চৈতন্যদেবের তিরোধানের অব্যবহিত পরবর্তী কালেই সম্ভবত নরোত্তম দাসঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। ষড়-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে তিনি এক মহোৎসবের আয়োজন করেন। এই উৎসব ‘খেতরীর মহোৎসব’ নামে বিখ্যাত। এই খেতরীর মহোৎসবেই রসকীর্তনের উদ্ভব হয় এবং এই রসকীর্তনকে অবলম্বন করেই অসংখ্য পদের বিশেষত পালাকীর্তনের সৃষ্টি হয়। এই পালাকীর্তনই বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের প্রাণ। বৈষ্ণৱ মহাজনপদগুলো যতখানি কবিতা, তার অধিক গান রাধাকৃষ্ণ লীলাকাহিনী তথা রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বৈচিত্র্য পালাকীর্তনের মধ্যে দিয়েই যথার্থরূপে প্রকটিত হয়েছিল। অতএব কীর্তনে রাধাকৃষ্ণের লীলা কাহিনী যেভাবে পরিবেশিত হয়, তার বিশ্লেষণেই বিভিন্ন রসাশ্রিত পদের পরিচয় পাওয়া যাবে।

কীর্তনের পূর্বেই, যে রসের কীর্তন হবে, সেই রসাশ্রিত গৌরচন্দ্রিকা গেয়ে পালা গানের উদ্বোধন করা হয়। এই রীতিটি সম্ভবত নরোত্তম দাস-প্রবর্তিত। কীর্তনগায়ক বা সঙ্কলয়িতাগণ নানা কবির একই রসাশ্রিত পদ একত্র সঙ্কলন করে এক একটি পালারূপে সাজিয়ে রেখেছেন। রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলার এ প্রকার রূপভেদ অসংখ্য। বস্তুত বিভিন্ন পালাগানের মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণজন্ম থেকে আরম্ভ করে তার মধুরাগমন কাহিনী পর্যন্ত অনেকগুলো পর্যায়ই পাওয়া যাবে – জন্মলীলা, নন্দোৎসব, বাল্যলীলা, গোষ্ঠলীলা, দানলীলা, রাসলীলা, হোলি ঝুলন পূর্বরাগ, অভিসার, মান, ইত্যাদি—বহুবিধ লীলাই পালাগানের অন্তর্ভুক্ত।

আবার রাধিকার মনোভাব ও আচরণকে অবলম্বন করে পদগুলোকে আটটি বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। এদের প্রত্যেকটি পর্যায়ের আবার আটটি করে অবস্থা আছে। ফলত এই আট পর্যায়ের নায়িকার চৌষট্টি প্রকার ভেদ বৈষ্ণব পদাবলীতে রূপায়িত হয়েছে।

(১) অভিসারিকা : প্রিয়মিলনের উদ্দেশ্যে নায়িকা সঙ্কেত কুঞ্জাভিমুখে যাত্রা করেন। এর অষ্টবিধ অবস্থা—জ্যোত্স্নাভিসারিকা, তামসাভিসারিকা, বর্ষাভিসারিকা, দিবাভিসারিকা, কুঞ্ঝাটিকাভিসারিকা, তীর্থযাত্রাভিসারিকা (দেবদর্শনাদি হলে), উন্মত্তাভিসারিকা (বংশীধ্বনি শ্রবণে), অসমঞ্জসাভিসারিকা (অসম্বৃত বেশবাসে)।

(২) বাসকসজ্জা: প্রিয়মিলনের উদ্দেশ্যে নায়িকা স্বদেহ ও কুঞ্জ সাজিয়ে প্রতীক্ষমাণা। এর অষ্টবিধ অবস্থা—মোহিনী, জাগ্রতিকা, রোদিতা, মধ্যোক্তিকা (কান্ত প্রিয়বাক্য বলবেন—এরূপ চিন্তা ও আলাপমগ্না), সুপ্তিকা (কপটনিদ্রাযুক্তা), চকিতা, সুরসা, উদ্দেশ্য (দূতীপ্রেরণকারিণী)।

(৩) উৎকণ্ঠিতা: নায়কের আগমনে বিলম্ব দেখে উৎকণ্ঠাযুক্তা নায়িকা নায়কের জন্যে উৎসুকভাবে অপেক্ষমাণা। এর আটটি অবস্থা দুর্মতি (খলের বাক্যে বিশ্বাসের চিন্তায় অনুতপ্তা), বিফলা (অনুতাপযুক্তা), স্তব্ধা, উচ্চকিতা, অচেতনা, সুখোৎকণ্ঠীতা (কৃষ্ণধ্যানমুগ্ধা), মুখরা (দুতীর সঙ্গে কলহরতা), নির্বন্ধা (নায়িকার কর্মদোষেই নায়ক আসছেন না, এরূপ খেদযুক্তা)।

(8) বিপ্রলব্ধা: প্রতিশ্রুতি দিয়েও নায়ক না আসায় নায়িকা বঞ্চিতা বা প্রতারিতা। এর অষ্টবিধ অবস্থা!–বিকলা (কাস্ত না আসায় ব্যর্থতা বোধ), প্ৰেমমত্তা (নায়ক অন্য রমণীতে আসক্ত, এরূপ দুশ্চিস্তা), ক্লেশা, বিনীতা (বিলাপযুক্তা), নির্দয়া, প্রখরা (বেশভূষণাদি অগ্নিতে বা যমুনায় বিসর্জনে সঙ্কল্পবদ্ধা), দূত্যাদরা (দুতীর প্রতি আদরপরায়ণা), ভীতা (প্রভাত আগমনে)।

(৫) খণ্ডিতাঃ নায়ককে প্রতিনায়িকার নিকট থেকে প্রত্যাবৃত্ত দেখে রুষ্টা। আটপ্রকার অবস্থা— নিন্দা, ক্রোধা, ভয়ানকা, প্রগল্ভা (কলহকারিণী), মধ্যা (অপর নায়িকায় সস্তোগচিহ্নদর্শনে লজ্জাম্বিতা), মুগ্ধা (রোষবাষ্পমৌনা), কম্পিতা, সস্তপ্তা।

(৬) কলহান্তরিতা: নায়ককে প্রত্যাখ্যান করবার পর অনুতাপযুক্তা। অষ্টবিধ অবস্থা— আগ্রহা ক্ষুব্ধা, ধীরা, অধীরা, কুপিতা, সমা(কাস্তের একা দোষ নয়, সকলের দোষেই এরূপ ঘটেছে এই ভাবযুক্তা), মৃদুলা, বিধুরা।

(৭) প্রোষিতভর্তৃকা: নায়কের বিদেশ (মধুরা) গমনে বিরহজীবনযাপনরতা। এর অষ্টবিধ রূপ—ভাবী (ভবিষাৎ বিরহ), ভবন (বর্তমান বিরহ), ভূত, দর্শদশা (চিত্তা, জাগরণ, উদ্বেগ, কৃশতা, জড়তা, ব্যাধি, উন্মত্ততা, মোহ, মৃত্যু), দূতসংবাদ, বিলাপা, সখ্যুক্তিকা ভাবোল্লাসা।

(৮) স্বাধীনভর্তৃকা: নায়ককে নিকটে আপন অধিকারের মধ্যে লাভকারিণী। নায়কের সঙ্গে নায়িকার খণ্ড মিলনের ব্যঞ্জনাযুক্ত আটপ্রকার রূপ কোপনা, মানিনী, মুগ্ধা, মধ্যা (নায়ক যার নিকট কৃতজ্ঞ), সমুক্তিকা, সোল্লাসা, অনুকূল্য, অভিষিক্তা।