বৈষ্ণব পদাবলীর ‘পূর্বরাগ’ ও ‘অনুরাগ’ পর্যায়ভুক্ত তোমাদের পাঠ্য পদগুলোর ভাবসৌন্দর্য বিশ্লেষণ করো।

বৈষ্ণব পদকারদের কাছে ‘পূর্বরাগ’ কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য কী? এই পর্যায়ের পদকর্তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? তার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি সমর্থন করে একটি প্রবন্ধ লেখো।

পূর্বরাগ’ শব্দটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে এই পর্যায়ের পদাবলীতে লৌকিক ব্যাকুলতা‌ কেমন করে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ হয়েছে দেখাও।

‘পূর্বরাগে’র কাব্যগত ও তত্ত্বগত পরিচয় দিয়ে ঐ শ্রেণীর পদরচনায় শ্রেষ্ঠ কবির‌ কৃতিত্ব উদ্ধৃতিসহ আলোচনা করো।

পুর্বরাগের সংজ্ঞা কী? বৈষ্ণব পদাবলীর পাঠ্য একটি পূর্বরাগের পদ অবলম্বন‌ করে এ বিষয়ে আলোচনা করো।

বৈষ্ণবপদকর্তাগণ রসশাস্ত্র ‘উজ্জ্বলনীলমণি’র নির্দেশে রাধাকৃষ্ণের লীলারসকে বিভিন্ন পর্যায়ে সাজিয়ে পদ রচনা করেছেন। এদের মধ্যে আছে পূর্বরাগ, রূপানুরাগ, আক্ষেপানুরাগ, অভিসার, বাসকসজ্জা, খণ্ডিতা, বিপ্রলব্ধা, কলহাস্তুরিতা, রাসলীলা, মাথুরলীলা, ভাবসম্মেলন প্রভৃতি।

পূর্বরাগ বৈষ্ণব কবিদের একটি অতি প্রিয় বিষয়। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে পূর্বরাগের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে –

রতিষা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শন-শ্রবণাদিজা।

তয়োরুন্মীলতি প্রাজৈঃ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে।

অপি মাধবরাগস্য প্রাথমো সম্ভবত্যপি।

আদৌ রাগ মুগাক্ষীণাং প্রোক্তা স্যাচ্চারুতাধিকা।

অর্থাৎ যে রতি মিলনের পূর্বে দর্শন ও শ্রবণাদির দ্বারা উৎপন্ন নায়ক-নায়িকা উভয়ের হৃদয়কে উন্মীলিত করে, তাহারই নাম পূর্বরাগ। যদিও মাধবের রাগই প্রথমে সমূত্পন্ন হয়, তথাপি মৃগাক্ষিগণের প্রথম রাগেই চারুতার আধিক্য কথিত হইয়া থাকে। পূর্বরাগের এই সংম্মা থেকে আমরা চারটি সূত্র পাচ্ছি। (১) মিলনের পুর্বেই এই ‘রতি” বা অনুরাগ সৃষ্টি হবে। সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথের মতে ‘প্রিয়বস্তুর প্রতি মানবমনের সহজ অনুরাগই রতি’ (‘রতিমনোহনুকূলেহর্থে মনসঃ প্রবণায়িতম্’)। (২) এই রতি বা অনুরাগ প্রধানত দ্বিবিধ উপায়ে সাধিত হয়ে থাকে (ক) দর্শনজাত অনুরাগ বা ‘রূপানুরাগ’ এবং (খ) শ্রবণজাত অনুরাগ বা শ্রবণানুরাগ। (৩) মাধবের অর্থাৎ কাস্তের অনুরাগই প্রথম উৎপন্ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ কৃষ্ণেরও পূর্বরাগ আছে। (৪) মৃগাক্ষী অর্থাৎ কাস্তার অনুরাগেই চারুতার আধিক্য অর্থাৎ রাধার পূর্বরাগই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বৈষ্ণব পদ সঙ্কলনে ‘পূর্বরাগ’ এবং ‘অনুরাগ’-কে একই শুচ্ছে আবদ্ধ করা হয়েছে। বস্তুত উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা কষ্টকর। প্রেমের প্রথম পদক্ষেপকেই ‘পূর্বরাগ’ বলে। প্রেমের দ্বিতীয় বা গাঢ় অবস্থার নাম ‘অনুরাগ’। রূপদর্শনে প্রেমের গাঢ়তাপ্রাপ্তিকে ‘রূপানুরাগ’ বলা হয়। অনুরাগের আধিক্যে উদ্ভ্রান্ত হয়ে অনুপস্থিত প্রিয়কে, নিজেকে বা স্বজনকে ভর্ৎসনার নাম ‘আক্ষেপানুরাগ’। এই আক্ষেপানুরাগ বা প্রেমবৈচিত্র ভিন্ন পর্যায়ের পদ। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’তে বলা হয়েছে—

অনুরাগো ভবেৎ ত্রিধা রূপাদাক্ষেপতক্রমাৎ।

অভিসারানুগশ্চ জ্ঞায়স্ত্রে রসিকৈজনৈঃ।।

তবে নন্দকিশোর দাস তার ‘রসকলিকা’ গ্রন্থে চার প্রকার অনুরাগের কথা উল্লেখ করেছেন—

অনুরাগের লক্ষণ হয় চারি প্রকার। 

উল্লাস আক্ষেপ রূপ অভিসার আর।।

পূর্বরাগের প্রধান শ্রেণী দুটি – দর্শনজাত, ও শ্রবণজাত, কিন্তু কবিকর্ণপুর দর্শনের তিনটি ভাগ—(১) সাক্ষাৎ দর্শন, (২) চিত্রপটে দর্শন, (৩) স্বপ্নে দর্শন এবং শ্রবণের পাঁচটি ভাগ 

  • (১) বন্দীমুখে শ্রবণ, 

  • (২) দূতীমুখে শ্রবণ, 

  • (৩) সখীমুখে শ্রবণ, 

  • (৪) গুণিজনের নিকট শ্রবণ এবং 

  • (৫) বংশীধ্বনি শ্রবণ– মোট এই আটটিকে ভাগ করেছেন।

পদাবলী সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য শ্রীরাধার পূর্বরাগ। এই পূর্বরাগের মূলে রূপানুরাগের ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য রাধার এই রূপানুরাগকে বহু কবিই বহুভাবে বর্ণনা করেছেন।

যদুনাথের ‘কি পেখলু যমুনার তীরে’, বংশীবদনের ‘যমুনা যাইতে পথে দু’সারি কদম্ব আছে’, গোবিন্দদাসের ‘মঝু মুখ দরশি বিহসি তনু মোড়ই’, বলরাম দাসের ‘অঙ্গ মোড়া দিয়া ত্রিভঙ্গ হইয়া’, প্রভৃতি পদের মধ্য দিয়ে রাধার রূপানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। গোবিন্দদাসের রূপানুরাগের একটি পদের নিদর্শন–

‘ঢল ঢল কাঁচা     অঙ্গের লাবণি

অবনী বহিয়া যায়।

ঈষত হাসির    তরঙ্গ-হিলোলে

মদন মুরুছানায়।।

কিবা সে নাগর     কি খেনে দেখিলু

ধৈর্য রহস দূরে।

নিরবধি মোর     চিত বেয়াকুল

কেন বা সদাই ঝুৱে।।’

শ্রবণানুরাগের একটি অতি প্রসিদ্ধ কবিতা– চণ্ডীদাসের

‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

কানের ভিতর দিয়া     মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোরে প্রাণ।।’

‘পূর্বরাগে’র রসশাস্ত্রোক্ত যে সকল লক্ষণের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো, তাত্ত্বিক বিচারে সেগুলি গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবে এই সমস্ত লক্ষণ কতখানি সুপ্রযুক্ত হয়, তা যে কোনো বিশিষ্ট কবির পূর্বরাগের পদ বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যেতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা চণ্ডীদাসের ‘সই, কে বা শুনাইল শ্যাম নাম’ কিংবা ‘রাধার কি হৈল অস্তরে ব্যথা’ পদ দুটির যে কোনো একটিকে গ্রহণ করতে পারি, কারণ এগুলি পূর্বরাগের বিশিষ্ট পদ রূপেই চিহ্নিত হয়ে থাকে।

রাধার পূর্বরাগ: শ্রীরাধার পূর্বরাগের কবিতাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জ্ঞানদাসের –

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরাণ পীরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।’

সমগ্র পদটির উদ্ধারের প্রয়োজন নেই, এই ক’টি পড়ক্তিকে অবলম্বন করেই বিদগ্ধ সমালোচক বলেছেন, “উদ্ধৃতির অনুরূপ রক্তের অণু-পরমাণুর এত বড়ো গীতক্রন্দন বৈষ্ণব সাহিত্যে নাই। অনস্ত হাহাকার মাত্র চার ছত্রের মধ্যে যেভাবে ধরা পড়িয়াছে, তেমন মহাবিস্ময় কাব্যেতিহাসে অল্পই ঘটিয়াছে। নিখিল মানবের বেদনা কোনো এক ক্ষুদ্র মানবকণ্ঠে উৎসারিত হওয়া সম্ভব, একথা কে বিশ্বাস করিত যদি ঐ অসম্ভব আর্ত কয়েকটি পয়ার ছত্র উপস্থিত না থাকিত ?”

রসশাস্ত্রে নায়িকাভেদে পূর্বরাগের প্রকারভেদের কথা বলা হয়েছে, যথা—মুগ্ধা, মধ্যমা ও প্রগলভা। যার রূপ দেখে নায়িকা মুগ্ধ, তার দৃষ্টি আকর্ষণকে বলা হয় অভিযোগ – এই অভিযোগ – পূর্বরাগের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বাচিক, আঙ্গিক ও চাক্ষুষ ভেদে অভিযোগ তিন প্রকার বৈষ্ণব পদাবলীতে এই তিনজাতীয় অভিযোগের নিদর্শন পাওয়া যায়। আঙ্গিক-জাতীয় একটি অভিযোগের প্ৰসিদ্ধ দৃষ্টান্ত—

‘থির বিজুরি বরণ গোরি পেখলু ঘাটের কূলে।’

বৈষ্ণব পদাবলী সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই ভারতীয় সাহিত্যে সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষায় অনেক পূর্বরাগের পদ রচিত হয়েছে বলা বাহুল্য, এ সবই লৌকিক প্রেমকে আশ্রয় করেই রচিত, বৈষ্ণব পদাবলীতেও এই ধারাই অনুসৃত হয়েছে। চৈতন্যপূর্ব যুগের পূর্বরাগের পদের সঙ্গে প্রাচীন পূর্বরাগের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তবে বৈষ্ণব কবিতায় আদিরসের সঙ্গে ভক্তিরসেরও মিশ্রণ ঘটেছিল। চৈতন্যোত্তর যুগের পূর্বরাগের পদের উপাদান সেই আগের মতোই লৌকিক নরনারীর প্রেমকে অবলম্বন করেই রচিত হলেও দেহধর্ম এখানে বস্তুত অনুপস্থিত। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন—

আত্মেন্দ্রিয়প্রীতি ইচ্ছা তারে বলে কাম।

কৃষ্ণেন্দ্রিয়প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।।

বৈষ্ণব কবিতায় রয়েছে কামগন্ধহীন প্রেমের আর্তি। সুগন্ধি ধূমের জন্য যেমন ধূপকে পোড়াতে হয়, তেমনি আধ্যাত্মিক জগতে উত্তীর্ণ হবার জন্যও দেহকে অবলম্বন করতে হয়। পূর্বরাগের‌ কবিতায় রাধার যে অস্তর ব্যাকুলতা প্রকাশিত হয়েছে, তা দেহধর্মের প্রয়োজনে নয়, আধ্যাত্মিক‌ জগতে উত্তীর্ণ হবার তাগিদে। নিম্নে চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের একটি পদের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হল, এ থেকেই এর দেহাতীত প্রেমের স্বরূপ লক্ষণ বোঝা যাবে।

রাধার কি হৈল অস্তরে ব্যথা।

বসিয়া বিরলে    থাকয়ে একলে

না শুনে কাহারো কথা।

সদাই ধেয়ানে    চাহে মেঘ-পানে

না চলে নয়ান তারা

বিরতি আহারে     রাঙাবাস পরে

যেমত যোগিনী পারা।।

কিংবা গোবিন্দদাসের একটি পদ—

যাহা পহু অরুণ চরণে চলি যাত। 

তাহা তাহা ধরণি হইয়ে মঝু গাত।।

এ সমস্ত ক্ষেত্রে লৌকিক ব্যাকুলতা আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা লাভে ধন্য হয়েছে।

কৃষ্ণের পূর্বরাগ : শ্রীরাধার পূর্বরাগের মতোই শ্রীকৃষ্ণেরও পূর্বরাগের পদ আছে। রাধার প্রত্যক্ষদর্শনসঞ্জাত এই পূর্বরাগ। এই জাতীয় পদ রচনায় বিদ্যাপতি অদ্বিতীয়।

বিদ্যাপতির ‘গেলি কামিনি গজহু-গামিনি বিহসি পালটি নেহারি’ কিংবা ‘খেনে খেনে নয়নকোণ অনুসরই’ প্রসিদ্ধ কবিতা।

চণ্ডীদাসের অনুরূপ পদ রচনায় মৌলিকতা বর্তমান –

‘সই, মরম কহিলু তোরে।’

কিংবা

‘পথে জড়াজড়ি দেখিনু নাগরী সখীর সহিতে যায়।’

‘পূর্বরাগের’ কবিগণ:

(১) চণ্ডীদাস: বৈষ্ণবকবিগণ রাধাকৃষ্ণের লীলাকে যেভাবে দেখেছেন, তাতে প্রত্যেকের দর্শনের মধ্যে নিজস্বতা দেখা দিয়েছে। বিদ্যাপতির সঙ্গে যেমন চণ্ডীদাসের দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য নেই, তেমনি আবার চণ্ডীদাসের সঙ্গে গোবিন্দদাসের পার্থক্য। চণ্ডীদাস রাধাকে দেখেছেন প্রায় উন্মাদিনী বেশে –

‘এলাইয়া বেণী    ফুলের গাঁথনি

দেখয়ে খসায়ে চুলি।

হসিত বয়ানে     চাহে মেঘ-পানে

কি কহে দুহাত তুলি।’

কবিতাটির আরম্ভ -“রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা”। অন্তরধনে ধনী রাধিকা কৃষ্ণসমর্পিতপ্ৰাণা, তিনি তো সমস্তই কৃষ্ণে উৎসর্গ করে বসে আছেন অতএব দেহসৌন্দর্যে কৃষ্ণকে মুগ্ধ করবার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। তাই আপনার সর্বস্ব উৎসর্গ করে তিনি যোগিনী সেজেছেন, শুধুই যে “বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে’, তা নয়, ‘রাধা সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে’ – শ্যাম-সদৃশ মেঘের মধ্যেই তিনি শ্যামের সন্ধান করেন। তার অস্তর ব্যথা প্রকাশ করবার ভাষা নেই।

চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের একটি খুব উল্লেখযোগ্য পদ–সই, কেবা শুনাইল শ্যাম নাম। কবি চণ্ডীদাস সহজে কবি ––সর্বার্থেই। তিনি কৃত্রিমতার দিকে যান না। সহজভাবেই মনের কথা প্রকাশ করেন। তাই রাধাভাবে তন্ময় চণ্ডীদাস যখন আকুল কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘সই, কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’—তখন সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমনও সাড়া দিয়ে ওঠে। এই শ্যাম নাম বিরহ-ব্যাকুল পাঠকেরও ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে’ প্রবেশ করে। কৃষ্ণের সঙ্গে তখনও রাধার সাক্ষাৎকার হয়নি, শুধু তিনি ‘শ্যাম’ নামটি মাত্র শুনেছেন— এতেই তার চিত্রে পূর্বরাগের সৃষ্টি হয়েছে। এই পূর্বরাগে‌ রাধার আপন স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় নেই। তিনি শুধু নাম জপ করতে করতেই অবশ হয়ে পড়েছেন—এই কৃষ্ণ-তন্ময়তাই রাধা-জীবন। তাই, মনে হয়, বৃথাই তিনি ভাবছেন –

‘নাম-পরতাপে যার     ঐছন করল গো

অঙ্গের পরশ কিবা হয়’

এই দেহ-সচেতনতা রাধিকার একান্তই সাময়িক, কারণ তাঁর প্রেম দেহের অনেক ঊলেই অবস্থান করত।

বস্তুত যে সকল বৈষ্ণবপদকর্তা পূর্বরাগের পদ রচনা করেছেন, তাদের মধ্যে সর্বার্থেই চণ্ডীদাস শ্রেষ্ঠ।ভারের দিক থেকে সহজ হয়েও গভীর, ভাষার দিক থেকে সহজ হয়েও গভীর অর্থব্যঞ্জক পূর্বরাগের পদ রচনায় এই বৈশিষ্টা শুধু চন্ডীদাসের রয়েছে, অপর কোনো কবির রচনায় অনুরূপ সমৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায় না বলেই পূর্বরাগের পদ রচনায় চণ্ডীদাসের কৃতিত্ব অপর সকলকে অবশ্যই অতিক্রম করে গেছে।

পূর্বরাগের চিত্র অঙ্কনে চণ্ডীদাস যে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, তৎপ্রসঙ্গে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন যথার্থই বলেছেন, ‘চণ্ডীদাসের বাণী সহজ, সরল সুন্দর… পূর্বরাগের অবস্থা চিত্রিত করিয়া চণ্ডীদাস যে ধ্যানপরায়ণা রাধিকার মূর্তিটি দেখাইয়াছেন, তাঁহার সাম্রনেত্র আমাদিগকে স্বর্গীয় প্রেমের স্বপ্ন দেখাইয়া অনুসরণ করে এবং চৈতন্য প্রভুর দুটি সজলচক্ষুর কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। সেই মূর্তি ভাষার পুষ্প-পল্লবের বহু ঊর্ধ্বে নির্মল অধ্যাত্মরাজ্য স্পর্শ করিয়া অমর হইয়া রহিয়াছে। সেইস্থানে সাহিত্যিক সৌন্দর্যের আড়ম্বর নাই।”

(২) বিদ্যাপতিঃ পূর্বরাগের পদে বিদ্যাপতির খুব প্রসিদ্ধি নেই। তৎসত্ত্বেও পূর্বরাগের রাধার কাছে কৃষ্ণই সর্বস্ব, রাধা বোঝেন।

‘পথীক নাথ মীনক পানি।

জীবক জীবন হাম ঐছে জানি।।

তুহুঁ কৈছে মাধব কহ তুই মোয়

বিদ্যাপতি কহ দুই দোঁহা হোয়।।’

তবে কৃষ্ণের পূর্বরাগ বর্ণনায় বিদ্যাপতি উল্লেখ্য। এখানে বিদ্যাপতি স্বধর্ম পালন করেছেন বলেই তার পদ রসোত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি ভাব ছেড়ে রূপ, রস ছেড়ে অর্থের দিকেই বেশি প্রবণতা দেখিয়েছেন।

“শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ তো আর কিছুই নহে, তাহা রূপমুগ্ধতা। রাধিকার রূপ দেখিয়া কৃষ্ণের মন মজিয়াছে। বিমুগ্ধ প্রাণের এই উচ্ছ্বসিত স্তবোৎসার শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ বিষয়ক পদে অনুপম সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে।”

(৩) গোবিন্দদাসঃ গোবিন্দদাসের পূর্বরাগের পদগুলো অনেক সময় অনুরাগের পর্যায়ে পড়ে। তার পূর্বরাগে দেহের ভাগ অধিক, অনেক ক্ষেত্রেই মন অনুপস্থিত। বিদ্যাপতির মতোই তিনিও রাধার অপেক্ষা কৃষ্ণের পূর্বরাগেই অধিকতর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গোবিন্দদাসের যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি’ পদটিতে কল্প-সৌন্দর্যের মূর্ছনা ও রূপমুগ্ধতা যেন শ্রীকৃষ্ণেরও আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়েছে। স্থূল বর্ণনার চেয়ে অতি সূক্ষ্ম অনুভূতির রসে জারিত হয়ে এখানে রূপময়ী শ্রীমতী রাধিকাও যেন অশরীরী সৌন্দর্য প্রতিমা-রূপে বিকশিত হয়ে উঠেছেন। সাধারণত নারীদেহের উপমায় যে সকল উপমান ব্যবহৃত হয়ে থাকে, কৃষ্ণ সে সকলকে যেন অতিক্রম করে গেছেন।

গোবিন্দদাসের রূপানুরাগের পদগুলিতে যে শিল্পচাতুর্য এবং কবির আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, তা অতুলনীয়। কবি তার উপাস্য দেবতাকে অস্তরে ঠাঁই দিয়েছেন তাতেই আত্মলীন হয়েছেন, কিন্তু কখনও আত্মহারা হননি। গোবিন্দদাস ধীর এবং প্রশাস্ত, তিনি সচেতন শিল্পী। এইদিক থেকে বিচার করেই ডঃ সেন মন্তব্য করেছেন, “তবে বলরাম দাস এবং জ্ঞানদাসের পদে যেরূপ আস্তরিকতা আছে, কবিরাজের অধিকাংশ পদের মধ্যে সেরূপ আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়।” শিল্পীর সচেতনতার জন্যেই কবিতাগুলো অতি বেশি অলঙ্কৃত হয়ে পড়েছে।

(8) জ্ঞানদাস: চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য জ্ঞানদাস পূর্বরাগের পদ রচনায় গুরুর মহিমা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। পূর্বরাগের কয়েকটি পদে কবি রাধার যে পরিচয় দিয়েছেন, তাতে রাধার আকুলতা বা রূপ-মুগ্ধতা যেমন স্বচ্ছন্দ প্রকাশ লাভ করেছে, তেমনি জ্ঞানদাসের কৃতিত্বেরও পরিচায়ক হয়ে রয়েছে। দৃষ্টাত্তস্বরূপ তার অনুরূপ কয়েকটি নিদর্শন উল্লেখ করা যায়—

দেইখ্যা আইলাম তারে সই দেইখ্যা আইলাম তারে। 

এক অঙ্গে এত রূপ নয়ানে না ধরে।।’ 

রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।’

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। 

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।। 

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে

পরাণ পিরীতি লাগি ঘির নাহি বান্ধে।।