‘প্রেমবৈচিত্ত্য’ ও আক্ষেপানুরাগের সংজ্ঞা নির্দেশ করো এবং এই পর্যায়ের পদ আলোচনা করিয়া চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ নির্ণয় করো।

বৈষ্ণব পদাবলীর ‘প্রেমবৈচিত্ত্য’ পর্যায়ের পদগুলির কাব্যগত ও তত্ত্বগত তাৎপর্য কী তাহা বুঝাইয়া দাও। এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা কে? উপযুক্ত উদ্ধৃতিসহ বিচার করো।

‘আক্ষেপানুরাগ’ শীর্ষক রসপর্যায়টির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও বৈষ্ণবীয় অভিনবত্ব বুঝাইয়া দাও তোমার আলোচ্য রসপর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত কোনো একটি পদের সাহিত্যিক মূল্য নিরূপণ করো।


বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে মধুর / শৃঙ্গার রসের উৎকর্ষের কথা বলা হয়েছে। এই রসের দু’টি বিভাগের প্রধানটি ‘বিপ্রলম্ভ এবং বিপ্রলস্ত্রের তৃতীয় পর্যায় ‘প্রেমবৈচিত্ত্য’। প্রেমবৈচিত্ত্যের সংজ্ঞা

“প্রিয়স্য সন্নিকর্যোহপি প্রেমোৎকর্ষ স্বভাবতঃ

যা বিশ্লেষধিয়ার্তিস্তত্ প্ৰেমবৈচিত্র্যমুচাতে।।”

অর্থাৎ প্রেমের উৎকর্ষবশত প্রিয়ের সন্নিধানে থেকেও তার সঙ্গে বিচ্ছেদভয়ে যে বেদনার উপলব্ধি, তাকেই বলা হয় প্রেমবৈচিত্র।

‘প্রিয়ের নিকটে রহে প্রেমের স্বভাবে।

প্রেমবৈচিত্ৰ্যা হেতু বিরহ করি ভাবে।।’

বল্লভদাস একটি পদে প্রেমবৈচিত্তের সুন্দর নিদর্শন দিয়েছেন—

‘সজনি প্রেমক কহবি বিশেষ।

কানুক কোরে কলাবতী কাতর কহত কানু পরদেশ।।’

প্রেমবৈচিত্রের সম্ভবত অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, চণ্ডীদাসের ‘দুই কোরে দুর্খ কাদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’।

প্ৰেমবৈচিত্ৰ্য বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে এক অদ্ভুত বিষয়, এটি বিপ্রলস্তের অন্তর্গত হয়েও যেন সম্ভোগেরই অঙ্গ। সম্ভোগের মধ্যেই যখন অপর কোনো রসের ছায়াপাত ঘটে কিংবা মিলনের মধ্যেই যখন বিরহ ভ্রাপ্তি ঘটে তখনই হয় প্রেমবৈচিত্র্য। মানের অস্তে যে সম্ভোগ, তাতে আনন্দের পূর্ণতা থাকে না, রোখস্মৃতির ছায়া তাকে কিছুটা আচ্ছন্ন করে রাখে, তাই এই মিলন সঙ্কীর্ণ সস্তোগ – কবি কর্ণপুর একে তালিকায় স্থান দেননি। শ্যামের সঙ্গে রাধার মিলন কালেও বিচ্ছেদের ভাবনায় রাধার আক্ষেপ রসোেগারের (রস+উৎগার) স্বতি-চবর্ণা বা স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়েও রাধার আক্ষেপ তিনি শ্যামকে কতই না দুঃখ দিয়েছেন – একেই বলে ‘আক্ষেপানুরাগ’। – – কোনো কোনো সমালোচকের মতে অদর্শনে উপেক্ষাভ্রাপ্তি ঘটে বলিয়া বোধ হয় আক্ষেপানুরাগকে প্ৰেমবৈচিত্ৰ্য বলা হয়।”

এখানে একটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন এসে যাচ্ছে—’প্রেমবৈচিত্র’ এবং ‘আক্ষেপানুরাগ’ কি বৈষ্ণব রসশাস্ত্রমতে এক এবং অভিন্ন বস্তু? প্রশ্নটি উঠেছে এই কারণে যে, অনেক রসবোই এই দুটিকে নামাত্তরমাত্র বলে মনে করেন এবং নির্বিশেষে একটির স্থলে অন্যটিকে ব্যবহার করেন, আবার অপর অনেকেই এই দুটির পৃথক সংজ্ঞা ও স্বরূপ নির্দেশ করে থাকেন। কোনো কোনো রসশাস্ত্রী বলেন যে প্রেমবৈচিত্র্যের যে আটটি বিভাগ কল্পনা করা হয়, ‘আক্ষেপানুরাগ’ তাদের মধ্যে একটি। অতএব প্রেমবৈচিত্রের পরিধি অনেকটাই ব্যাপক। কিন্তু প্রেমবৈচিত্তের সংজ্ঞা রূপে যা’ নির্দেশ করা হয়েছে, তাতে এর ব্যাপকতা অনেকটা সীমিত হয়ে আসে। কারণ প্রেমবৈচিত্তোর একটা বিশিষ্ট লক্ষণ – প্রিয়সান্নিধ্যেই নায়িকার বিরহস্রাস্তি ঘটে। পক্ষান্তরে আক্ষেপানুরাগে অনুরাগের আধিক্যহেতু প্রিয়জনের অদর্শনে উপেক্ষাভ্রাস্তি ঘটে। রসশাস্ত্রীদের এই নির্দেশ মানতে গেলে যথার্থ প্রেমবৈচিত্তের পদকে আক্ষেপানুরাগ কিংবা আক্ষেপানুরাগের পদকে প্রেমবৈচিত্র্য রূপে গ্রহণ করা যায় না। এই বিচারে সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে প্রকৃত প্রেমবৈচিত্তের পদ খুবই সামান্য কটি মাত্র। বিশিষ্ট কবি ও বৈষ্ণব-তত্ত্বঞ্জ কালিদাস রায় প্রেমবৈচিত্র এবং আক্ষেপানুরাগ-বিষয়ে পদকর্তাদের ধারণাকে অস্বীকার করে বলেছেন: “আসলে প্ৰেমবৈচিত্ৰ্যা ইহাকে বলা যায় না। প্রণয়িজন কন্ঠাশ্লিষ্ট থাকিলেও উপভুক্তা মিলনসুখমুগ্ধা নায়িকাচিত্তের যদি অন্যথাবৃত্তি হয়, তবেই তাহাকে প্রেমবৈচিত্র বলা যায়। পক্ষান্তরে আক্ষেপানুরাগ সম্বন্ধে তার বক্তব্য রাধার অনুরাগই তো আক্ষেপানুরাগ। রাধার অনুরাগ অসীম, কিন্তু বঁধুর সহিত মিলনে এত বাধাবিঘ্ন যে রাধার আক্ষেপের সীমা নাই।…প্রকৃতপক্ষে পূর্বরাগ হইতে মাথুর পর্যন্ত রাধার জীবনের প্রত্যেক লীলা বৈচিত্র্যে এই আক্ষেপের সুর ধ্বনিত হইতেছে। প্রেমের উৎকর্ষই প্রেমবৈচিত্র্যের মূলকথা এবং এই প্রেমের উৎকর্ষের জন্যই স্বীয় ভাগ্যের প্রতি আক্ষেপের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন বিরহের সুর বর্তমান।”

যথার্থ ‘প্রেমবৈচিত্তো’র পদের চণ্ডীদাসের ‘দুই কোরে দুই কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’, বল্লভদাসের ‘কানুক কোরে কলাবতি কাতর / কহত কানু পরদেশ’, গোবিন্দদাসের নাগর কোরে নাগরি নাহি জান / মুরছলি নাগর মুরছলি রাই’, ‘নাগর সঙ্গে রঙ্গে যব বিলসই / কুঞ্জে শুতলি ভুজ পাশে’, মাধবীদাসের ‘রাধামাধব বিলসই কুঞ্জক মাঝ’ প্রভৃতি।

উৎকর্ষ ও বিশ্লেষণ: প্রেমবৈচিত্র্যের নিমিত্ত শ্রীমতীর মনে যে সমস্ত বিষয়ে আক্ষেপের সৃষ্টি হয়, রূপ গোস্বামী তাদের অষ্টধা বিভক্ত করেছেন – (১) শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আক্ষেপ, (২) নিজের – প্রতি আক্ষেপ, (৩) সখীর প্রতি আক্ষেপ, (৪) দূতীর প্রতি আক্ষেপ, (৫) মুরলীর প্রতি আক্ষেপ, (৬) বিধাতার প্রতি আক্ষেপ, (৭) কন্দর্পের প্রতি আক্ষেপ, (৮) গুরুজনের প্রতি আক্ষেপ।

বৈষ্ণব দর্শনে সুপণ্ডিত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় রাধার প্রেমবৈচিত্তাকে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ‘প্রেমবৈচিত্ত—প্রেমের বিচিত্ততা, ইহার মধ্যে বিরহের সুর আছে। প্রিয়তমের দর্শন না পাইলে ক্ষণমাত্রকে যুগ বলিয়া মনে হয়, আবার মিলন হইলে সন্দেহ হয় পাইয়াছি তো? অভাগীর অদৃষ্টে এ সুখ স্থায়ী হইবে তো? হয়তো এখনই হারাইব। মিলনের দীর্ঘ সময়কেও পল বলিয়া মনে হয়, মনে হয় এই তো এখনই ফুরাইয়া গেল। সংসারে কেহ আপনার নাই, অপরে পরের ভালো দেখিতে পারে না। বিধাতাও বিরূপ, অন্য সব ছাড়িয়া যাহাকে আপনার বলিয়াছিলাম – আজ সেই পর বলিয়া মনে করিতেছে। তাহার ছায়াও দেখিতে পাই না। আমার যৌবন, এই বৃন্দাবন, এই যমুনা, এই কদস্থ কানন, এই বংশীধ্বনি—আর সর্বোপরি সুন্দর শ্যাম সখি, আমি আপনি খাইয়া সর্বস্ব হারাইলাম। ব্রজে আরো ত কত যুবতী আছে। যমুনায় জল আনিতে কে যায় না, মুকুন্দ মুখারবিন্দ কে দেখে না, বংশীধ্বনি কে শোনে না -কিন্তু কার এত জ্বালা। বাঁশী কেন আমারই নাম ধরিয়া ডাকে? বাঁশি কি জানে না আমি সহায়হীনা অবলা, আমি গৃহ-কারাগারে বন্দিনী, সংসারে কত বাধা, কত নিষেধ, পথে কত বিঘ্ন, আর তাহাতে আমাতে কত দুরতর ব্যবধান। ইহাই প্রেমবৈচিত্র্যের অপর দিক্‌। জীবনের ইহাও একটি অন্তর্নিহিত সুর।”

কৃষ্ণ কখনও রাধাকে উপেক্ষা করতে পারেন না, তাহলে রসদোষ ঘটে, কারণ রাধা যে কৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া। আসলে এটা রাধার মনের ভ্রম: তার ধারণা, কৃষ্ণ তাঁকে উপেক্ষা করছেন এটাই রাধার আক্ষেপের কারণ। প্রেমার্ত চিত্রের এই স্বাভাবিক ধর্মহেতু রাধার আক্ষেপ- অনেক কবিই রাধার এই মনোভাবকে রূপদান করেছেন।

চণ্ডীদাসের রাধা বলেন

ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।

পর কৈলু আপন আপন কৈনু পর।। 

বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও।

মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।

রাধার আক্ষেপ এবং হতাশার একটা চরম রূপ প্রকটিত হয়েছে রাধার এই উক্তিতে

‘বধুর লাগিয়া ঘর তেয়াগিনু লোকে অপযশ কয়।

এ ধন আমার লয় আন জন ইহা কি পরাণে সয়।।

সই, কত না রাখিয়া হিয়া।

আমার বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারি আঙিনা দিয়া।।

বঁধুর হিয়া এমন করিল না জানি সে জন কে।

আমার পরাণ যেমন করিছে তেমনি হউক সে।।’

এই হতাশাবোধই আক্ষেপানুরাগের পদগুলোর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এই হতাশাবোধ, এই নৈরাশ্য থেকেই রাধার মনেও বৈরাগ্য জাগে

‘সুখের লাগিয়া    এ ঘর বাঁধিনু

আনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়া-সাগরে    সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল।।’

রাধার আক্ষেপের মূলে রয়েছে অতৃপ্তি, যা পেয়েছেন তাতে তৃপ্তি নেই—সব সময় হারাই হারাই ভাব। এই ভয়েই তিনি আর কোনো আনন্দকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারেন না।‌ তাই কবিবল্লভের (বা বিদ্যাপতির) রাধিকা বলেন—

‘জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু

নয়ন না তিরপিত ভেল।

লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু

তবু হিয়া জুড়ন না গেল।।’

সম্পূর্ণ করে পাওয়া আপন করে পাওয়া এমন করে পাওয়া, যার মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই, তেমন পাওয়ার জন্যেই রাধার আগ্রহ না পাওয়াতেই অতৃপ্তি। জ্ঞানদাসের রাধা তাই বলেন

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে। 

পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।’

প্রেমবৈচিত্তোর অপর একটি বৈশিষ্ট্য – সব কিছুর উদ্দেশ্যেই তার আক্ষেপ।

রাধার নিজের উপরও আক্ষেপ কম নয়— ‘মরমক দুখ কহিতে হয় লাজ – নিজেকেই নিজের দোষের জন্য ধিক্কার দেন।

সর্বশেষে রাধা সার সত্য বুঝেছেন, সর্বস্ব ত্যাগ করে কৃষ্ণকে নিয়েই তিনি বিবাণী হবেন; তাই সখীকে ডেকে বলেছেন

‘সখিহে আপন ঘরে যাও।

জিয়ন্তে মরিয়া যে    আপনা খাইয়াছে

তারে তুমি কি আর বুঝাও।’

সর্ব আক্ষেপের নিবৃত্তি হতে পারে এই একটি উপায়ে প্রেমের সাগরে ভেসেই যেতে হবে কুলের মায়ায় থাকলে চলবে না। শ্যাম রাখি কি কুল রাখি এই দ্বন্দ্বে থাকলে আর কখনও আক্ষেপের নিবৃত্তি ঘটবে না। অতএব—

‘তোরা কুলবর্তী    ভজ নিজ পতি

যার যেবা মনে লয়।

ভাবিয়া দেখিনু    শ্যাম বন্ধু বিনু

আর কেহ মোর নয়।’

কিন্তু ঘরে রয়েছে বাপ-মা, আছেন স্বামী–সবাই কী ভাববেন? এরও সহজ সমাধা রাধা করে –

“ছাড়ে ছাড়ুক পতি    কি ঘর বসতি

কিবা বলিবে বাপমায়।

জাতিজীবন ধন    এ রূপ যৌবন

নিছনি সর্পিব শ্যাম পায়।।

(অ) প্ৰেমবৈচিত্র্য / আক্ষেপানুরাগের কবিগণ: বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের বহু কবিই আক্ষেপানুরাগের পদ রচনা করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ কবিই তাদের কবিতায় প্রাণ সঞ্চার করতে পারেননি। এ যেন রীতি রক্ষার জন্যেই তারা কলম ধরেছিলেন। কবিবল্লভ অথবা বিদ্যাপতি রচিত ‘জনম অবধি হাম অবশ্যই তার মধ্যে ব্যতিক্রম গোবিন্দদাস, বলরাম দাস, কবিশেখর প্রভৃতি আক্ষেপানুরাগে কিছু কিছু বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন, তার নিদর্শন পূর্বেই দেওয়া হয়েছে। আক্ষেপানুরাগের পদ রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জ্ঞানদাস ও চণ্ডীদাস, অবশ্যই চণ্ডীদাস সর্বোত্তম।

১. জ্ঞানদাস: জ্ঞানদাসের অনেকগুলো পদই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাধার যে প্রেম, কত আকাঙ্ক্ষা মনে পুষে রাধা ঘর বেঁধেছিলেন

‘সুখের লাগিয়া    এ ঘর বাঁধিনু

আনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়া-সাগরে    সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল।।’

এই পদটি পরিপূর্ণতায় চণ্ডীদাসের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। রাধা কৃষ্ণপ্রেমের বশীভূত হয়ে স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যও বিসর্জন দিয়েছিলেন

‘বঁধু, তোমার গরবে    গরবিনী আমি

রূপসী তোমার রূপে।

হেন মনে করি    ও দুটি চরণ

সদা লইয়া রাখি বুকে।।’

এমনভাবে কৃষ্ণপ্রেমাতুরা হয়েও তো রাধার চিত্তে সুখ নেই – কৃষ্ণবিরহে জীবন তো কাটতে চায় না। সখীরা সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু তাতে রাধার অস্তরে আরো জ্বালা ধরে। তিনি সখীদের বলেন, নিভান অনল আর পুন কেন জ্বাল? এইভাবেই জ্ঞানদাসের রাধা দিনের পর দিন কৃষ্ণের পথ চেয়েই কাটিয়ে দিচ্ছেন

‘পস্থ নেহারিতে    নয়ন অন্ধায়ল

দিবস লিখিতে পথ গেল।

দিবস দিবস করি    মাস বরিখ গেল

বরিখে বরিখে কত ভেল।।’

(২) চণ্ডীদাস: চণ্ডীদাস অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন আক্ষেপানুরাগের পদে। এখানে কবির তথা রাধার ভাবতন্ময়তা পূর্বরাগ অপেক্ষাও গভীর আক্ষেপানুরাগের আরও কয়েকজন বড়ো বড়ো কবি আছেন, কিন্তু তাদের রাধিকা অহংকে ত্যাগ করতে পারেননি, তাই আক্ষেপের‌ সঙ্গে অনুযোগও বর্তমান। কিন্তু চণ্ডীদাসের রাধিকার মনে কোনো অনুযোগ নেই, তিনি যে আপনার সর্বস্ব বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। তিনি ‘রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি’–এইভাবে শুধু অধীর অপেক্ষায়ই দিন কাটিয়ে দিয়েছেন, আর কী-ই বা করবেন। কিন্তু এর পরও যখন দেখতে পান ‘আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়, আমার আঙ্গিনা দিয়া’— তখন তিনি জ্ঞানদাসের রাধিকার মতো ‘কেশ ছিঁড়ি ফেলি বেশ দূর করি’ আপন মাথা ভাঙবার কথা ভাবেন না–শুধু নীরবে অভিশাপ দেন,–’আমার পরাণ যেমতি করিছে, তেমতি হউক সে।’

আক্ষেপানুরাগের পদে রাধার অবস্থাটি শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে

‘চোরের মা যেন পোয়ের লাগিয়া 

ফুঁকরি কাদিতে নারে।।’

চণ্ডীদাস রচিত আক্ষেপানুরাগের একটি বিশিষ্ট পদ—

‘কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান। 

অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।’

কৃষ্ণপ্রেমের জন্যে তিনি ঘরকে বাহির করেছেন, বাহিরকে করেছেন ঘর, দিনকে রাত, রাতকে দিন‌ করেছেন – প্রকৃতির বিধানকেও যেন তিনি লঙ্ঘন করেছেন, তবু –

‘বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি।’

কৃষ্ণপ্রেমের দারুণ বেগে তিনি কেবল ভেসেই চলেছেন, কুল ছেড়েছেন, তবু কুল পাচ্ছেন না!‌ নিতান্ত অসহায় তিনি—

‘এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।’

এই নিতাস্ত দুঃসময়েও যদি কৃষ্ণ তার পাশে এসে না দাঁড়ান, তবে আত্মবিসর্জন ছাড়া আর কোনো গতি নেই—

‘বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও।

মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।।’

-এই রাধাকে একমাত্র চণ্ডীদাসই সৃষ্টি করতে পারেন।