যাম গাও কোন্ তান

কোন্ রন্ধ্রের গানে বহে যমুনা উজান

কোন্ রন্ধ্রেতে শ্যাম গাও কোন গীত

কোন্ রন্ধ্রের গানে রাধার হরি লহ চিত ।”

ইংরেজী Refrain-এর মত বারবার পুনরুচ্চারণে পদটি ঘন রসাবেশে তরঙ্গিত। 

জ্ঞানদাসের কাব্যের এক কোটিতে আছে ভাব-বিহ্বলতা, অন্য কোটিতে ছন্দ-মাধুর্য। বলা বাহুল্য, এ দুটির কোনটিই তাঁর কাব্যে একাত্ম হয়ে ওঠে নি। হলে তাঁর পদাবলী হয়তো সমস্ত পদ-সাহিত্যের মধ্যমণি হয়ে উঠত। কিন্তু তা না হলেও মহাজন-কবিদের মধ্যে যথার্থ লিরিক-প্রতিভার একমাত্র উত্তরাধিকারী জ্ঞানদাস।