১৩১৬ বঙ্গাব্দে (১৯০৯ খ্রীঃ) বসন্তরঞ্জন রায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পুঁথি আবিষ্কার করেন। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে তাঁর সম্পাদনায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর বঙ্গদেশে বিশেষ করে প্রাচীন সাহিত্য রসিক মহলে চণ্ডীদাস সম্পর্কিত সমস্যাটির উদ্ভব হয়। এই সমস্যা আরও প্রবলতর হয়ে ওঠে যখন মনীন্দ্রমোহন বসু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথিশালা থেকে দীন চণ্ডীদাসের পদ আবিষ্কার করেন। মূলত চণ্ডীদাস সমস্যার মূল কথাটি হল— চণ্ডীদাস নামে কতজন কবি ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে কে কে চৈতনা পূর্ববর্তী এবং কে কে চৈতন্য পরবর্তী? আরও বিচার্য হল চৈতন্যদেব কি বড়ু চণ্ডীদাসের পদে রসাস্বাদন করতেন? বড় চণ্ডীদাস কি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ব্যতীত বিচ্ছিন্ন কোনও বৈষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন? এইসব প্রশ্নের জোয়ারে মাথা চাড়া দিয়েছে চণ্ডীদাস সমস্যা।

দীনেশচন্দ্র সেনের মতে চণ্ডীদাস একজনই। যৌবনে যে চণ্ডীদাস তীব্র আদিরসাত্মক কাব্য রচনা করেছিলেন, পরিণত বয়সে তিনিই আধ্যাত্মিক রসসমৃদ্ধ পদাবলী রচনা করেন। তাঁর ভাষায়— “কবি চণ্ডীদাস ও কৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা যে অভিন্ন ব্যক্তি, তৎ সম্বন্ধে আমাদের সংশয় নাই।” এই মত গ্রহণ করার পূর্বে প্রথমে দেখা যাক মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পদ আস্বাদন করেছিলেন কিনা? কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে আছে—

‘চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি    রায়ের নাটক গীতি 

কর্ণামত শ্রীগীতগোবিন্দ ৷ 

স্বরূপ রামানন্দ সনে     মহাপ্রভু রাত্রিদিনে

গায় শুনে পরম আনন্দ।।

এই উক্তি অবলম্বনে অনেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, চৈতন্যদেব বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকীর্ত্তনেরই দান ও নৌকাখণ্ডের পদের রসাস্বাদন করে ‘পরম আনন্দ’ উপভোগ করতেন।

ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে প্রমাণিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের রচনা। কিন্তু চৈতন্যদেব যথার্থই বড়ু চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করেছেন কিনা তাতেই সংশয় জাগে তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অন্তর্গত দান ও নৌকাখণ্ডের স্থূলতা চৈতন্যদেবের পক্ষে গ্রহণ করাও অস্বাভাবিক বলে কেউ কেউ মনে করেন। চৈতন্যদেব যদি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আস্বাদন করতেন, তা হলে ভক্ত বৈষ্ণবরা অন্যান্য বৈবগ্রন্থের মতো শিরোধার্য করে রাখতেন, কিংবা এ কাব্য বৈব সমাজে এতকাল বিস্মৃত ও অনাদৃত থাকতো না। তাই বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আদি মধ্যযুগের রচনা হলেও চৈতন্যদেব এই কাব্যগ্রন্থ পাঠ করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে গবেষক মহলে গভীর সংশয় আছে।

তবে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ব্যতীত আর কোনও বিচ্ছিন্ন পদ রচনা করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ হতে চণ্ডীদাসের পদাবলীর প্রথমখণ্ড প্রকাশ করেন। সম্পাদকদ্বয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ব্যতীত অনেকগুলি বিচ্ছিন্ন পদকেও বড়ু চণ্ডীদাসের পদ হিসেবে বিচার করেছেন কীভাবে তার কোনও নির্দেশ ভূমিকায় দেননি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায়, ‘বড়ু চণ্ডীদাসের পদ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন— “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বাইরে বড়ু চণ্ডীদাসের পদ নাই। বড়ু চণ্ডীদাস বিক্ষিপ্ত কবিতা হিসাবে পদাবলী রচনা করেন নাই।”

পরবর্তীকালে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তুলনামূলক আলোচনার দ্বারা দেখিয়েছেন—বড়ু চণ্ডীদাস অপরাপর চণ্ডীদাস থেকে পৃথক—

১। কোনও কোনও স্থানে দ্বিজ চণ্ডীদাস বা দীনচণ্ডীদাস নাই। (কৃষ্ণকীর্তনে)

২। বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীমতী রাধিকার পিতামাতার নাম সাগর ও পদুমা বলেছেন।

৩। বড়ু চণ্ডীদাস রাধার কোনও সখী বা শাশুড়ী ননদের নাম উল্লেখ করেন নি।

৪। কাব্যে রাধার নামাত্তর চন্দ্রাবলী।

৫। শ্রীকৃষ্ণের কোনও সখার নাম নেই।

৬। বড়ু চণ্ডীদাস ‘প্রেম’ অর্থে ‘নেহা’ ব্যবহার করেছেন।

৭। বড়ু চণ্ডীদাস কোথাও রাধাকে ‘বিনোদিণী’ এবং কৃথ্বকে ‘শ্যাম’ নামে আখ্যাত করেন নি।

৮। রাধিকা গোয়ালিনী মাত্র, রাজকন্যা নয়।

৯। বড়ু চণ্ডীদাসের নিকট ব্রজুবুলি অপরিচিত, এ থেকে প্রমাণিত বড়ু চণ্ডীদাস অন্যান্য চণ্ডীদাস থেকে পৃথক।

প্রশ্নজাগা স্বাভাবিক, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত প্রভৃতি গ্রন্থে যে চণ্ডীদাসের নামোল্লেখ আছে তিনি যদি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা না হয়ে থাকেন তবে তাঁর অপর কি কোনও পরিচয় আছে? এর উত্তর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত— “চৈতন্য পূর্ববর্তী এই চণ্ডীদাসের পরিচয় প্রমাণভাবে আজও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।”

দীন চণ্ডীদাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা যায়—মনীন্দ্রমোহন বসুর মতে, পদাবলীর চণ্ডীদাস বলতে দীনচণ্ডীদাসকেই মেনে নিতে হয়। বিভিন্ন পদসংগ্রহগ্রন্থে চণ্ডীদাসের নামে সে সকল উৎকৃষ্ট পদ সংকলিত হয়েছে তা এই দীন চণ্ডীদাসেরই রচিত। তিনি পুরাণাশ্রিত কৃষ্ণলীলার এক বিরাট পালাগানও রচনা করেছিলেন। মণীন্দ্রমোহনের মতে বাঙালি পাঠকের নিকট যে চণ্ডীদাস আজও এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনিই প্রকৃত দীন চণ্ডীদাস।

দীন চণ্ডীদাস সম্পর্কে মনীন্দ্রমোহন বসুর বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় না। চৈতন্য পরবর্তী যুগে সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দীন চণ্ডীদাস নামক একজন পদকর্তা আবির্ভূত হয়েছিলেন, একথা ঠিক, কিন্তু তিনিই যে, চণ্ডীদাস-ভণিতা যুক্ত সকল উৎকৃষ্ট পদের রচয়িতা এই অভিমত যুক্তিযুক্ত নয়। এ সম্পর্কে কোন বলিষ্ঠ প্রমাণও মনীন্দ্রমোহন বসু দিতে পারেননি। এখানে যে দীন চণ্ডীদাসের অস্তিত্বের কথা উল্লিখিত হল তিনি রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক পালা গানের রচয়িতা এবং স্বল্পশক্তি সম্পন্ন কবি ছিলেন।

সবশেষে বলতে হয়, দীর্ঘ অর্ধশত কালপূর্বে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল আজও তা সমস্যাকারেই রয়েছে। সুখময় মুখোপাধ্যায় ‘বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন কবিদের পরিচয় ও সময়’ শীর্ষক গ্রন্থে চণ্ডীদাস সমস্যা সম্বন্ধে অতি বিস্তৃত মূল্যবান আলোচনা করেছেন। তবু চণ্ডীদাস বিতর্কের অবসান হয়নি।